আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষের হৃদয় আজ পিরানহা মাছ

এক. বাজারে পিরানহা মাছ উঠলেই আমি ভয়ে আঁতকে যাই। মাছওয়ালাকে বলি, এই মাছ কোথায় পেয়েছেন, এটাতো রাুসে মাছ। মাছওয়ালা অবশ্য এটাকে রূপচাঁদা বলে চালিয়ে দিতে চায়। আমার কথা শুনে মানুষজন ভিড় করে। আমি মাছওয়ালাকে মাছের মুখ হা করে দেখাতে বলি।

মাছওয়ালা বিব্রত হলেও সকলের চাপে মাছের মুখ হা করে দেখাতে বাধ্য হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ে এই রাস মাছের চিকন ধারালো ভয়াল- সাদা সমান দুপাটি দাঁত। দাঁত নয় এ যেন সুনিপুন ভাবে গড়া উন্নত ধারালো যন্ত্র। দাঁত দেখে মানুষের তখন ভীত বিহবল অবস্থা। আমি তাদের কাছে এই মাছের ঘটনা বৃত্তান্ত করি- কিভাবে এ মাছের দল ঝাঁক বেঁধে একটা জীবন্ত মানুষকে আক্রমন করে নিমিষেই সাবাড় করে দেয়।

এবং এও বলি যে, এ মাছ পুকুরে দীঘিতে কিংবা নালায় থাকলে অন্য সব মাছ খেয়ে সাবাড় করে দেবে। পিরানহা মাছ চাষ করা ও বিক্রি করা এই জন্যই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পিরানহা মাছের স্বভাব এখন আমাদের সমগ্র সমাজে পেয়ে বসেছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে কিশোর শামসুদ্দিন মিলনকে একদল মানুষ মুহুর্তের মধ্যে যেভাবে পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেতলিয়ে মেরেছে তাতে পিরানহা মাছের স্বভাবের সঙ্গে এই ঘটনার মিল খুঁজে পাই। মানুষের এই আনন্দ-হত্যাযজ্ঞে, নৃশংস আচরণের হাত থেকে নির্দোষ মিলনকে বাঁচাবার জন্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।

যারা মেরেছে তারাতো আনন্দ উপভোগ করেছেই, যারা তামাশা দেখেছে তারাও বোধ হয় বেশ মজা পেয়েছে। পুলিশের কাছে যেখানে মানুষের নিরাপত্তা পাওয়ার কথা, সেই পুলিশ বাহিনীর কুপথে যাওয়া কতক সদস্য একটা কিশোরকে জনতার কাছে সঁপে দেয়। জনতা হাতে হাত লাগিয়ে মাভৈ মাভৈ বলে কৃচ্ছতা সাধনের মাস, শিা গ্রহণের মাস, এই রোজ-রমজানের দিনে নিজেদের মনের খায়েস মিটিয়ে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে নিরস্ত্র কিশোরটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য টেলিভিশনে সবাই দেখেছে। পক্রিকার পাতায় ছবি সহ প্রকাশিত সংবাদ সবাই পাঠ করেছে।

এতে মানুষের মনে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে জানি না। আশা করা যায় নিশ্চয় মানুষ গভীর দুখের ভার সইছে। আবার আশঙ্কা হচ্ছে, মানুষের মনে না জানি এই সব ঘটনাগুলো সংক্রামিত হয়ে তাদেরকে ক্রুর করে তুলছে। সামপ্রতিক কালে জনতা কর্তৃক পিটিয়ে মেরে ফেলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। এই মিলনের সঙ্গেও একই দিনে ঐ এলাকায় ছয় জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।

এর আগে শবেবরাতের রাতে ছয় জন ছাত্রকে এলাকার লোকেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এমনি পিটিয়ে মারার সংস্কৃতি এ দেশে বেশ কিছুদিন ধরে চালু হয়েছে। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য রাস্তায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারার দৃশ্য কিছুদিন আগে আমরা অবলোকন করেছি। মরার আগে ঔ ব্যাক্তির করুন চাহুনি এখনও স্মৃতিতে জীবন্ত। এই সব ঘটনা নিন্দার পরিবর্তে রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে।

