পরিবর্তনে বিশ্বাস করি। প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
আলেন্দে সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্কঃ
চিলিতে ক্ষমতাশীল পপুলার ইউনিটি যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সকল দেশের সাথেই সু সম্পর্ক রাখতে উদ্যোমী ছিল। কিন্তু চিলি যখন দেশটিতে অবস্থানরত সকল বিদেশী শিল্পের জাতীয়করণ করে তখন যুক্তরাষ্ট্র সহ সকল পশ্চিমা দেশ গুলোর সাথে এর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ওয়াশিংটন সকল সম্পর্কের ছেদ ঘটানোর সাথে সাথে চিলির সকল প্রকার বৈদেশিক লোন ও সাহায্যের উৎস বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন চিলিতে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে নিশ্চয়তা প্রদান করে।
কিন্তু হাঙ্গেরী ও চেকস্লোভাকিয়াতে সোভিয়েত আগ্রাসনের নিন্দা করায় এবং চীনকে স্বীকৃতি দেয়াকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত সরকার চিলিকে দেয়া বিনিয়োগ নিশ্চতা অকার্যকর করে। তখন চীন ও পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলোর সাথে চিলির সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে এবং উক্ত দেশ সমূহ চিলির সংকট কালীন অবস্থায় সাহায্য প্রদান করে। এদিকে মার্কিন সরকার চিলির সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং আলেন্দের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সম্পর্কের কোন উন্নতি হয়নি।
আলেন্দের সরকারের সমালোচনা ও ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণঃ
১৯৭০ সালের সে&&প্টম্বরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনজন পদপ্রার্থীর মধ্যে সমাজতন্ত্রে সমর্থক আলেন্দে খুব অল্প পার্থক্যের মাধ্যমে জয়লাভ করেন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নির্বাচনে একজন মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্টের জয় প্রধানত চিলিকে বাম আদর্শের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
ঐ সময়ে চিলি লাতিন আমেরিকার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে উন্নত ছিল। সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান ছিল বহুবছর ধরে। দক্ষ স্বাধীন প্রশাসন ছিল, শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং শ্রমিক কর্মকান্ড বিদ্যমান ছিল। আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষিত শ্রেণীও সেখানে উপস্থিত ছিল। সেখানে ছিল প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা, ছিল কৃষিজ জমির আধিক্য যা প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল এবং ভালভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হলে তা থেকে উদ্বৃত্ত শস্য রপ্তানীকরাও সম্ভব ছিল।
চিলির জনগনের মাথাপিছু আয় লাতিন আমেরিকার মধ্যে তৃতীয় সর্ব বৃহৎ ছিল।
প্রথাগতভাবে দেশটির সেনাবাহিনী ছিল রাজনীতি বিমুখ এবং চিলিতে কোন রাজনৈতিক বন্দী ছিল না। কিন্তু এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকার পরও যে বিষয়সমূহ চিলিকে ভিন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে তা শুধু জনগনের মুক্তির স্পৃহা বা আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নয় বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক উপাদানের স্তর বিন্যাসের কারনে। নিন্মে গুরুত্বপূর্ন কারণ সমূহ বিশ্লেষণ করা হল-
পপুলার ইউনিটি জোটে ফাটলঃ
আলেন্দের নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বছরেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালেই তার দলের মধ্যে ফাটল ধরে। যেখানে সরাসরি স্বশস্ত্র বিপ্লবকে সমর্থ করত ২০%, অচিলিয় ১০-২০% সমর্থক বিভিন্ন প্রকার নিগ্রহের শিকার হয়, বাকী ৬০% আলেন্দের সরকারের কার্যক্রমের সফলতা নিয়ে ব্যাপক হতাশার মধ্যে ছিল।
জোটের সকল দলের উদ্দেশ্য যদিও ছিল চিলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, এর পথ কি হবে তা নিয়ে জোটের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান ছিল।
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর উদ্দেশ্যহীন জীবন-যাপনঃ
চিলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু হলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা “Fin de siècle” ধরনের জীবন-যাপন শুরু করে। তারা আলেন্দে সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিটি দিনকেই মনে করতো তাদের জীবনের শেষ দিন। তাই তারা কোন প্রকার সঞ্চয়ের পরিবর্তে যাচ্ছে-তাই খরচ করা শুরু করে। দেখা যায় নাগরিকরা শুধু শুধু বিলাসবহুল রেষ্টুরেন্টে দিন কাটাচ্ছে শুয়ে বসে।
