পছন্দের বিষয় পড়া ও লেখা। তবে তা যেন মানবকল্যাণে হয়। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে। সত্যিকারের আনন্দ উপলব্ধি করা যায়।
বাবার লাশ
সমীর আহমেদ
তিনজন রাজাকারের রায় হয়েছে।
দুইজনের ফাঁসি। আর একজনের যাবজ্জীবন। রায় শুনে আজ আমার খুব ভাল লাগছে। আরো ভাল লাগতো যদি রাজাকার আব্দুল কাদের মিয়া এই বিচারে আটক হতো এবং তার রায় হতো কিংবা বিচারের কার্যক্রম চলতো। কিন্তু তিন বছর আগে সে মারা গেছে।
বেঁচে থাকলেও সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতো কিনা কে জানে! মহা ধুরন্দর আর ক্ষমতাবান ছিল সে। যেকদিন বেঁচে ছিল, কী দাপটেই না ছিল! রাতকে দিন, দিনকে রাত করতে পারতো। আমার সহ্য হতো না। তার নাম শুনলেই রাগে পিত্তি জ্বলে যেতো। কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না।
যদি এ কান ও কান হয়ে তার চামচাদের কানে কথাগুলো পৌছায়, তাহলে আর উপায় ছিল না। তার নির্দেশের আগেই চামচারা আমার একটা রফাদফা করে ফেলতো। পার্টির বেশ বড়সড় নেতা সে। আন্ডারগ্রাউন্ডে তার ম্যালা ক্যাডার। তার চোখের সামান্য একটা ইশারাতেই সমাজের অনেক রাঘব বোয়াল খুন হয়ে যেতো।
আমি কোন ছার! সামান্য একটা মাঝির ছেলে! পাঁচ ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া জানা। ট্রাক ড্রাইভার। বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দিনরাত ছোটাছুটি করি। আর আমার বাবা করিম মাঝির মর্মান্তিক স্মৃতি বুকের পাজরে ভাঁজ করে, নিরবে নিভৃতে গুমরে গুমরে মরি। কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই দিনটির কথা, যেদিন ওরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে।
সেদিন ছিল ঈদের দিন। আগের দিন সন্ধ্যায় বারবার মাইকে ঘোষণা হচ্ছিলো Ñ ভাই সব ভাই সব, আগামীকাল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। জাউলাপড়া মসজিদে সকাল নয়টায় ঈদের জামাত শুরু হবে। আপনারা সবাই নির্ভয়ে ঈদের জামায়াতে শরিক হবেন। ভাই সব ভাই সব...বাবার চোখমুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো।
মসজিদে যাবেন। জামাতে ঈদের নামাজ পড়বেন। সবার সাথে দেখা হবে। বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করবেন। এর মধ্যে কতো যে আনন্দ!
মা বললেন, এটা ওই কাদের শয়তানের চাল।
নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো শয়তানি আছে।
বাবা মা’র কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ধুর কী যে বলো তুমি! ওরাও তো মুসলমান। এই দিনটা তো ওদের কাছেও পবিত্র।
মা কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।
পরদিন ভোরে উঠে বাবা গোসল করলেন। গায়ে সাবান মেখে সাফসুতরো হলেন। আমাকে, আমার ছোটভাই আয়নাল আর ছোটবোন নূরজাহানকেও বাবা সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিলেন। তারপর নতুন পাজামা আর লুঙ্গি পরলেন। আমরাও খুব আনন্দের সাথে নতুন জামাকাপড় পরলাম।
এক শিশি আতর কিনে এনেছিলেন বাবা। তিনি আমাদের দুই ভাইয়ের ডানহাতের কব্জির ওপর একটু করে আতর লাগিয়ে দিলেন। তা দেখে নূরজাহানও বললো, বাবা, আমাকেও একটু দাও। বাবা হেসে বললেন, আয় পাগলি। তারপর নূরজাহানের হাতেও লাগিয়ে দিলেন আতর।