পরপর এভাবে ঘটতে থাকা ঘটনায় মানুষ মনস্তাত্তিক ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। মানুষের ভেতরে যে কঠিন স্বভাব (সেডিজম) থাকে তা বেড়িয়ে আসছে। মনোবিজ্ঞানের সূত্র মতে এটাই এসব ঘটনার ধারাবাহিক পরিণতি। মানুষ কতটুকু এবং কত দ্রুত ক্রদ্ধতাকে আনন্দের খোরাক হিসাবে ব্যবহার করছে তা সরাসরি না বুঝা গেলেও পুরো সমাজ যে নির্বিকার হয়ে পড়েছে, আফিম ধরার মত বুঁদ হয়ে রয়েছে, তা হলফ করেই বলা যায়। কেননা এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেেিত কিছু কলম ধরা ছাড়া আর কোন উত্তেজনা ধরা পড়ছে না।

না সরকার, না বিরোধী দল, না সমাজ সচেতন কোন নাগরিক সমাজ, কারো প থেকে জনগণকে সান্তনা দেবার, ত সারানোর কোন পদপে নেই। এখন পর্যন্ত পথ সভা কিংবা মানববন্ধন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এমন ঘটনার পরিণতিতে পুরো সমাজের লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। আমাদের প্রিয় নবী (সঃ) বলেছেন “বিনা দোষে যে একটি লোককে হত্যা করে সে যেন পুরো সমাজকে হত্যা করে। ” আসলেই পুরো সমাজই আজ যেন মৃত।

প্রতিবাদহীন এই অবস্থাই আরো খারাপ পরিণতি এনে দেবে। মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত না হতে পারলে তা ভেতরে ভেতরে জমা হয়ে স্ফুলিঙ্গের আকার ধারন করবে। শামসুদ্দিন মিলন একজন সাধারণ কিশোর, বিদেশে কর্ম করে যার পিতা জমি রেজিষ্ট্রারের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছিল। যে যুবক অভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি বলে চট্টগ্রামে লেদ মেশিনে কাজ শিখে পরিবারের বোঝা বহনের জন্য নিজেকে সম করে তুলেছিল। জমি রেজিষ্ট্রীর চৌদ্দ হাজার টাকা নিয়ে সে যাচ্ছিল শহরে।

পথে খালত বোনের সাথে দেখা করতে তার স্কুলের পাশে একটি দীঘির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাকাত সন্দেহ করে তাকে সেখানে এলাকার ইউপি সদস্য ও অন্য আরেক জন পুলিশের হাতে তুলে দেয়, এর আগে তার সঙ্গে অমানুষিক আচরন করা হয়। পুলিশ ছেলেটিকে নিরাপত্তা দেবার বদলে জনতার হাতে তুলে দেয়। এবং জনতা মেরে ফেলার কাজটি করে। জনতা ছেলেটিকে মারছিল আর বলছিল “মারিয়া লা, পুলিশ ইডারে মারি ফেলতে কইছে”।

মিলনের কোন দোষ ছিলনা। কেবল একটিই দোষ, সে জন্মে ছিল এই হতভাগা দেশে। মিলনের খালত বোন পুকুর ঘাটে এসে স্বাক্ষী দেয় যে এটা তার ভাই, সে কোন ডাকাত কিংবা চোর-ছেঁচর নয়, তারপরও এলাকার গণ্যমান্যরা তাকে ডাকাত সন্দেহে পুলিশের কাছে দেয়। এই ঘটনা ঘটেছে ২৭ জুলাই ২০১১ইং তারিখ। আমরা জানতে পারি আরো পরে।

এই দুর্দিনে তাও কিছুটা সান্তনা যে আমাদের মিডিয়া দায়িত্ব পালন করেছিল বলেই দেরিতে হলেও সরকারি যন্ত্র কিছুটা নড়েচড়ে উঠেছে। তবে ঘটনা ধামা চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টাও বহাল রয়েছে। যেমন করে ইতিপূর্বে লিমনকে এবং কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে সন্ত্রাসী বানাবার চেষ্টা চলেছে। মিলনের খালাত বোন এখন আর স্কুলে যায় না। বাড়ীতে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে সাংবাদিকদের কাছে কথা বলতে চায় না।

