আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্বৃত্তদের শেষ ভরসা দেশপ্রেমের কথা : আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেনা তোলা, সংবিধান ও স্ক্রাউন্ডেল সমাচার..

সেই চিরবিদ্রো.... যে লড়াই , কখনো শেষ হয়না.... দুর্বৃত্তদের শেষ ভরসা দেশপ্রেমের কথা -পেট্রয়টিজম বা দেশপ্রেম সম্পর্কে কালজয়ী উক্তিটি করেছিলেন লন্ডনে ১৭৭৫-এর ৭ এপৃলের সন্ধ্যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ লেখক, সমালোচক ও কবি স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪)। তার সুবিখ্যাত রচনা ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ বা ইংরেজি ভাষার অভিধান। ১৭৪৭-এ এই ডিকশনারি লেখায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং আট বছর প্রচুর পরিশ্রমের পর এ কাজ সমাপ্ত করেন। সেই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় তিনি পেট্রয়টিজমের ডেফিনেশন দিতে গিয়ে বলেছিলেন, পেট্রয়টিজম ইজ দি লাস্ট রিফিউজ অফ এ স্কাউনড্রেল (Patriotism is the last refuge of a scoundrel)। বাংলায় এর মানে দাড়ায়, দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয় বা ভরসাস্থল।

স্যামুয়েল জনসন খুব পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং ড. জনসন নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। রাজনীতি বিষয়ে তিনি গভীর চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং তার সময়ের (অষ্টাদশ শতাব্দী) রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লেখেন। লেখালেখির চাইতে তিনি বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন তার ধারালো ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের জন্য। আর তার সব উক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত দেশপ্রেম সম্পর্কিত উক্তিটি। দেশপ্রেম একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার এ বিষয়ে বছর দশেক আগে আমেরিকান প্রাবন্ধিক জেমস লিরয় উইলসন লেখেন, ডেমাগগ (Demagogue) বা বক্তৃতাবাগীশ রাজনৈতিক নেতারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বদলে স্বদেশপ্রেমের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য জনসাধারণকে আবেগ তাড়িত করে খেপিয়ে দেন।

দেশপ্রেমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহারকারী বক্তৃতাবাগীশ নেতাদের সমালোচনা করেছিলেন ড. জনসন তার ওই উক্তিতে। জেমস লিরয় উইলসন লেখেন, এই ধরনের নেতারা জনসাধারণের সমর্থন পাওয়া এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার আশায় যা খুশি তাই বলতে পারেন। কোনো ব্যক্তি যদি এই ধরনের কোনো নেতার সঙ্গে এক মত না হন তাহলে সেই নেতা ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিটিকে দেশপ্রেম, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের বিরোধী রূপে আখ্যায়িত করতে পারেন। সৎ মনে ভিন্ন মত প্রকাশ করলেও সেই ব্যক্তির চরিত্র হনন করা হতে পারে। এই ধরনের নেতা যখন দেশপ্রেম প্রচার করেন তখন তার আসল মতলব থাকে জনসাধারণের সরল অনুভূতিগুলোকে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা।

