লেখার শুরুতে চিন্তাবিদ ও বরেণ্য কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদকে ১৬ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘তেঁতুল তত্ত্ব’ নামের সাহসী লেখাটির জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ, এর এক দিন আগে আমি অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত আমার কলামে তাঁর কিঞ্চিৎ সমালোচনা করেছিলাম। লিখেছিলাম, তাঁর এমন ধারণাটাও ভুল এবং বাংলাদেশ কখনো যদি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকার শীর্ষে ওঠে, তা হবে তেঁতুল হুজুরদের কারণে, পারলে তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরুন। তিনি আমার অনুরোধ রেখেছেন। তবে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার বড় হুজুর শাহ আহমদ শফী ওই বয়ানটি এই জুলাই মাসে নয়, বেশ আগে দিয়েছেন।
জুলাই মাসে কেউ একজন তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার করে দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। হুজুরের ভক্ত এখন দেশের পবিত্র সংসদেও ঢুকে পড়েছে। বিরোধীদলীয় একজন নারী সংসদ সদস্য হুজুরের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বক্তব্য রেখেছেন।
তেঁতুল তত্ত্বের রেশ না কাটতেই এসে গেল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যদিও এই তত্ত্বটি রাজনীতিতে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। আর দেশের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির পেছনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি লেগেই আছে।
বলা যেতে পারে, তার জন্মলগ্ন থেকেই এবং তা শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকেনি, কখনো কখনো তা বাস্তবেও পরিণত হয়েছে এবং এর ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভব একাত্তরের ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমের রায়কে কেন্দ্র করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শুনানি শেষ হয়েছে তিন মাস আগে। যখন রায় দিতে দেরি হচ্ছিল, তখন চারদিকে কানাঘুষা চলতে লাগল, নিশ্চয় মামলার রায় নিয়ে কোথাও একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরই মধ্যে গোলাম আযমের বিচার নিয়ে অযাচিতভাবে আপত্তি জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল।
অন্যদিকে, গোলাম আযমের পিতৃ সংগঠন তাঁকে বাঁচানোর জন্য বহির্বিশ্বে এবং দেশে যে কোটি কোটি টাকা ছড়িয়েছে, তা এখন একটি ওপেন সিক্রেট। এর মধ্যে আবার সৌদি আরব যখন সে দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত কয়েক লাখ বিদেশি শ্রমিকের কাগজপত্র বৈধ করার প্রক্রিয়া শুরু করল, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভাবকেরা এখানেও আবিষ্কার করলেন, এটা গোলাম আযমকে বাঁচানোর জন্য একটি সৌদি চাল।
সম্প্রতি আবার খবর এল, এই বছর থেকে সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শিশু, বৃদ্ধ ও যারা ক্যানসার বা এমন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, তাদের হজে যাওয়ার ভিসা দেবে না। এটি সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভাবকেরা জানান, গোলাম আযমকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর সৌদি সরকারের এটি একধরনের চাপ।
আগুনে ঘি ঢালার মতো আবার ঘটে গেল আরেকটি ঘটনা। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার বাড়িতে নাকি কদিন আগে এক নৈশভোজে মিলিত হয়েছিলেন গোলাম আযমের প্রধান কৌঁসুলি আর প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি পরামর্শদাতা। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে এই নৈশভোজ এক নতুন মাত্রা যোগ করল। তত্ত্ববিদেরা আবিষ্কার করলেন, গোলাম আযমের রায় কী হবে, তা এই নৈশভোজে নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। কাউকে বোঝানো সম্ভব হলো না, রায় দেবেন স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল বা আদালত, সরকার নয়।
দুটি পৃথক সত্তা। কে শোনে কার কথা। গত রোববার জানানো হলো, সোমবার গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদেরা বলাবলি শুরু করলেন, ষড়যন্ত্রের পর্যায় শেষ, এখন তা বাস্তবায়নের পালা। আর জামায়াত-শিবির সোমবার হরতাল ডেকে যে কাজে পারদর্শী, সেই নাশকতামূলক কাজ করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দিল সারা দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য।
সোমবার সেহিরর সময় হতে বিদেশ থেকে বন্ধুবান্ধবেরা ফোন করা শুরু করে গোলাম আযমের বিচারের রায় কেমন হবে, তা জানতে চেয়ে। এটি আদালতের এখতিয়ার। আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে তাঁর মৃত্যুদণ্ড না হলে আমি তো বটেই; সারা দেশের মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা ৪২ বছর এই ঘাতকের বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছেন, যাঁরা শহীদজননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে ঘাতকবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন এবং সর্বোপরি নতুন প্রজন্ম, যাঁরা একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হবে, এই আশায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ১৪-দলীয় জোটকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তাঁরা চরম হতাশ হবেন; যদি এই ঘাতক শিরোমণির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড না হয়। বাংলাদেশে তো বটেই, দেশের বাইরে সোমবার লাখ লাখ মানুষ টিভি পর্দার সামনে বসে অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন; গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কী রায় দেন, তা শোনার জন্য।