ফলে দেশের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। এটি হয়েছিল সংস্কার প্রকল্পের আতংকে এবং যেহেতু চিলি সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। কারণ তারা ধরে নেয় রাশিয়াতে যেরূপ বিপ্লব হয়েছে এবং প্রলেতারিয়েত একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবে চিলিতেও প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। এর ফলে তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে তাই তারা তাদের মূলধন সরিয়ে অন্যান্য দেশে নিয়ে যায় এবং যাচ্ছে-তাই ভাবে ভোগবিলাস করতে থাকে। পরবর্তীতে জনগনের মধ্যকার এ আতঙ্ক ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং এরই মধ্যে আলেন্দের অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ত্রুটিঃ
আলেন্দে সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল দুই স্তর বিশিষ্ট। প্রথমটি ছিল স্বল্পকালীন যা কেইন্সীয় মতবাদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়টি ছিল দীর্ঘকালীন নীতি যেটি সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল যা অনেকটা মার্ক্সবাদের ন্যয়। স্বল্পকালীন পরিকল্পনার তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-
1. পূর্ণরূপে আয়ের পূর্ণবন্টন
2. সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান
3. পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা
১৯৬৯- ৭০ সালে চিলিতে মন্দা চলছিল বেকারত্বজনিত কারনে। সম্পদের সদ্ব্যবহারের অভাবে এ মন্দা আরো খারাপ অবস্থায় পৌঁছে।
আলেন্দের সরকার এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলার জন্য কেনসী্য় মডেলকে বেছে নিয়েছিল যেখানে শ্রমিকের মজুরী বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। যার ফলে জনগনের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে একইসাথে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। উদ্ভূত চাহিদার প্রেক্ষিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ মুনাফার আশায় উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। এর ফলে অর্থনীতি গতিশীল হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে একবছর পর দেখা যায় কেইনসীয় মডেল চিলির স্বল্পমেয়াদে যে রমরমা অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা দীর্ঘ মেয়াদে আরও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। এসময় বুর্জোয়াদের একমাত্র অবলম্বন অর্থ ঐ সময় মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে ১০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আলেন্দের সরকার তখন জনগনের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিয়ন্ত্রিত পণ্যমূল্য ব্যবস্থা চালু করে যা পণ্য স্বল্পতা ও মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে অকার্যকর রূপে প্রতীয়মান হয়। সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনন্সমূহ বাস্তবায়ন শুরু হলে এগুলো অব্যবস্থাপনা জনিত কারনে সফলকাম হয়নি।
চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতাঃ
উল্লেখযোগ্য পরিমান আয়ের পুর্ণবন্টনের ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে সেখানে উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধি পায়।
কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়, শিল্পক্ষেত্রে এ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমান ১২%। বেসরকারী বিনিয়োগ যদিও হ্রাস পেয়েছিল অর্থনৈতিক সচলতা তখন হ্রাস পায়নি বরং সুন্দরভাবেই চলছিল এবং সন্দেহাতীতভাবেই উন্নয়ন চলমান ছিল। যদি এটি ধরে রাখা সম্ভব হত তবে আলেন্দের প্রথম বছর হত একটি অর্থনৈতিক অনন্য বিজয়। কিন্তু উৎপাদনশীল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা যে পরিমান বৃদ্ধি পায় তা ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অক্ষম ছিল, পারলেও সমভাবে মেটাতে পারেনি।
কৃষিক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিঃ
কৃষিক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা ছিল শিক্ষামূলক।