আহ কী সুঘ্রাণ। সেই আতরের ঘ্রাণের কথা আজও ভুলতে পারি না। যেন এখনো লাগে লেগে আছে।
নামাজের সময় ঘনিয়ে আসছে। বাবা মসজিদে যাবেন।
বাগড়া দিলেন মা Ñ তোমার আইজ মসজিদে যাওয়ার দরকার নাই। ঘরেই নামাজ পড়ো। ওদের মতিগতির কুনো বিশ্বাস নাই। নিশ্চয় ওরা কুনো গ-গোল করবে। এই কারণেই মাইকে বারবার যাওয়ার জন্য বলছে।
তুমি যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করো Ñ অনেকেই জানে। ওরা তোমাকে পেলে ছাড়বে না।
বাবা বললেন, কী যে কও! ওরা কি মুসলমান না! কতো মানুষ মসজিদে যাচ্ছে।
মা তাকিয়ে দেখলেন দলে দলে লোক মসজিদে যাচ্ছে।
বাবা রওয়ানা হবেন।
ছোট বোন নূরহাজান বললো, বাবা, মসজিদে যাইও না। মার কথা শোনো। আইজ ঘরেই নামাজ পড়ো। তুমি চলে যাচ্ছো। আমার ভালো লাগছে না।
বুকটা কেমন জানি করতাছে।
বাবা হাসি দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না মা। সবাই তো যাচ্ছে। নামাজ পড়েই আমি চলে আসবো।
নূরজাহান চুপ হয়ে গেল।
আমি বাবার সাথে মসজিদে যাবার জন্য গো ধরলাম। মা কিছুতেই যেতে দিবে না। বাবাও নিতে নারাজ। তবু জোর করে গেলাম।
দলে দলে লোক মসজিদে যাচ্ছে।
কেউ কেউ হাটুপানি ভেঙে ভেঙে। অনেকে নৌকা করে। আমরাও আমাদের নৌকাটি নিলাম। যারা পানি ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল, কাছেধারে যাকে পেলেন, বাবা তাদের নৌকায় তুলে নিলেন এই নৌকা দিয়ে বাবা সারাবছরই লোক পারাপার করে। এই আয় থেকেই আমাদের সংসার চলে।
২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাত্রির পর লোকজন ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে থাকে। তখন থেকে গরীব-দুঃখী, অসহায় কতো লোককে যে বাবা বিনা পয়সায় পার করে দিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নাই। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা তো আছেই। রাতের পর রাত তারা এ নৌকায় যাওয়া আসা করে। অনেকে আমাদের বাড়িতেও মাঝে মাঝে দু একদিনের জন্য আত্মগোপন করে।
আবার রাতের আঁধারে বাবা তাদের পৌছে দেন ঠিক জায়গায়।
বাবা লগি ঠেলছে। আমি বসে আছি নৌকার মাঝামাঝি। লোকজন নানা রঙের পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যাচ্ছে। মাথায় শাদা-কালো কতো রকমের টুপি।
অনেকে আমার মতো নতুন শার্ট-প্যান্টও পরেছে। আমাদের মতো আরো অনেকে নৌকা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গোড়ানের জাউলাপাাড়া মসজিদের দিকে। অনেকে পৌছে গেছে। আমরাও কিছুক্ষণ পর মসজিদের ঘাটায় নৌকা লাগালাম। মসজিদ ঘর আর উঠোনে অনেক লোকজন।
সবাই বেশ হাসি-খুশি। যুদ্ধের গুমোট ভাবটা আর নাই। তাই খুব ভালো লাগছে আমার। বাবারও।
নামাজে দাঁড়ানোর আয়োজন চলছে।
তার আগে ইমাম সাব বারবার নামাজের নিয়ত আরবী ও বাংলায় বলে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই নামাজের জন্য লাইনে দাঁড়াবে। শুরু হবে নামাজ। ঘরে জায়গা নাই। উঠোনে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন মুসল্লিরা।
আরো লোকজন আসছে। উঠোনেও লোকজন ধরবে কিনা কে জানে!
