আমরা কতোগুলি নীতিকথাকে স্বয়ংসিদ্ধ বলে জ্ঞান করে থাকি। সকল মানুষই সমান। সকলকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন আমাদের সর্বময় সৃষ্টিকর্তা। তার আছে কতোগুলি অসামান্য অধিকার- এর মধ্যে তার জীবনটাই প্রধান। তারপর স্বাধীনতা।
শান্তি ও সুখের সন্ধান। এই সব অধিকার অস্বীকার করার মতো নয়। তবু সব সমাজেই, এর ব্যত্যয়ও ঘটে থাকে, প্রায়শই। সব মানুষের অর্থাৎ সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্যেই তো মানুষের প্রশাসন ব্যবস্থার সৃষ্টি।
William Blake তাঁর 'The Divine Image'-- কবিতায় লিখেছেন:
"For all must love the human form,/ In Heathen, Turk or jew;/ Where mercy, peace and pity dwell, There God is dwelling too."
অর্থাৎ (মানুষের রূপকে সকলেরই ভালোবাসা উচিত, সে পৌত্তলিকই হোক, তুর্কীই হোক বা ইহুদীই হোক; যেখানে করুণা ও অনুকম্পা আছে সেখানে সৃষ্টিকর্তাও আছেন।
)
মানুষের দুটি বিষয়ে বিশেষ মোহ বা আকর্ষণ আছে। এক. আপন মুক্তি। দুই. স্বাধীনতা। সে মুক্তি কিসের? আর স্বাধীনতা-ই কি? সর্বপল্লী ড. রাধাকৃষ্ণন মনে করেন, "মানুষের আসল উদ্দেশ্য হলো দায়িত্বযুক্ত স্বাধীনতা লাভ। " মানবজীবন পরিসর যেমন সংক্ষিপ্ত আবার বিশাল ও ব্যাপ্ত।
জীবনের সীমানা ছাড়া আর কোনো সীমানা তো নেই। সেই সীমাটা অবলোকন করতে হয় সম্যক দৃষ্টিতে। আপন সীমার একটা ছক কেটে নিতে হয় জীবনের সূচনা মুহূর্ত থেকে। প্রথমে নিজের মধ্যে, পরে অন্যের মধ্যে পৌঁছে যেতে হয়- মনুষ্যত্বের সিঁড়ি ধরে ধরে। এই ধাপগুলো পেরোনোর মধ্যে জীবনের সীমা অতিক্রম করে যেতে হয়।
ব্যক্তি কেবল নিজের সীমা বা গন্ডির ভেতর অবস্থান করতে পারে না। তাকে তার সীমা পার হয়েই যেতে হয়। সীমানা লংঘন করে নয়- সীমানা যথাযথ অতিক্রম করে। মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য তো সমাজের ভেতরে প্রবেশ করা। সমাজের সকলের স্বার্থ ও কল্যাণকে- নিজ স্বার্থ, নিজকল্যাণ হেতু জ্ঞান করা।
মানুষকে বড়ো করে দেখা মনুষ্যতের খাতিরেই।
সমাজে প্রত্যেকের সমান অংশের অধিকার আছে- এ কথাটা আমরা মুখে বলি মাত্র- কিন্তু সেটা অন্তরে স্বীকার করে নিতে পারি না। তাহলে মানুষ মাত্রই সমান কোন্ অর্থে? কোন্ অভিধায়? কোন্ কূট ব্যাখ্যায়? সব মানুষই যখন পরম মূল্যের আধার। সকলকেই আত্মোপম ভাবা উচিত। এই "আত্মৌপম্য জ্ঞান" জীবন মূল্যের আধার।
আত্মোৎকর্ষ ছাড়া আত্মার জাগরণ ঘটে না কখনো। আবার আত্মার জাগরণ ছাড়া ছাড়া "আত্মৌপম্য জ্ঞান" ও অর্জন করা সম্ভব নয়। আজকাল ভদ্র সমাজের রীতি-নীতি, আদব-কায়দার ভেতর মনুষ্যত্বের জাগরণের চিহ্নরেখা কম চোখে পড়ে। তবে এমনটা কেন ঘটে? সমাজ-বিশ্লেষণ হবে কীভাবে। সমাজের ওপর তলার কার্নিশে বসে সমাজটাকে কেবল বিসম শ্রেণীতে পরিণত করতে যারা অভ্যস্ত- তাদের কর্ণকুহরে এসব কথা প্রবেশ করবে না।
আমাদের পৃথিবীটাই তো যাবতীয় বস্তুর আধার। আমাদের আশ্রয়, স্থান পাত্র প্রদান করে থাকে।
আমরা আমাদের সমাজে যার যার স্থান যার যার মতো করে নির্ধারণ করে নিতে পারি কিংবা পারি না। তখনই পারি- যখন আমরা নৈতিক ও মানবিক মূল্য সুষম মাত্রায় আরোপ করতে পারবো। মানুষের সাম্য- মানবিক সমতার ওপরই নির্ভর করে।
যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না মানুষকে- মানুষের মনুষ্যত্বকে। এটা তো কোনো ধাতব বিদ্যাও নয়। সমাজের কাউকে, কারুর অধিকারকে অবদমিত করে সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত করা চলে। তবে লোক দেখানো, গণশাসনে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ তেমন একটা ঘটে না। কারুর মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাধা ও ব্যত্যয় ঘটলে গণতন্ত্র স্বেচ্ছাচারের রূপ পরিগ্রহণ করে।
পেরিক্রিস্ খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ অব্দে তাঁর "অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত ভাষণে" গণতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছেন: "আমাদের গণতন্ত্র বলা হয় এই জন্য যে আমাদের প্রশাসনের ভিত্তি বহুর উপর, অল্প সংখ্যকের উপর নয়। ঘরোয়া ঝগড়ায় সকল লোকই আইনের চোখে সমান, আর গণমতের কাছে কেউ তার পদমর্যাদার জন্যে আদৃত হয় না; হয় তার গুণের জন্যে। "
সকল মানুষেরই স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার অধিকার আছে। সমান সুযোগ ভোগ করার অংশ আছে। সুযোগের সাম্য ও সমতা মানেই জগৎ-সংসারের সম্পদের অধিকার।
বর্তমান বিশ্বসভ্যতায় এই সাম্য ও সমতাই আমাদের কাম্য।
মানুষ বেঁচে থাকে মানুষের মধ্যেই এবং মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎ। তার আত্ম-বিশ্বাস, আত্ম-জিজ্ঞাসা, আত্ম-নির্মাণ, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, নৈতিক বুনিয়াদ এবং মনুষ্যত্বময় ভূমিকায় ভবিষ্যতের পৃথিবী জীবিত থাকবে, এটাই আমাদের বিশ্বাস
কৃতজ্ঞতায়
আল মুজাহিদী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।