চিলির কৃষিতে প্রথাগতভাবেই অসমতা বিদ্যমান ছিল। খুব কম সংখ্যক বড় বড় ইউনিট বেশিরভাগ কৃষিজ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করত। তবে এখানে দুই ধরনের ইউনিট ছিল একটিতে খুব ভালভাবে চাষাবাদ করে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হত। অন্যটিতে তা করা হত না। আলেন্দের সংস্কার প্রকল্পের ফলে প্রথমটিতে ভালো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারলেও দ্বিতীয়টির ফলে আলেন্দের সরকার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
আদুয়ার্দো ফ্রেই এর কৃষি পুর্ণগঠন প্রকল্প ছিল উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে যার ফলে উৎপাদন প্রভূত পরিমান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঢালাওভাবে সংস্কার কর্মসূচীর মাধ্যমে জমির পূর্নবন্টন করায় আলেন্দের সরকার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফ্রেই এর কৃষি পুর্ণগঠন প্রকল্প অনুসরন করলে হয়তো আলেন্দের কৃষিব্যবস্থা এতটা নাজুক হত না। আলেন্দের প্রকল্পের নীতি অনুযায়ী ২৫০ একরের অধিক জমি কোন ভূমি মালিকের অধীনে থাকতে পারত না ফলে অনেক ভালো জমি যেগুলোর সদ্বব্যবহার করা হচ্ছিল সেগুলোকে কেড়ে নিয়ে অন্যদের দিয়ে দেয়া হয় যারা হয়ত কৃষিকাজে ততটা দক্ষ ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এ ধরনের প্রান্তিক চাষীদের হাতে দুই তৃতীয়াংশ জমি চলে যায়, যার কখনই সদব্যবহার করা হয় না।
ফলশ্রুতিতে উৎপাদন কমে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল ঠিকই। যার জন্য সরকার শুধু ক্ষতির ভাগীদারই হয়।
এদিকে কৃষিক্ষেত্রে অর্থাৎ কৃষিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ ধরনের অতিরিক্ত উৎপাদন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অধিকন্তু কৃষিক্ষেত্রে যে সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে তা কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে উৎপাদন হ্রাস করেছিল।
ফলে খাদ্য আমদানি দ্বিগুনের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। অনুরূপভাবে আরও অনেক দ্রব্যের জন্য সরকার আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পুরোটাই খরচ করতে হয়। ১৯৬৯- ৭০ সালের মন্দার সময় সরকার যেসকল সাহায্য পেয়েছিল তাও খরচ হয়ে যায় এই সময়ে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার খুব কমমূল্যে স্থির করে দেয়া হয়।
ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসতে পারে এসকল সম্পদের পরিমান অতি দ্রুত হ্রাস পায়।
বেসরকারী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করনঃ
সহজ গাণিতিক হিসেবে দেখা যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং অর্জনকারী পণ্য অতি দ্রুত (আনুমানিক এক বছরের মধ্যে) শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় যে জিনিসটি অতীব প্রয়োজন ছিল সেটি হচ্ছে যেকোন মূল্যে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা । প্রাথমিক ভাবে যখন অতিরিক্ত উৎপাদন বর্ধিত চাহিদার দ্বারা শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য একমাত্র পথ ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মুনাফা হ্রাস এবং ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখার ফলে প্রাইভেট সেক্টর থেকে পুঁজি প্রত্যাহার শুরু হয় এবং অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে।
ভোগবাদী সংস্কৃতি ও সঞ্চয়হীনতাঃ
আয়ের পুর্নবন্টনের যে পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে রূপায়ন করা হয় তাতে নিম্নআয়ের মানুষের সঞ্চয়ের কোন পরিকল্পনা ও প্রবণতা জনগন বা সরকার কারোরই ছিল না, যা পরবর্তীতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত। এ ব্যাপারে সর্বশেষ কথা হল সায়ত্ত্ব শাসিত ও জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের পণ্যমূল্য এত কমিয়ে আনা হয়েছিল যা বিনিয়োগ তহবিলের ঘাটতির কারণ হয়েছিল। বিনিয়োগ প্রায় ২০% কমে গিয়েছিল। আয়ের পুর্নবন্টন একবার করে সার্বিকভাবে দেশের অবস্থা যা হয়েছিল তাতে পুনরায় একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। বলা হয়ে থাকে যে পুনরায় আয়ের পুর্নবন্টন করা হলে আয়ের চেয়ে বেশি খরচ হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হত।
চিলিতে তখন যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল লাতিন আমেরিকার বাম আন্দোলনের অন্যতম সম্মোহনী নেতৃত্ব ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, “Marxism is a revolution of production; Allende’s was a revolution of consumption”.