নামাজের জন্য কাতারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমার ডানপাশে বাবা। মনে মনে নিয়ত করছি আমরা। এমন সময়, হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ।
পেছন থেকে চিৎকার-শোরগোল শোনা গেল Ñ পাঞ্জাবি আইতেছে। পালাও সবাই, পালাও। লোকজন নামাজ ফেলে যে-যার মতো ন ছুটতে লাগলো। মসজিদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গুলি ছুঁড়ছে ওরা। মসজিদের ভেতর থেকে বাইরে আসার আগেই দেখলাম আট দশজন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে বারান্দায় কাতরাচ্ছে।
গুলি তখনো বন্ধ হয় নাই। চলছে। গুলি করতে করতে ওরা মসজিদের অনেক কাছে চলে এসেছে। আমার পাশেই একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। বাবা বললেন Ñ নূরু মাটিতে শুইয়া পড়।
মুহূর্তে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এলাম উঠোনে। কয়েকজন পাঞ্জাবি তখন ঢুকে পড়েছে উঠোনে। তাদের সাথে পাঁচ ছয়জন রাজাকার। প্রত্যেকের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা।
মসজিদের পেছনে যাচ্ছিলাম আমরা। কে একজন বললো Ñ ওই যে করিম মাঝি। শালা সাচ্চা মুক্তির আদমী। বাবা আরো জোরো দৌড় দিলেন। আর একটু এগোলেই খালপাড়।
অনেকেই খালের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে। আমরাও যাচ্ছি ওদিকে। কিন্তু বাবা পারলেন না। মুহূর্তে একটা গুলি বিদ্ধ করলো তাকে। মাটিতে পড়ে গেলেন বাবা।
কয়েকটা পোল্টানি খেয়ে এগিয়ে গেলেন খালপাড়ের কাছে। বেশ শক্তসামর্থ শরীর তার। খালের জল্যে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য আবারও উঠে দাঁড়ালেন। তখন আরেকটা গুলি তাকে বিদ্ধ করলো। তিনি খালের পানিতে পড়ে গেলেন।
অনেকের সাথে আমিও তখন খালের জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। অল্প স্বল্প সাঁতার শিখেছিলাম। কোনো মতে ভেসে থাকার চেষ্টা করছি। মরা ¯্রােতই আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মসজিদ থেকে দূরে। কিছুদূর যাওয়ার পরই হুঁশ ফিরে এলো Ñ বাবা কোথায়! আতিপাতি করে বাবাকে খুঁজছি।
পাচ্ছি না। নিরাপদ দূরত্বে যাবার পর যে-যার মতো জল থেকে উঠে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আমি আরো কিছুক্ষণ জলে ভেসে থেকে বাবাকে খোঁজলাম। না, বাবকে কোথাও দেখছি না। জল থেকে উঠে এলাম।
খালপাড় ধরে মসজিদের দিকে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বাবা। যদি সাঁতার কাটতে না-পারেন, আশপাশে কোথাও উঠে পড়ে থাকেন, তাহলে? তাই হাঁটছি। ভয়ে ভয়েই হাঁটছি। পাঞ্জাবিদের দেখার চেষ্টা করছি।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মসজিদের কাছে চলে এলাম। বাড়ি-ঘরের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে মসজিদ ঘরের দিকে তাকালাম। পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা চলে গেছে। কয়েকটি লাশ মসজিদের উঠোনে পড়ে আছে। দেখার কেউ নাই।
সেখান থেকে আমিও চোখ ফিরিয়ে আনলাম। খালের কিনারে, আশপাশে কতো তারে খোঁজলাম। কিন্তু কোথাও তাকে পড়ে থাকতে দেখলাম না। বুকটা হু হু করে উঠলো। তারপরও ভাবলাম, হয়তো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িতে চলে গেছেন বাবা।
কিংবা কেউ তাকে ধরেটরে বাড়িতে পেছেও দিতে পারে।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এলাম। আমাকে পেয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন মা। অনুচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে ফিসফিস করে বললেন Ñ তোর বাবা কোথায়? এবার আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। প্রায় উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলাম।