মিলন তাদের আত্মীয় কিনা একথা জিজ্ঞাসা করলে স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনটাই করেনা এ পরিবারটি। পত্রিকার সূত্রে জানা যায় পরিবারটিকে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে বিশেষ প থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে। যেখানে পুরো সমাজ লজ্জিত হয়ে মিলনের পরিবারের কাছে মা চাওয়ার কথা, সান্তনা ও তিপূরণ দেওয়ার কথা (যদিও এ ঘটনার কোন তিপূরণ হয় না) সেখানে সমাজের এ আচরণ আগামী দিনের জন্যে এক বিপদ সংকেত। তাহলে কি ক্রমে ক্রমে আমরা নরকের দিকে এগিয়ে চলছি। আমাদের কি আর কোন উত্তরণ নেই।

ঘনিয়ে আসা এ ঘোর অন্ধকার কি এ কথাই বলে না যে পুরো সমাজের হৃদয় ধীরে ধীরে আজ পিরানহা মাছের মত দাঁতাল হয়ে উঠছে। দুই. অতি সম্প্রতি ইংলেন্ডে সংঘঠিত দাঙ্গা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট, যার উৎপত্তি একটি মাত্র ভুল থেকে সংশ্লিষ্ট হয়েছে, ভুলটি হল এই যে, পুলিশ বন্দুকধারী ভেবে একটি যুবককে দূর থেকে গুলি করে হত্যা করে, পরে দেখা যায় যে, যুবকটি নিরস্ত্র ছিল। এই ঘটনা যে ভুল বশত হয়েছে তা প্রমাণের অপো রাখে না। তারপরও অসহিষ্ণু যুবকরা খোদ বৃটেনের মত একটি সমাজে, যাদেরকে আমরা ভদ্রতা ও সহনশীলতার জন্যে উপমা হিসেবে দেখাই, যে পুলিশ বাহিনীকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবদরদী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সে দেশের যুব সমাজের এমন আচরণ করার পেছনে কারণ হিসেবে মনস্তাত্বিকরা বলছেন যে সাম্প্রতিক কালের বেকারত্ব ও বৈষম্য এবং আশালীন সমাজ ব্যবস্থাই এর জন্য দায়ী। আমাদের দেশে সংঘটিত ঘটনাগুলিরও মূল্যায়ন প্রয়োজন।

বর্তমান ঘটনা পূর্ব ঘটনার জের। আইনের প্রতি আস্থাহীনতা, বিদ্রুপাত্মক সমাজ ব্যবস্থা, বেকারত্ব, হতাশা, অপসংস্কৃতি, হীরোইজম ও দেখে দেখে পুনরাবৃত্তি করা (রিপিটিজম), এসব নানা কারনে আজ আমাদের সমাজে বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে মানবিক ধ্বস নেমে এসেছে। ফলে মানুষ হিংসুক, বেপরোয়া ও হিতবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠছে। যার ফলশ্র“তিতে তাদের আচরণ হয়ে উঠেছে পিরানহা মাছের মত। এসব অবস্থার উত্তরণে সমাজ হিতৈষী, সুশীল বলে আায়িত সমাজপতি ও বিশেষত রাজনীতিবিদদের এখনই সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে সজাগ হতে হবে, সর্বাগে তাদের আচরন শুধরে নিতে হবে।

এগুলি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চিকিৎসকদের মতে রোগ যখন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে (সেপটিসেমিয়া) তখন দেহের নানান অংশে ফোঁড়া দেখা দেয়। এই ঘটনাগুলি ফোঁড়ার মত। আমাদের বিচারালয়, শিা প্রতিষ্ঠান, মানবিক মূল্যবোধের প্রচার করে এমন সমাজ সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহ, মানুষের কল্যানার্থে সরাসরি সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও পেশাসমূহের উপরে মানুষের বিতৃষ্ণা এই অসুস্থতার জন্য দায়ী। লেখার তারিখ:১৩.০৮.১১ দ্রষ্টব্য;পিরানহা মাছের সংগে কতক মানুষের আচরনের তুলনা করে অলক্ষে আমি মাছটাকে অপমান করে ফেললাম বলে দুক্ষিত।

কেননা পিরানহা আর যা ই হোক নিজেরা নিজেদেরকে আক্রমন করে মেরে খায় না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.