(c) নাসিফ চৌধুরী ১.
সাত সকালে বিড়ালের মিউমিউ শব্দ হচ্ছে । বিড়ালটা ক্রমাগত ডেকেই চলেছে । আধো-ঘুমের মধ্যে ‘বিড়ালের’ মিউ মিউ রহস্যটা সমাধান করতে হিমুর কিছুটা সময় গেলো । বাস্তবের কোন বিড়াল ডাকছে না । কানের কাছে সেলফোন নামক এক মহাবিরক্তিকর বস্তুর রিংটোন বাজছে।
হিমুর সেলফোন ছিলনা । দু-তিন দিন আগে রুপা একটা দামি ফোন তাকে কিনে দিয়েছে । সেখানে রুপা তার নাম্বার সেভ করে দিয়েছে , সুন্দর দেখে বিড়ালের ডাকওয়ালা একটা রিংটোন সেট করেছে। বিড়াল আবার রুপার খুব পছন্দের প্রাণী ।
সেই থেকে সমস্যার শুরু ।
কারনে অকারনে বিড়াল ডেকে উঠে । সেই ডাক অগ্রাহ্য করার উপায় নেই, এমনকি মাঝেমাঝে প্রকৃতির ডাককে উপেক্ষা করে এই বিড়ালের ডাকে সাড়া দিতে হয় !! তখন ওপাশ থেকে রুপার মিষ্টি আওয়াজ ভেসে আসে ‘এই কি করছো ?’ হিমু উত্তর দেয় ‘বিড়ালের ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম’
-মানে ?
-না মানে তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম !
সেলফোন ব্যবহার করতে হলে দ্রুত মিথ্যা কথা বলা রপ্ত করতে হয় । হিমুও অনর্গল মিথ্যা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে । এখন পর্যন্ত সাফল্য ঈর্ষনীয় !!
ফোনের বিড়াল ডেকেই চলেছে , হিমু বিড়ালের ডাকে পাত্তা না দিয়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে থাকলো । অবশেষে বিরক্ত হয়ে হিমুকে সেই ডাকে সাড়া দিতেই হলো ।
রুপা ফোন করেছে ভেবে হিমু ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো ‘ হ্যালো জান’
ওপাশ থেকে ভারী মহিলা কন্ঠে উত্তর এলো –‘চুপ বেয়াদব । আমি তোর জান না , তোর জান কবজ করনেওয়ালা আজরাইল। ‘
হিমু একগাল হেসে উত্তর দিলো- কেমন আছো খালা (মাজেদা খালা), এই নাম্বার যোগাড় করলে কিভাবে?
-চুপ শয়তান , ফোন কিনেছিস আমাকে বলবিনা? তুই মনে করেছিস তোর নাম্বার আমি পাবোনা ? তুই যদি মহাপুরুষ হোস তাইলে আমি হলাম ‘মহানারী’ । তুই ভুমিকম্পের খবর একদিন আগে দিলে আমি তিন দিন আগে দিতে পারবো।
খালার মেজাজের সুচকের ক্রমশ ঊর্ধ্বগতি দেখে হিমু চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো ।
-বান্দর তিন মাস ধরে তোকে আমি খুজতেসি । ঠুস ঠাস করে মেস বদলে ফেলিস । কোথায় গিয়ে উঠিস, বলিস না। খুজতে খুজতে শেষে রুপা মেয়েটার পায়ে হাতে ধরে তোর খোঁজ পেলাম।
কিছুক্ষন নীরবতা দিয়ে খালা আবার বললেন ‘এখন কি করছিস ?’
হিমু মিথ্যা বলার প্র্যাকটিস হিসেবে বললো ‘ইডেন কলেজের সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাদাম খাচ্ছি আর মেয়েদের দেখে শিষ বাজাচ্ছি।
‘
-ফাইজলামি করবিনা, বাসায় ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে , তুই তাড়াতাড়ি ঘরে আয়। তুই আসলেই ইডেনের সামনে ?
হিমু আবারো বললো ‘হু, বিশ্বাস না হলে এসে দেখতে পারো’
- তুই ওখান থেকে এক পা নড়বি না । আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি ,চলে আয় ।
হিমু ‘অবশ্যই’ বলে ফোনের লাইন কেটে দিলো এবং আবশ্যকর্তব্য হিসেবে ফোনের সুইচ অফ করে দিলো । মনে মনে বললো ‘তুই এখন অফ থাক বিলাই’
২.
মাজেদা খালা হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো সাজগোজ করে বসে আছেন।
দামি চুমকিয়ালা শাড়ি, কানের দুল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আরো কত কি !! এই সাজে মাজেদা খালাকে অনেকটা নববধূর মতো দেখাচ্ছে।
মাজেদা খালা মুল ঘটনাটা বলার আগে অনেকক্ষন ধরে ভনিতা করলেন।
-‘সারা দেশ জানে আর তুই জানিস না ? এক মাস ধরে ঘটনা পত্রিকার প্রথম পাতায় আসছে, দেশজুড়ে তোলপার হয়ে গেলো আর তুই কিছুই বলতে পারিস না?’
