ক্লান্ত পথিক বাংলাদেশ-ভারতের ইতিহাসের সব'চে আলোচিত এবং ঐতিহাসিক চুক্তিটির নাম ট্রানজিট চুক্তি। একে ট্রানজিট না বলে করিডর বলাই শ্রেয়। ট্রানজিটের সংজ্ঞা হলো একটি দেশ দ্বিতীয় একটি দেশের ভূখন্ডের ভিতর দিয়ে তৃতীয় কোন দেশে যখন যায়, তখন দ্বিতীয় দেশকে প্রথম দেশের ট্রানজিট বলা হয়। কিন্তু করিডর এর সংজ্ঞা হলো একটি দেশ দ্বিতীয় দেশের ভূখন্ডের ভিতর দিয়ে যখন নিজের দেশেরই অন্য অংশে যায় তখন দ্বিতীয় দেশকে প্রথম দেশের করিডর বলা হয়। ভারত এই চুক্তির জন্য উন্মুখ হয়ে আছে তার নিজের স্বার্থের জন্য।
সাতকন্যা বা Seven Sisters নামে পরিচিত ভারতের সাতটি অঙ্গরাজ্য হলো অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা, এবং মিজোরাম। ভৌগলিক অবস্থানের বৈরীতার কারণে এই সাতটি রাজ্য ভারতের সার্বিক উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে আছে। বৈরী যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ভারতও তার এই সাতটি রাজ্যের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ । তাই এসব রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ সবসময়ের সঙ্গী। ভারত তার নিজের স্বার্থেই চাচ্ছে খুব কম সময়ে এই সাতটি রাজ্যের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম তৈরী করতে।
বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে ভারতের পূর্ব অংশ এবং উল্ল্যেখিত সাতটি রাজ্যের মাঝে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে seven sisters এ যেতে পারলে ভারতের অর্ধেক সময় বেঁচে যাবে। যেহেতু ভারত তারই অঙ্গরাজ্যের সাথে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করছে তাই একে ট্রানজিট না বলে করিডর বলাটাই শ্রেয় হবে। আমি গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে ট্রানজিটের সুবিধা ভারত কিভাবে পাবে তা দেখানোর চেষ্টা করেছি। ছবিতে আছে এখন কলকাতা থেকে আসামে যেতে ১২০০ কিমি পথ পাড়ি দিতে হয় কিন্তু বাংলাদেশের ট্রানজিট ব্যবহার করলে এই সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
ছবি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
দুটো দেশের মধ্যে কোন বড় চুক্তি হলে দুটো দেশই চায় তার নিজের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে। বাস্তবিক অর্থে কোন দেশই অন্য কোন দেশের বন্ধু নয়। কোন দেশই চায় না তার সার্বভৌমত্ব এবং স্বার্থকে বিকিয়ে দিতে। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দুটি দেশ যখন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে তখনই ঐ দেশগুলিকে পরস্পরের বন্ধু বলা হয়। ট্রানজিট বা করিডর চুক্তি হলে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক যে লাভ হবে সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের কোন লাভই হবে না।
একটা উদাহরণ দেয়া যায়, রক্তচোষা হিসাবে খ্যাত world bank, IMF ইত্যাদি দাতা সংগঠনগুলো উন্নয়নশীল দেশকে যে ঋণ দেয় তাতে সুদের পরিমান শতকরা ০.২৫ থেকে সর্বোচ্চ শতকরা ১.০ পর্যন্ত। কিন্তু ট্রানজিট চুক্তি হলে ভারত বাংলাদেশকে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে ঋণ দিবে তার সুদের পরিমান শতকরা ১.৭৫ ! এখানেই শেষ নয়!! ট্রানজিটের মূল্য নির্ধারণের সময় ট্রানজিট দেশ সবসময় বেশী মূল্য দাবি করে। পরবর্তীতে দ্বিপাক্ষীয় আলোচনায় ঐ মূল্য আরো কমে যায়। ব্যাপারটা হলো “কামান চাইলে গুলি দেবার মতো!” কিন্তু বাংলাদেশ ট্রানজিট মূল্য প্রথমেই দাবি করেছে কম যা আলোচনার পরে আরো কমে আসবে বলে সবার আশঙ্কা। ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশ বেশ কিছু সমস্যায় পড়বে বলে বিশেষজ্ঞমহলের আশঙ্কা।
তার মধ্যে আছে চোরাচালান বৃদ্ধি, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ইত্যাদি। বাংলাদেশে এখন যেভাবে আভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা বাড়ছে তার উপর ট্রানজিটের ফলে অপরাধ যদি আরো বেড়ে যায় তাতে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলার পরিবেশ কোথায় গিয়ে দাড়াবে সেটা সময়ই বলে দিবে! চোরাচালানের ফলে ভারতীয় পন্যসামগ্রীতে যখন দেশ সয়লাব হয়ে যাবে তখন আমাদের দেশীয় উন্নয়নশীল পন্যের বাজার মারাত্বক হুমকির মুখে পড়বে। এসব নিয়ে আশা করি সরকারে আসীন বিশেষজ্ঞরা ওয়াকিবহাল আছেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপও নিবেন। কারণ অবকাঠামো উন্নয়ন বলতে শুধু সুন্দর চার লেন, ছয় লেনের রাস্তা ভারতের জন্য তৈরী করা বোঝায় না, ভবিষ্যতে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে এবং এর সম্ভাব্য সমাধান তৈরি করে রাখাকেও বোঝায়। বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তির বিনিময়ে অনেক ন্যায্য দাবি পূরণ করতে পারতো।