ট্রাইব্যুনাল যখন রায়ের সূচনা আর বিচার-বিশ্লেষণ পড়া শুরু করেন, তা টিভির সামনে বসা মানুষ স্ক্রলে দেখতে পাচ্ছিলেন। যখন বলা হলো, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সব অপরাধই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, তখন সবাই অনেকটা নিশ্চিত; এবার গোলাম আযম বুঝি ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে পারবেন না। মান্যবর বিচারপতি বলেন, তাঁর প্রতিটা অপরাধের সাজাই মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত, কিন্তু তাঁর বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা বিচার করে তাঁকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। আইনকানুনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো না বুঝলেও বুঝি, বাংলাদেশের কোনো আইনে বয়সের বা স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বিচারক মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য কোনো অভিযুক্তকে বিচার শেষে এই দীর্ঘমেয়াদি সাজা দেওয়ার নজির নেই।
বিশ্বের ৯১টি দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রেওয়াজ আছে আর এগুলোর মধ্যে ১০টি দেশে বয়সের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার আইন আছে, বাংলাদেশ এই ১০টি দেশের অন্তর্ভুক্ত নয়।
বাংলাদেশের আইনে এমন একজন আসামি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে এই সুযোগ পেতে পারেন অথবা রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সে কাজটি করতে পারেন অথবা আসামির দণ্ড সম্পূর্ণ মওকুফও করতে পারেন। বলা বাহুল্য, গোলাম আযমের রায় শুনে সারা দেশের মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং অনেকে বলেছে, এই রায় ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বুঝতে নারাজ, এমন একটি ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোনো অবস্থাতেই লাভবান হতে পারে না। বিএনপি তথা ১৮-দলীয় জোট আগের অন্যান্য রায়ের মতো এই রায় নিয়েও কোনো মন্তব্য করেনি। অনেকের ধারণা, তারা হয়তো পরিকল্পনা করছে; ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কীভাবে মুক্ত করা যায়।
এই ধারণা যে অমূলক, তা-ও কিন্তু নয়। কারণ, এই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই বিএনপির বদৌলতে এ দেশে পুনর্বাসিত হয়েছেন, গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন। এই ঘাতকেরা সদম্ভে বলেছেন, একাত্তরে আমরা কোনো ভুল করিনি।
দেশের কোটি কোটি মানুষের মতো আমিও এই রায়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ; কিন্তু এই সত্যটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি ক্ষমতায় না থাকত, তাহলে ৪১ বছর পর একাত্তরের ঘাতকদের বিচারকাজ অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এত দূর আসত না। ভবিষ্যতে যদি অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যে কারাগার থেকে সদম্ভে বের হয়ে আসবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তাঁরা যে বের হয়ে আসবেন, তা-ই নয়; আশঙ্কা আছে, যারা তাঁদের জেলে পাঠিয়েছে, তখন হয়তো তাদের বিচার শুরু হবে। এ থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় হচ্ছে সংবিধানের ৪৯তম ধারায় একটি উপধারা যোগ করা, যাতে রাষ্ট্রপতি যাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হবেন, তাঁদের দণ্ড যেন মওকুফ করতে না পারেন। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী সংসদে যেমনটা বলেছেন, এই সরকারের আমলেই দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দণ্ড কার্যকর হওয়া শুরু হবে, তা বাস্তবায়ন করা। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, জামায়াত ও শিবির (একাত্তরে ছাত্রসংঘ) ক্রিমিনাল সংগঠন। কোনো ক্রিমিনাল সংগঠন কোনো দেশে কর্মকাণ্ড চালাতে পারে না।
অতএব এই সংগঠন দুটিকে নিষিদ্ধ করার এটাই প্রকৃত সময়।
গতকাল বুধবার একাত্তরের আরেক ঘাতক আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অপরাধের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এতে দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। তবে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় হূদয়ে রক্তক্ষরণ হতেই থাকবে ঠিক, তার পরও এত বছর পরও যে এই ঘাতকদের বিচার হচ্ছে, এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওনা।
দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে, দ্রুততম সময়ে এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার উচ্চতর আদালতে আপিল করবে। সাঈদীর দণ্ডাদেশ দেওয়ার সময় মান্যবর বিচারক বলেছিলেন, ‘আমরা ২০১৩ সালের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার করছি না, একাত্তরের যৌবনকালের সাঈদীর বিচার করছি। ’ এখন হঠাৎ একাত্তরের গোলাম আযমের বিচার না করে ট্রাইব্যুনাল কেন ২০১৩ সালের ৯১ বছর বয়সী গোলাম আযমের বিচার করলেন, অনেকের মতো আমিও তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।