হিমু হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বসে রইলো ।
-দুই দুইটা চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ছিলো। এখনো টিভি চ্যানেল গুলো বাসায় ভীড় জমায় ।
আর তুই... তুই এ দেশে বেচে থেকে কি করবি?’
হিমু এই মুহূর্তে বিষয়টা দারুন উপভোগ করছে । টিভি চ্যানেল গুলোর কথা বলার সময় খালার মুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠেছিল এবং একি সাথে খালার সাজগোজের বিষয়টা সম্পরকে কিছুটা ধারনা লাভ করা গেলো।
অবশেষে খালার নিকট থেকে পুরো ঘটনার বিবরন পাওয়া গেলো । একমাস ধরে বাদলের কোন কোন খোঁজ নেই । পুরা লাপাত্তা ।
খালুসাহেব দেশের ‘বিশিস্ট’ একজন ব্যবসায়ী (বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে সবসময় উঠাবসা) । তাই বিষয়টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনা শুনে হুংকার দিয়েছেন ‘অপরাধি কাউকেই ছাড় দেওয়া হবেনা, এদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। ‘
RAB-পুলিশ-গোয়েন্দা বাহিনীর বিশাল ব্যাটেলিয়ন বাদলের খোঁজে নেমেছে । তারা রহস্যের কোন কুল কিনারা করতে পারছেনা।
এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিন বাসায় এসে খালাকে জড়িয়ে ধরে কিচ্ছুক্ষন কেঁদে গিয়েছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের লোকজন ছিল।
হিমু বললো ‘ভাগ্য ভালো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন মহিলা ,তাই তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছেন । পুরুষ হলে তো সেটা সম্ভব ছিল না!’
মাজেদা খালা হতাশ হয়ে কিছুক্ষন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ছলছল চোখে বলে উঠলেন ‘আমি জানি , একমাত্র তুই পারবি আমার বাদলের খোঁজ এনে দিতে ।
যেভাবে পারিস আমার ছেলেকে এনে দে হিমু। ‘ বলতে বলতে খালার চোখে জল নেমে এলো। তবে সেই জল বেশী সময় স্থায়ী হতে পারলনা । একটা চ্যানেলে ক্রাইম বিষয়ক অনুষ্ঠানে তার ক্রন্দনরত সাক্ষাতকার রয়েছে , সেটা দেখতে হবে । অনুষ্ঠানের নাম ‘কে আমাদের বাঁচাবে ?’ অত্যান্ত সময় উপযোগী একটি নাম ‘কে আমাদের বাঁচাবে?’
উঠে যাওয়ার সময় খালা বললেন ‘সাবধানে থাকিস হিমু , তোর খালু মনে করছে বাদলের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তুই দায়ী ।
সে তোকে সহজে ছারবেনা ।
হিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ‘কে আমাদের বাঁচাবে ?’
৩.
এই মুহূর্তে হিমু বসে আছে মিসির আলী সাহেবের সামনে । মিসির আলীকে পুরো বিষয়টার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে । তিনি এখন সেই বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করছেন।
এর মাঝে হিমুর ফোনে ‘বিড়াল’ দুইবার ডেকে উঠেছে ।
দুইবারি হিমু ‘চুপ বিলাই’ বলে লাইন কেটে দিয়েছে । মাজেদা খালা ফোন দিতে দিতে বিড়ালের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন । একটু পর পর সে মেউ মেউ করে ডেকে ওঠে। এতো ডাকাডাকির পর ‘বিড়ালের’ গলা বসে যাওয়ার কথা !
এর মাঝে আবার শুরু হয়েছে এসএমএস যন্ত্রনা । একটু পরপর ম্যাসেজ আসছে ‘download ‘shila ki jawani’ only for 10 bdt’ ।
বিরক্ত হয়ে হিমু বলে উঠলো ‘ধুর শালা’ । মিসির আলী কিছুটা চমকে উঠলেন । মোবাইল অপারেটররা মহারপুরুশদের ধৈর্যেরও বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছে ।
কিছুক্ষন পর মিসির আলী বললেন ‘আমার মনে হচ্ছে এটা অপহরণ বা হত্যা টাইপের কিছু না। বাদল হয়ত নিজ থেকে কোথাও পালিয়েছে ।
তোমার খালু সাহেবের সাথে কথা বলতে পারলে আরো কিছু বিষয়ে ধারনা পাওয়া যেতো’
- ‘এখনি হয়ে যাবে‘ বলে হিমু খালু সাহেবকে ফোন দিল ।
খালু সাহেব ফোন ধরেই বলে উঠলেন ‘শোন হিমু, আমার ছেলেকে নিয়ে তুমি যে খেলাটা খেলছো সেটার ফল তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে, আমি তোমাকে সহজে ছাড়বোনা। ‘ একথা বলেই খালু সাহেব ফোনের লাইন কেটে দিলেন। হিমুও ফোন রেখে হাসি হাসি মুখে বললো ‘ফোনটা বোধয় ভুল করে বাংলা সিনেমার ভিলেন মিশা সওদাগরের কাছে চলে গিয়েছিলো, আরকেবার চেষ্টা করে দেখি। ‘
এ কথা বলার সাথে সাথেই সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসে হাজির হল ।
কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হিমু ও মিসির আলীকে গ্রেপ্তার করা হল ।
পুলিশের একজন শরীরে ধাক্কা দিতে দিতে বললো ‘শালা লিমনের গেছিলো এক খান পা, আর তোদের যাবে দুই খান পা , দুই খান হাত আর এক খান ‘বিশেষ’ জিনিষ । পুলিশ ভাইয়েরা আনন্দে হেসে উঠল । তাদের চোখে মুখে উল্লাস ।
৪.