অনেকে হাস্যরসাত্মক ভাষায় বলেন, আলেন্দে ক্ষমতার প্রথম বছরে উৎপাদনের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করলেও ভোগের যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন।
আলেন্দের আয়ের পুর্নবন্টন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু তা করা উচিত ছিল ধীরে ধীরে এবং অবশ্যই এ প্রকল্পে সঞ্চয়ের ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। তাহলে হয়ত নাটকীয়ভাবে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াত।
জাতীয়করণ ও দখলচ্যুতকরণঃ
দেশের উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণ ছিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ এবং এর মালিককে দখলচ্যুত করা।
আলেন্দের সময়ে এ জাতীয়করণ কর্মসূচী চলতে থাকে ব্যাপকহারে। ব্যাংক গুলোকে নতুন ইস্যুকৃত মুদ্রার মাধ্যমে কিনে নেয়া হয়, প্রায় সকল ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ করা হয়। এ ধরনের কার্যক্রম অবশ্য চিলির ১৯৩২ সালে কৃত আইন দ্বারা বৈধ যেখানে বলা হয়েছে- ‘‘জাতীয় স্বার্থে বা দেশের জনগনের স্বার্থে যেকোন সময়ের সরকার তার দেশের যেকোন পরিমান প্রতিষ্ঠান বা সম্পত্তির জাতীয়করণ করতে পারে। ’’ এদিক থেকে চিন্তা করলে আলেন্দের কার্যক্রম অবশ্যই অবৈধ ছিল না। তবে তাতে দূরদর্শীতার যথেষ্ট পরিমান অভাব ছিল যা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় পরবর্তী সময়ের অপ্রতিরোধ্য সংকটগুলোর মাধ্যমে।
আলেন্দের সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত জটিল। উদাহরণসরূপ- চিলির প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দ্রব্য কপারের কথাই ধরা যাক। আলেন্দের সরকার খনিগুলোর জাতীয়করণ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা স্বীকার করে। তখন চিলিতে কপার উৎপাদন ভালভাবেই চলছিল কিন্তু জাতীয়করণ করার পর থেকে অব্যবস্থাপনা জনিত কারণে উৎপাদন কমে যেতে থাকে। সে যাই হোক চিলি এখানে যৌথভাবে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করতে পারত।
তাদের পুরোপুরি ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে উৎখাতের বদলে, যেমনটি চলছিল তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অটোমোবাইল শিল্পে ও যুগোশ্লাভিয়ার বিভিন্ন উৎপাদনমূখী শিল্পে।
জাতীয়করণ প্রসূত ত্রাসের রাজত্বঃ
শিল্পক্ষেত্রে জাতীয়করণ ও ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে উৎপাদন কমে গিয়েছিল এবং দাম বেধে দেওয়া সত্ত্বেও তা বেশি দামে বিক্রয় হচ্ছিল। এদিকে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপে নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। সরকার একসময় কৃষিপণ্যের দামও স্থির করে দেয় যাতে করে পণ্য সবসময় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে।
মাইনিং সেক্টরের জাতীয়করণ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং অনেক গুরুত্বপূর্ন ইস্যু ছিল চিলির ক্ষেত্রে।
বাস্তবে আলেন্দের প্রকল্প এতে ব্যর্থ হয়। শ্রমিকদের নিয়ম শৃঙ্খলায় আনতে পারেনি আলেন্দের ব্যবস্থা। শ্রমিকরা অনুগতভাবেই মিছিল করত এবং শ্লোগান দিত “Ei gobiernoes la mierda, pero es el nuestro” অর্থাৎ বর্তমান সরকার ভীতিকর কিন্তু এটি আমাদের নিজস্ব সরকার সুতরাং আনন্দ কর। এসব কার্যক্রমের ফলে জাতীয়করণ প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। শ্রমিক সংঘসমূহের উপর্যুপুরি অন্যায্য দাবী সরকারের অবস্থাকে আরও নাজুক করে দিয়েছিল।