আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাস্তবে এই নামে কেউ এই শহরে থাকে না

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে তাঁর জন্ম হয়নি। তাঁর জন্ম হয়েছে সময়ের গর্ভে, সময়ের প্রয়োজনে। সময় দেখল, কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের পরে আরেকটা নতুন ধরনের মধ্যবিত্ত চলে এসেছে দৃশ্যপটে। কত বারান্দায়, কত জানালায়, কত পায়া-মচকে-যাওয়া খাটে, অসাবধানে কলম-চোয়ানো কালিতে ভরে যাওয়া বুকপকেটে প্রতিদিন কত গল্পের জন্ম হচ্ছে। পথশিশুর মতো অনাথ এসব গল্পের, এসব আনন্দের, এসব দুঃখের, এসব মধ্যবিত্ত পাপবোধের অভিভাবকত্ব কে নেবে? সময় তাই জন্ম দিল এক জাদুকরের।

হুমায়ূন আহমেদ নাম।
হুমায়ূন আহমেদ পরম মমতায় সেসব বেদনা, সেসব আনন্দ ছড়িয়ে বেড়ালেন আমাদের মানচিত্রজুড়ে। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, একজন মহান শিল্পীর হাতে সবচেয়ে খারাপ চরিত্রটিও পরম নিরাপদ বোধ করে। শিল্পী যখন খারাপ মানুষকেও আঁকবেন, তখন একটা ‘মানুষ’ই আঁকবেন, সিনেমার ভিলেন নয়। হুমায়ূন আহমেদের মতো এত আশ্চর্য সংবেদনশীলতায় খারাপ মানুষকে বা ভালো মানুষের খারাপিকে আর কে আঁকতে পেরেছে? এখানে পাঠককে অনুরোধ করব, তাঁরা যেন না ভাবেন, হুমায়ূন আহমেদ কেবল খারাপ মানুষই ভালোভাবে এঁকেছেন।

খারাপ মানুষের উদাহরণ দিলাম। কারণ, খারাপ মানুষ ভালোভাবে আঁকা সবচেয়ে কঠিন কাজ। ‘খারাপ মানুষ’ আর ‘ভালো মানুষ’—এই কথাগুলো প্রচলিত সামাজিক অর্থে ব্যবহার করলাম।
প্রথম আলো লিখতে বলেছে মহাকাব্য, শব্দসীমা দিয়েছে ৬০০! ৬০০ শব্দে আমি কেমনে ধরি তাঁরে?
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সব কথাই বলা হয়ে গেছে, সব বিশেষণই দেওয়া হয়ে গেছে। তিনি আমাদের কালের সবচেয়ে বড় নায়ক, আমাদের সময়ের সবচেয়ে ধারালো চোখের অধিকারী, সবচেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ান।

কিন্তু সময় এসেছে হুমায়ূন আহমেদ মানুষটাকে নির্মোহভাবে বোঝার। যে যার মতো করে বুঝুক। গল্পের চরিত্রকে যেমন একেকজন পাঠক একেকভাবে বোঝেন, একেকভাবে পাঠ করেন, সেই রকম করে তাঁকে বোঝাবুঝি হোক। হুমায়ূন আহমেদ যত গল্পই বানিয়ে থাকুন, যত চরিত্রতেই প্রাণ দিয়ে থাকুন, এর কোনোটিই তাঁর নিজের মতো বর্ণাঢ্য নয়।
হুমায়ূন আহমেদকে অনেকে দেবতাজ্ঞান করেন।

কেউ কেউ তাঁকে ‘জনপ্রিয়’ বলে উড়িয়ে দেন। কেউ দ্বিতীয় বিয়ের কারণে তাঁর নাম শুনতে পারেন না। আবার অনেকেই তাঁর নাম শুনলেই আবেগে অজ্ঞান হয়ে যান। কী ভীষণ ‘তীব্র’ এক চরিত্র। ফারুক ওয়াসিফ এক অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন ‘মৃদু মানুষের ঈশ্বর’ নামে।

সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, কী করে আস্তে আস্তে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে এই সময়ের মধ্যবিত্ত জীবনের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তার সঙ্গে কিছু কথা যোগ করতে চাই। হুমায়ূন আহমেদ অবধারিতভাবেই ‘অভিজ্ঞতাজাত লেখক’। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, যে গুলতেকিনের জন্য প্রেমে পুড়েছিলেন, যেসব মধ্যবিত্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন, অবলীলায় সেসব পাঠকের প্লেটে তুলে দিচ্ছিলেন। এই রকম ‘ফ্রেশ ফ্রম দি ওভেন’ জিনিস চেখে আমরা ঘোরগ্রস্তের মতো এই জাদুকরকে ভালোবাসছিলাম।


কিন্তু সম্ভবত উনার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা পরিবর্তনের পর উনি আর নিজের ‘অনন্ত অম্বর’-এ ডুব দিতে রাজি ছিলেন না। হয়তো উনি আর নিজের বর্তমান জীবন, নিজের আশপাশের সমসাময়িক জীবন—এসব নিয়ে হুমায়ূনীয় কায়দায় ‘স্বীকারোক্তি’তে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। অথচ এই অধ্যায়েই তাঁর জীবন সবচেয়ে ‘তীব্র’ রূপ ধারণ করেছিল। সমাজের ভ্রুকুটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভালোবাসার মানুষ শাওনকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। প্রিয়তম কন্যা শীলা-নোভা-বিপাশাদের ভালোবাসা থেকে এক ‘বেদনাবিধুর স্বেচ্ছানির্বাসন’ বেছে নিয়েছিলেন।

স্মৃতি-বর্তমান-ভবিষ্যতের জটিলতার এক অমৃত পান করেছিলেন। আহা, এই পর্যায়ে যদি আমরা আগের হুমায়ূনকে পেতাম, তাহলে তীব্র এই সময়ের ছবি নিয়ে কী তীব্র গল্পই না পেতাম! কিসের বাদশাহ হুমায়ূনের (বাদশাহ নামদার) গল্প পড়ব আমরা? আমাদের হুমায়ূনের গল্প পড়েই তো আমাদের দিবস-রজনী স্থবির হয়ে যেত।
হুমায়ূন আহমেদের মতো আর কে পারে আমাদের সব কাজে স্থবির করে শহীদ মিনারে একজন লেখকের লাশ দেখতে টেনে নিয়ে যেতে? উনি ছাড়া আর কে পারে আমাকে সিউলের মাটিতে বর্ষার দিনে কাঁদাতে। তিনি যখন চলে গেলেন, আমি তখন টেলিভিশন ছবির পোস্ট প্রডাকশনের কাজে সিউলে। আমি তখন শীলা-নুহাশের জন্য কাঁদছি, গুলতেকিনের জন্য কাঁদছি, শাওনের জন্য কাঁদছি, শাওনের সন্তানদের জন্য কাঁদছি, জাদুকরের মা আয়েশা ফয়েজের জন্য কাঁদছি।


পাদটীকা
১. এই লেখা লিখছি শুটিং বন্ধ করে। তিনি ছাড়া আর কে পারে আমার শুটিং আটকাতে। আমার বউ পারে অবশ্য!
২. পিঁপড়াবিদ্যা নামে যে ছবি করছি, সেটার অন্যতম অভিনেতা নুর ইমরান চরম হুমায়ূনভক্ত। জানতে চাইল, ‘বস, আপনার সঙ্গে কখনো হুমায়ূন আহমেদের দেখা হয় নাই?’ আমি বললাম, ‘গল্পের চরিত্রের সঙ্গে কীভাবে দেখা হবে? হুমায়ূূন আহমেদ তো একটা কুহক। বাস্তবে এই নামে কেউ এই শহরে থাকে না।

’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.