রানওয়ের মত লাম্বা ফ্লোর। ফ্লোরের দুপাশে সারি সারি বেড। বেডগুলোর বেহাল দশা। বেডে বালিশ আছে তো তোশক নেই, তোশক থাকলে চাদর নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার ফ্লোরে মাত্র একটা।
অথচ পুরো ফ্লোর রোগীতে টইটুম্বুর। গ্রুসো মার্ক্স একবার বলেছিলেন, হাসপাতালের বিছানা হচ্ছে ভাড়া করা ট্যাক্সির মতো, সব সময় মিটার ঘুরতে থাকে। এই হাসপাতালের ফ্লোরের ক্ষেত্রেও নাকি একথা প্রযোজ্য। বেডের প্রায় রোগীকেই স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। স্যালাইন স্ট্যান্ডে লাউয়ের মত স্যালাইনগুলো ঝুলছে।
সরকারি হাসপাতালে সর্বরোগের প্রথম ওষুধ এই স্যালাইন। পাশের বেডের রোগীর স্যালাইন দেওয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আগে অথচ স্যালাইন অর্ধেকও ফুরোয়নি। এ নিয়ে বেচারার অস্থিরতার শেষ নেই। কিছুক্ষণ পরপরই সে বলছে, ফিরোজের মাও, নার্স আফারে ডাইকা কও, ট্যাপের পানির মত ফোটা ফোটা স্যালাইন দিলে আমি তো বাচব না! আমারে তুমি এইখান থিকা নিয়া চলো। আমি মাদ্রাজ যাব।
ফিরোজের মা রোগীর পায়ের কাছে একই চাদরের নিচে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। একই বেডে দুইজন থাকায় কে রোগী প্রথম দর্শনে সেটা বোঝার উপায় নেই। রাত জাগা চেহারায় তার রাজ্যের ক্লান্তি। স্বামীর কথা সে শুনছে বলে মনে হলো না। ওদিকে ফিরোজের বাবার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে পরার উপক্রম।
: কী কইলাম, শুনো না?
এবার ফিরোজের মাকে চোখ কচলে উঠে বসতেই হলো। শরীরের মতো কণ্ঠেও তার স্পষ্ট দূর্বলতা। অসুস্থ স্বামীর চুলে চিরুনীর মত পাটকাঠি আঙ্গুল চালিয়ে দিতে দিতে সে বলল, অস্থির হইলা ক্যান? তোমার না অসুক! খিদা লাগছে? কী খাইবা?
: খাওনের খ্যাতা পুরি। তুমি নার্সরে ডাকো। আমি মাদ্রাজ যাব।
: আইচ্ছা, ভালো হইলে যাইও। এহন ঘুমাও।
: মাদ্রাজ কী আমি হাওয়া খাইতে যাব? তুমি নার্স আফারে তারাতারি ডাকো।
নার্সকে ডাকতে হলো না। রোগীর উচ্চকণ্ঠ শুনে পায়ে গটগট শব্দ তুলে নার্স নিজেই এলো।
তারপর রোগীর পেট টিপে, নাড়ী গুনে, জিভ দেখে, চোখে টর্চের আলো ফেলে মোলায়েম কণ্ঠে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো?
: কী হইছে সেইডা জানতেই তো এইখানে আসা। কিন্তু সে আশায় তো গুড়েবালি। এরচেয়ে আমারে ছাইরা দেন আমি যাই।
: কোথায় যাবেন?
: আজিমপুর যাওয়ার আগে একবার মাদ্রাজ যাইতে চাই।
: ঠিক আছে, যাবেন।
এখন সমস্যা কী হচ্ছে বলুন।
: প্যাট মোচড়ায়। প্যাটের ব্যথায় মাথায় যন্ত্রণা!
: আর?
: দম নিলে শিরায় শিরায় টান লাগে।
: আর?
: স্যালাইন শেষ হইব কখন? ধৈর্যে তো আর কুলায় না, প্রস্রাব ধরছে।
এতক্ষণে বেচারার অস্থির হওয়ার কারণ বোঝা গেল।
নার্সের অনুমতি নিয়ে স্ত্রীর কাধে ভর দিয়ে শিব ঠাকুরের ত্রিশূলের মত ডান হাতে স্যালাইন স্ট্যান্ড ধরে বেচারার টয়লেটে গমন চেয়ে দেখলাম। বাসে প্রত্যেক যাত্রী যেমন ভাই ভাই। হেল্পার, কন্ট্রাক্টরের বিপক্ষে একে অন্যের তরে। হাসপাতালে নার্স, ডাক্তারদের বিপক্ষে প্রত্যেক রোগীও তেমনি ভাই ভাই। উপযাজক হয়েই বেচারার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম।
: ভাই, কতদিন হলো আছেন?
: তিন দিন। অথচ এখন পর্যন্ত কী রোগ হইলো জানতে পারলাম না।
: বড় ডাক্তার দেখে নাই?
: দেখছে। কিন্তু বাবার দুধ খাওয়ার পর থাইকাই যে আমার সমস্যার শুরু এই কথা কিরা কাইটা বইলাও আমি তারে বিশ্বাস করাইতে পারি নাই।
: বাবার দুধ...?
: ক্যান, বিশ্বাস হয় না? দোকানে বাকিতে গুড়া দুধ কিনতে গেছিলাম।
দুধ নিয়া আসার সময় দোকানদার কইল, ‘বাপের দুধ’ পাইছ? বাকিতে মাল বেচি না।
শুইনা আমারও জিদ হইল। ফিরোজের মার কাছ থাইকা ট্যাকা নিয়া দুধ কিনা আনলাম। সেই দুধ খাওয়ার পর থাইকাই প্যাটের মধ্যে খালি মোচর দেয়। ভাই, এরা আমারে মাইরা ফালাইব।
মরার আগে কী রোগে মরলাম জানা হইল না। আজিমপুর যাওয়ার আগে আমি এ কারণেই একবার মাদ্রাজ যাইতে চাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।