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, কপার খনির শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলন। কাজে ঝুঁকি থাকার ফলে তারা সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে কয়েকগুন বেশি মজুরী পেত কিন্তু তার পরও তারাই প্রথম মজুরী বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে আলেন্দের সরকার বাধ্য হয়ে তখন মজুরী বৃদ্ধি করে যা দেশের মধ্যে শ্রম বৈষম্যের সৃষ্টি করে এবং শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। আলেন্দে সরকার বিরোধীরা এ অন্দোলনকে মদদ দেয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য।
উপক্রমনিকাঃ
আলেন্দে সালভেদরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিলির সমাজতান্ত্রি আন্দোলন বলতে গেলে স্থদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
১৭৭৩ সালে পিনচেটের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত চিলিতে বাম আন্দোলন শক্ত কোন ভীত তৈরী করতে পারেনি। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আলেন্দে সালভেদরের মৃত্যু কে তিন প্রকার ট্র্যাজেডি বলা চলে-
প্রথমত, এটি একটি ট্র্যাজেডি কারণ তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে চিলিতে সমাজতন্ত্রের পতন হয়। যেটি বিংশ শতাব্দীর একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ।
দ্বিতীয়ত, এটি একটি ট্র্যাজেডি কারন চিলিতে সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে ধরে নেয়া হয়েছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসাথে চলতে পারে না এবং এটিকে ধ্রুব সত্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে শুধু স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব।
কিন্তু আলেন্দে যে শাসন চালিয়ে ছিলেন তাকে কিছু মতাদর্শিক অন্ধ ছাড়া কেউ স্বৈরতন্ত্র বলতে পারবে না।
তৃতীয়ত, এটি একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি যেখানে আলেন্দের মত একজন মহান সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান নেতার আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্ন তার আত্মহত্যা বা হত্যার মধ্য দিয়ে ধূলিস্মাৎ হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে আলেন্দের মৃত্যুর কারণ তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তা নয় বরং তিনি অদক্ষ ও অযোগ্য ছিলেন যে উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি বা পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আরোহনের পর সম্পদ ও আয়ের পূর্ণবন্টন করতে সমর্থ হলেও এর ফলে সৃষ্ট মানুষের চাহিদাকে তিনি পূরণ করতে পারেন নি যথাযথ উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে। তিনি শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি করলেও তাদের প্রকৃত মজুরী কমে গিয়েছিল পণ্য সংকটের ফলে।
সমাজতন্ত্রে এধরনের অদক্ষতা থাকবেই এধরনের ধারনা সম্পূর্ণরূপ ভূল। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, সেখানে এরূপ বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয় নি।
আলেন্দে সালভেদর তার স্বপ্নের শাসন ব্যবস্থা রূপায়নের জন্য চেষ্টা করেছিলেন মনে প্রাণে। চিলিতে তিনি বিভিন্ন সমস্যার আবর্তে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তাকে হয়তো অনেকে ইউটোপিয়ান বা কল্পনাবাদী বলে অভিহিত করে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে অভিনব পন্থা বিশ্ববাসীকে প্রদর্শন করেছেন তা অমর হয়ে থাকবে।
যুগে যুগে অনেক মার্কস্বাদী রাষ্ট্রনায়ককে সহিংস পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার অনুপ্রেরণা যোগাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।