মা সাথে সাথে ডানহাতের তালু দিয়ে মুখটা চেপে ধরলো। যদি কেউ শুনে ফেলে আমার কান্না! নিশ্চয় আশপাশে কোথাও রাজাকাররা ওঁত পেতে আছে। আমিও কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে মাকে খুলে বললাম সব। তারপর আবার অনুচ্চস্বরে ডুকরে উঠলাম।
মা আমাদের তিন, ভাইবোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। আমাদের প্রতিবেশি জব্বার চাচা এলেন। জলিল চাচা এলেন। সবকিছু শুনে শুধু চোখের পানি ফেললেন।
মাকে বললেন Ñ ধৈর্য ধরেন ভাবি, আর আল্লাহ আল্লাহ করেন।
মা বললেন Ñ আমি জানি মানুষটা নাই। অহন শুধু তার লাশটা চাই।
জলিল চাচা বললেন Ñ অহন লাশ খোঁজার সময় না, ভাবি। চুপ করে ঘরে বইসা থাকেন।
একটু সময়সুযোগ বুঝে আমরাই খুঁজে দেখবো নে।
চলে গেলেন তারা।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। মাগরেবের নামাজ পড়ে মা বললেন Ñ তোরা তিন ভাইবোন দরোজা দিয়া ঘরে বইসা থাক চুপচাপ। আমি একটু দেইখা আসি।
চলে গেলেন মা।
আমরা বসে রইলাম চুপচাপ। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা। আন্ধার। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নাই।
এমনকী নিশাচর পাখপাখালিরও না। ভীষণ ভয় করছে আমাদের। চোকির ওপর আমরা তিন ভাইবোন জড়োসড়ো হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে Ñ মার দেখা নাই। নিষ্ঠুর সময় ভারি একখান পাথরের মতো আস্তে আস্তে কেবল গড়িয়ে যাচ্ছে।
আর আমাদের ভাবনা বাড়ছে Ñ মার কোনো বিপদ হয় নাই তো? শোকে না ভয়ে জানি না। মাঝে মাঝে আমরা নিঃশব্দে হু হু করে উঠি। আবার ভয়ে চুপসে চাই। যদি কোনো রাজাকার আমাদের কান্না শুনে ফেলে!
আরো ঘণ্টাখানেক পর মা ফিরে এলেন। তার চুল উস্কোখুস্কো।
চোখমুখ বিষণœ। লাল, ফোলা ফোলা। পা দুটো জলকাদায় মাখামাখি। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় প্রায় ভেজা। চোকিতে ধপ করে বসে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে ডুকরে উঠলেন।
অনেকক্ষণ পর বললেন Ñ বারবার আমি কইছিলাম, আইজ মসজিদে যাওয়ার দরকার নাই। তবু মানুষটা শুনলো না আমার কথা।
আবারো ডুকরে উঠলেন তিনি। আমরাও Ñ নীরবে, নিঃশব্দে। শোকে ঘুম-নির্ঘুমে অনাহারে রত্রিটা কেটে যেতে লাগলো।
সকালের ক্ষির, সেমাই, খিচুড়ি পড়ে আছে ডিশে। দেখেও খেতে ইচ্ছে করছে না কারো। রাত্রিটা পার হলো কোনোমতে। শোক আর ধকলে সকালের দিকে বোধহয় সবারই একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। উঠে দেখি বেলা মোটামুটি ওপরে উঠে গেছে।
কাউকে কিছু না বলে বাবার খোঁজে খালপাড়ের দিকেই যেতে চাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি জলিল চাচা। সাথে আমাদের এই আশপাশেরই আরো পাঁচ ছয়জন লোক। আমার বাবার লাশটা ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। মা কোথা থেকে কীভাবে দেখে ফেলেছিলেন কে জানে! তারা উঠোনে উঠে আসার আগেই সে ঘর থেকে একটা পাটি এনে বিছিয়ে দিলো।
তারা এসে বাবাকে শুয়ে দিলো পাটির ওপর। ফুলেফেপে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে বাবার শরীর। দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে। জলিল চাচা বললেন Ñ মাইলখানেকেরও বেশি দূরে খালের কিনারে ভাইসা ছিল। তাড়াতাড়ি নিয়া আইছি।
এই লাশ বেশিক্ষণ রাখা যাইবো না। কেউ দেইখা ফেলার আগেই দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কয়েকজন উঠোনের এককোণে কোদাল-শাবল চালিয়ে গোর খুঁড়তে লেগে গেল। কেউ কেউ বাবকে গোসল করানোর জন্য লেগে গেল। কাফন আনার জন্য একজনকে বাজারের দিকে পাঠালেন জব্বার চাচা।