হিমু আর মিসির আলীর সামনে এখন কয়েকশ সাংবাদিক ।
একটু পর পর ক্যামেরায় ছবি তোলার ‘ক্লিক’ ‘ক্লিক’ আওয়াজ আসছে । কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে ‘বাদল’ এখন কোথায় আছে ? হিমু এ প্লাস পাওয়া শিক্ষারথিদের মতো ভি চিহ্ন দেখিয়ে চলেছে। মিসির আলী সাহেব কিছুটা হতভম্ব । বিষয়টা এখনো তার মাথায় খেলছেনা । প্রথমবারের মতো লজিক ছাড়া ঘটনা তাকে নির্বাক করে দিয়েছে ।
গ্রেপ্তারের দিনই আদালত হিমু ও মিসির আলীর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে দিলো। এরি মধ্যে সবকয়টা চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলে এসেছে ‘বাদল অপহরনের সাথে জড়িত মুল দুই ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ’
এই সাফল্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । ‘ এই সরকার দেশের নাগরিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে‘ টাইপের উক্তি দিয়ে সরকারের সফলতা তুলে ধরা হচ্ছে। চ্যানেল গুলো খুব আগ্রহের সাথে হিমু ও মিসির আলীর কোমরে দড়িবাঁধা ছবি প্রকাশ করছে।
৫.
অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই রিমান্ড শুরু হবে , সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন । ভয়ংকর চেহারার একজন পুলিশ অফিসার আছেন রিমান্ডের দায়িত্বে। দেখতে অনেকটা আলিফ লায়লার ‘দৈত্যের’ মতো । মাথায় শুধু দুইটা শিং এর অভাব। এই অফিসারকে দেখা মাত্র অপরাধীর অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ার কথা ।
এমনকি যে কোন অপরাধ করেনি সেও অকপটে অপরাধ স্বীকার করে নেবে। আলাদা নির্যাতনের কোন প্রয়জন পরবেনা।
অফিসার হুংকার দিলেন ‘বল, শুওরের বাচ্চা , কোথায় রেখছিস বাদলকে? এক কথায় বলবি, নইলে ঘাড় থেকে মাথা আলগা করে দেবো’
হিমু বলে উঠলো ‘চুপ থাক বিলাই’
এমন উত্তরের জন্য অফিসার প্রস্তুত ছিলেন না, নিজেকে একটু সামলে মিয়ে দাঁতমুখ খিচিয়ে হামলে পড়ার প্রস্তুতি নিলেন, এমন সময় আরেক অফিসার এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন । তারপর কানে কানে কিছু একটা বললেন। অফিসার দাঁতমুখ খিচিয়ে হতাশার দৃষ্টিতে তাদের দুইজনের দিকে তাকালেন।
মিসির আলী ফিসফিস করে বললেন ‘হিমু, আমরা মুক্তি পেতে চলেছি’
হিমু অবাক হয়ে বললো ‘কিভাবে বুঝলেন স্যার ?’
‘অফিসারের চোখ দেখো, আমাদের পেটানোর যে খায়েশ তার ছিলো, সেটা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। হয়তো বাদল ফিরে এসেছে। ‘
মিসির আলী সাহেবের কথাই ঠিক হলো। টিভিতে হিমু ও মিসির আলীর গ্রেপ্তারের খবর দেখে বাদল ফিরে এসেছে । খালু সাহেবের বিশেষ অনুরোধে হিমু ও মিসির আলীকে মুক্তি দেওয়া হলো।
খালুসাহেব গাড়ি দিয়ে তাদেরকে নিতে এসেছেন । তার কথাবারতায় বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব অনুতপ্ত । তিনি হিমুকে বল্লনে ‘আমি না বুঝে তোমাকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিলাম হিমু , আমাকে প্লিজ মাফ করে দিও ...
হিমুর বিড়াল আবার ডাকাডাকি শুরু করেছে , হিমু বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে উঠলো ‘চুপ থাক বিলাই, চুপ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।