১৭৭৫-এ ড. জনসনের এই উক্তি এবং ২০০১-এ জেমস লিরয় উইলসনের এ ব্যাখ্যার মধ্য সময়ে দেশপ্রেম বিষয়ে বহু দার্শনিক, পণ্ডিত ও লেখক তাদের মতামত দিয়েছেন। অন্তত পাঁচজনের মতামত উল্লেখ করা উচিত হবে। নোবেল বিজয়ী ইংরেজ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল বলেন, খুব তুচ্ছ কারণে হত্যা করতে এবং নিহত হতে রাজি হওয়াই হচ্ছে দেশপ্রেম (Patriotism is the willingness to kill and be killed for trivial reasons). আমেরিকান দার্শনিক রালফ বি পেরি বলেন, যদি দেশপ্রেম হয় একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয়স্থল তাহলে সেটা শুধু দেশপ্রেমের নামে খারাপ কাজ করার জন্যই সে সেটা প্রচার করে না, সে দেশপ্রেমের তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে নৈতিকতার সকল সীমারেখা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেও দেশপ্রেমের কথা বলতে পারে। (If patriotism is the “last refuge of a scoundrel” it is not merely because evil deeds may be performed in the name of patriotism, but because patriotic fervour can obliterate moral distinctions altogether). নোবেল বিজয়ী আইরিশ সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, দেশপ্রেম হচ্ছে চরম বুদ্ধিহীনতার একটি বিধ্বংসী ও বিকারগ্রস্ত রূপ (Patriotism is the pernicious. psycho pathetic form of idiucy). ইংরেজ নাট্যকার অসকার ওয়াইল্ড আরো সোজাসাপটা ভাবে বলেন, দেশপ্রেম হচ্ছে দুষ্টের গুণ (Patriotism is the virtue of the vicious). আমেরিকান স্যাটায়ার লেখক অ্যামব্রোস বিয়ার্স অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, যদিও আমি ড. জনসনের মতো পণ্ডিত নই তবুও আমার মনে হয় তিনি একটা ভুল করেছিলেন। দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয় বা ভরসাস্থল নয়, এটি হচ্ছে তার প্রথম আশ্রয় বা ভরসাস্থল (I beg to submit that it is the first)।

স্কাউনড্রেল কাকে বলা হয়? এই উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন আমলে স্কাউনড্রেল শব্দটি বহুল প্রচলিত ছিল। এখন বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার প্রচলন কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্কাউনড্রেল শব্দটি কম শোনা যায়। সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারিতে স্কাউনড্রেল শব্দের ছয়টি মানে দেয়া হয়েছে বদমাশ, দুর্বৃত্ত, দুরাচার, পামর, দুরাত্মা, পাপিষ্ঠ। আমার কাছে মনে হয়েছে, উপরোক্ত ছয়টি শব্দের মধ্যে দুর্বৃত্তটাই কিছুটা নম্র ও ভদ্রজনোচিত। অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন, একজন দুর্বৃত্ত কীভাবে নম্র বা ভদ্র হতে পারে? সে যাই হোক।

২৩৬ বছর আগে ড. স্যামুয়েল জনসনের কালজয়ী উক্তি এবং তারপর সেই বিষয়ে বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মনুষ্যকুল প্রথমে বিবেচনা করতে পারে নিচের দুটি উক্তি এবং তারপর বিবেচনা করতে পারে স্কাউনড্রেল শব্দটির কোন মানে তারা বেছে নেবে? এক. তেল-গ্যাস অনুন্ধানে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, যারা এখন দেশপ্রেমের কথা বলছেন, দেশের কোনো সংকটেই তাদের পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে : আমার চেয়ে কে বেশি দেশপ্রেমিক? (ইউএনবি/বাসস/নয়া দিগন্ত, ১৯ জুন ২০১১)। দুই. সংবিধান শুধু দেশের সর্বোচ্চ আইনই নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্বেরও প্রতীক। পবিত্র সংবিধানকে নিয়ে কটূক্তিকর বক্তব্য খুবই জঘন্য।

আদালত (বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ) আরো বলেন, আমরা শুনেছি বিরোধী দলীয় নেতাও একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। তার ভেতরেও দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। বিষয়টি আমরা বিচারিক এখতিয়ারে (জুডিশিয়াল নোটিশে) নিচ্ছি (যুগান্তর, ৩ আগস্ট ১১)। আপনার রায় দিন মনুষ্যকুল যেন কিছুটা সহজে নিজস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে সে জন্য কয়েকটি টিপস আমি দিচ্ছি। এক. সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনে সকল মানুষই সৎ, সজ্জন, দেশপ্রেমিক ইত্যাদি গুণের অধিকারী।