কিন্তু বাংলাদেশ তা করতে পারছে না। বাংলাদেশের একটা ন্যায্য দাবি হলো তিস্তার পানি চুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য ৫৪ টা অভিন্ন নদী রয়েছে। সবার আশা ধীরে ধীরে সবগুলো নদীর পানি বন্টন চুক্তি হবে। তিস্তা পানি চুক্তি নিয়ে অনেক রাজনৈতিক অপতৎপরতা শুরু হয়েছে।
অতি নাটকীয়ভাবে কলকাতার মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন উনি মনমোহন সিং এর সাথে বাংলাদেশ সফরে আসবেন না। যে বাংলাদেশ মমতা ব্যানার্জীকে খুব আপন ভাবতো সেই মমতা ব্যানার্জীই বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন। কারণটা হলো তিস্তার পানি চুক্তির ফলে বাংলাদেশ নাকি বেশী পানি পাবে!! এটা একটা রাজনৈতিক কৌশল। বাংলাদেশ যদি বেশী পানি দাবি না করতে পারে অথবা তিস্তা পানি বন্টন নিয়ে আর কোন দাবিদাওয়া না উঠাতে পারে। তিস্তা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ৪৮ ভাগ পানি পাবে।
কিন্তু মমতা ব্যানার্জি বলেছেন এই সংখ্যা ২৫ ভাগ হতে হবে!! তিস্তা ব্যারেজে পানির যে পরিমান তা মূল তিস্তা নদী থেকে অনেক অনেক কম। কারণ তিস্তা নদীর উজান থেকে ভারত পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তিস্তা চুক্তি কিন্তু এই মুল নদী নিয়ে নয়!! পানি সরিয়ে নেবার পর যেই অবশিষ্ট পানি পাওয়া যাবে তার ৪৮ ভাগ পাবে বাংলাদেশ!! তাতে সামগ্রিকভাবে কোন লাভ হবে না বাংলাদেশের। শুধু শুনতেই ভালো লাগবে “তিস্তা পানি চুক্তি” !!
ছিটমহল নিয়ে কিছু কথা বলতে মনে চাইছে। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষ ছেড়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু রেখে গিয়েছে ছিটমহল নামের অভিশাপ।
দেশ ভাগ করার সময় বাংলাদেশের ভিতর ভারতের কিছু গ্রাম এবং ভারতের ভিতর বাংলাদেশের কিছু গ্রাম রেখে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ভাগ করে। বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের ভিতর বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহল রয়েছে। এখানে প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি এবং ভারতের প্রায় ৩৭০০০ লোকর বসবাস। ১৯৪৭ সালে মুজিব-ইন্দিরা ঐতিহাসিক চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষরা নিজেরাই স্বিদ্ধান্ত নেবে তারা কোন দেশের নাগরিক হতে চান।
এত বছর পার হলো কোন সরকারই এই মানবিক একটা সমস্যার সমাধান করতে পারলো না !! উপরন্তু বাংলাদেশ-ভারতের সাথে একটা চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ ভারতকে বেরুবারি ছিটমহল দেবে বিনিময়ে ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ছিটমহল আঙ্গুরপোতা-দহগ্রামের মানুষদের বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ভারত তাদের তিন বিঘা জমি ব্যবহার করতে দিবে। বাংলাদেশ বেরুবারি ছিটমহল ভারতকে হস্তান্তর করলেও তিন বিঘা নিয়ে ভারত টালবাহানা শুরু করে। দুঃখগাঁথা এই তিন বিঘা জমিই তিন বিঘা করিডর নামে পরিচিত। ভারত সরকার প্রথমে ছয় ঘন্টার জন্য করিডরের গেট খুলে রাখার স্বিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে এই সময় বারো ঘন্টায় বাড়ানো হয়।
অথচ চুক্তিতে তিন বিঘার উপর এই ধরণের কোন নিয়ন্ত্রনেক কথা ছিল না। যাহোক মানবতাবাদী সব মানু্ষ চায় ছিটমহলের একটা সুনির্দিষ্ট সমাধান। কারণ উভয় দেশের ছিটমহলবাসীরাই চরম কষ্ট ভোগ করছে।
আরো অনেক ব্যাপার আছে যার সমাধান হওয়া দরকার। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বড় ধরণের বানিজ্য ঘাটতি পূরণে দুই দেশ বিশেষ করে ভারত কি পদক্ষেপ নিচ্ছে? বরাবরের মতো বাংলাদেশ এখানে কোন লাভবান হতে পারবে না।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে প্রচারের ব্যাপারেও কোন মতৈক্যে আসা যায়নি। কেবল বিটিভি প্রচারের অনুমতি মিলেছে!! ঐটা না হওয়ার মতোই!!
ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে চুক্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। সীমান্তের দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখাও জরুরী। কিন্তু ট্রানজিট, তিস্তা পানিবন্টন, ছিটমহল সহ অন্যান্য বিষয়গুলোতে ভারত যেভাবে বাংলাদেশের সাথে আচরণ করছে সেটা কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ।
আমাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে শুধু ভারত নয় কোন দেশের সাথেই কোন চুক্তি করা ঠিক হবে না। আর চুক্তি যদি করতেই হয় তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আশা করি বাংলাদেশের সরকার সঠিকভাবে পর্যালোচনা করবেন। কারণ তীর যদি একবার ছু্টেই যায় তাক আর ফেরানো যাবে না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।