আমরা চাপাস্বরে কাঁদতে লাগলাম। মা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুই বললেন না। একবার কাঁদলেনও না। লাশটা পাওয়া গেছে Ñ এই তার যা একটু শান্তনা।
আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে গোসল করাতে দেখলাম। তার গায়ে কাফন পরাতে দেখলাম। গোর খোঁদা শেষ হলো। তারপর সবার সাথে জানাজার নামাজে দাঁড়ালাম। ইমাম আমাদের মুনশি চাচা Ñ আবদুর রহমান।
সব মিলিয়ে পনের বিশজন লোক। নামাজের নিয়ত করে হাত বেঁধে ফেলেছি Ñ এমন সময় হম্বিতম্বি করে পাঁচজন লোক ছুটে এলো। তারা সবাই আমাদের পরিচিত। পাশের গ্রামেই বাড়ি। আবদুল কাদের, রুস্তম মৃধা, সোহাগ গাজী, ইদ্রিস মিয়া আর ময়নাল খালাসি।
আবদুল কাদের আর রুস্তম মৃধার কাধে রাইফেল। আর বাকি তিনজনের হাতে লাঠিশোঠা। একমাত্র আবদুল কাদের ছাড়া বাকি চারজন কবে কখন যে রাজাকারের দলে নাম লেখাইছে, তা আমরা জানতাম না। তাদের বেশভুষা আর চেহারাসুরত দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম। প্রত্যেকেই কেমন যেন পাল্টে গেছে।
আমাদের কাউকে তারা কোনোদিন দেখেছে কিংবা চিনেজানে বলে মনে হলো না। মুখে যা আসে তা-ই বলে সবাইকে গালিগালাজ পাড়তে লাগলো। তাতেও কেউ নামাজ বন্ধ করছিল না দেখে তারা আরো ক্ষেপে গেল। সবাইকে ঠেলে ধাক্কিয়ে নামাজ প- করে দিলো। তাদের দলনেতা আবদুল কাদের।
তার সাফ কথা Ñ করিম মাঝি মুক্তিযেদ্ধাদের দোসর। দেশদ্রোহী, কাফের। বেঈমান। পাকিস্তানের মাটিতে কোনো কাফরের দাফন হবে না।
বাবার লাশটা ওরা টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো খালপাড়ের দিকে।
কেউ তাদের বাধা দিতে সাহস পেল না। শুধু মুনশি চাচা বিড়বিড় করে উঠলো Ñ করিম মাঝি কাফের! তাহলে তোমরা কী? তোমরা যে মসজিদের মুসুল্লিদের গুলি করে মারছো। ঈদের নামাজটাও পড়তে দাও নাই।
ওরা তা শুনতে পেয়েছিল কিনা কে জানে? একজন রক্তচক্ষু তুলে আমাদের দিকে তাকালো। সবাই খুব নীরব হয়ে গেল।
ওরা আর কিছু বললো না। লাশটা টেনেহেচড়ে নিয়ে খালের জলে ঝপাত করে ফেলে দিলো। তারপর এসে শাঁসাতে লাগলো Ñ করিম মাঝির লাশ যদি কেউ দাফনের ব্যবস্থা করে, তাহলে তাকে আর আস্ত রাখবো না। পরিবারসহ খতম করে দিবো। যাও চলে যাও সবাই।
কেউ আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। ওরা দানবের মতো দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল। আর আমরা সবাই ঘরে গিয়ে পাথরের মতো বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই মসজিদের মাইকে ঘোষনা হলো। রাজাকার আবদুল কাদের কণ্ঠ Ñ করিম মাঝি, কাফের।
দেশের সাথে বেঈমানি করেছে। তার লাশ যারা দাফন করবে, তাদের প্রত্যেকের পরিণতি ওই করিম মাঝির মতোই হবে। তাদের পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হবে। তাই কেউ যেন ভুলেও করিম মাঝির লাশ দাফনকাফনের ব্যবস্থা না করে। তার লাশের কাছেধারেও যেন কেউ না যায়।
তারপরও পরাণ মানে না। কতোবার চুপি চুপি হেঁটে গেছি ওই দিকে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি Ñ আমার বাবার লাশ কাক-শকুনে ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে। শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করেছে। মাংস পচেগলে খালের জলে মিশেছে।
কিন্তু আমরা কেউ কিছুই করতে পারিনি। বারবার ডুকরে উঠেছি। নিরবে চোখের জল ফেলেছি। এ ছাড়া পাঠশালায় পড়া এই নূর মোহাম্মদের আর কী-ই করার ছিল সেদিন! আজ রায় শুনে চোখে পানি এসে গেছে। কবে কার্যকর হবে রায় জানি না।
তারপরও বুকটা একটু হালকাবোধ হচ্ছে। খুশি খুশি লাগছে খুব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।