কোনো চ্যালেঞ্জ বা কোনো অসাধারণ ঘটনার মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার আত্মপরিচয় জানতে পারে না। যেমন ধরুন, একজন পিয়ন যখন পাঁচশ টাকা ঘুষের প্রস্তাব পায় অথবা একজন ক্লার্ক পাঁচ হাজার টাকা, একজন পুলিশ কর্মকর্তা পাঁচ লাখ টাকা কিংবা একজন মন্ত্রী যখন পাঁচ কোটি টাকা ঘুষের অফার পান তখনই তাদের ব্যক্তিগত সততা পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। এই পরীক্ষায় পাস করলে তিনি আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারেন এটা ভেবে যে, তিনি সত্যই একজন সৎ ব্যক্তি। এই ধরনের কোনো পরীক্ষার আগে তিনি নিজের সম্পর্কে সেই রকম দাবি করতে পারেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশপ্রেমের পরীক্ষাটা কী? আশা করা যায়, অচিরেই আদালত এ বিষয়ে মনুষ্যকুলের অজ্ঞানতা দূর করবেন।

দুই. দেশপ্রেমের পরীক্ষার ধরনটি যদি জানা যায় তাহলে প্রশ্ন হবে, শেখ হাসিনা কি সেই পরীক্ষাটি দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে, কবে? কোথায়? তিন. সেই পরীক্ষায় শেখ হাসিনা কি টপ মার্কস পেয়েছিলেন যে, তিনি নিজেকে টপ দেশপ্রেমিক দাবি করতে পারছেন? চার. শেখ হাসিনার এই টপ দেশপ্রেমিক স্টেটাসের সঙ্গে জীবিত বীর উত্তম ও বীর প্রতীকদের স্টেটাসের কোনো সামঞ্জস্য বিধান কি করা হয়েছে? বীর উত্তম ও বীর প্রতীকরা কি টপ দেশপ্রেমিকের উপরে, না নিচে? পাঁচ. সাধারণত যিনি জ্ঞানী বা গুণী, তার যদি ন্যূনতম বিনয় থাকে তাহলে তিনি কখনো দাবি করেন না যে, তিনিই টপ জ্ঞানী বা টপ গুণী। তার শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের ভার তিনি ছেড়ে দেন মানুষের কাছে। তাদের মনে থাকে হরিশচন্দ্র মিত্র-র কবিতাটি : আপনারে বড় বলে বড় সেই নয় লোকে যারে বড় বলে বড় সে-ই হয়। যেহেতু শেখ হাসিনাই দাবি করেছেন, তিনিই সেরা দেশপ্রেমিক সেহেতু তার দেশপ্রেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া কিন্তু দাবি করেননি যে, তিনি দেশপ্রেমিক।

তবে তার দেশপ্রেম বিষয়ে প্রশ্ন উঠিয়েছেন আদালত। এক্ষেত্রে আদালতের মনে পড়তে পারে কুসুম কুমারী দাশ-এর কবিতাটি : আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে। ছেলে না হোক, বাংলাদেশে অন্তত একজন মেয়ে কাজে বড় হয়েছেন। সবাই জানেন, মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করার লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সেনা শাসন প্রতিষ্ঠত হওয়ার পর য: পলায়তি স: জীবতি মন্ত্রে দীক্ষিত শেখ হাসিনা আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া দেশের মাটি কামড়ে পড়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তদানীন্তন সেনা অফিসাররা খালেদা জিয়াকে সাবজেল থেকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে পারেননি। দেশপ্রেমের কঠিনতম পরীক্ষায় খালেদা জিয়া তখন তার কাজ দেখিয়ে পাস করেছিলেন। তার সেই সাফল্যের কারণেই মতিউর রহমান-মাহফুজ আনামের মাইনাস টু ফর্মুলা অর্ধেক সফল হলেও পূর্ণ সফল হয়নি। আর মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হয়েছিল বলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন।

ইনডিয়ার ব্যাগ ভর্তি টাকা ও পরামর্শে (দেখুন দি ইকনমিস্ট, ৩০ জুলাই ২০১১) আওয়ামী লীগ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছিল। ফলে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলো বিদায় নিয়েছিল এবং দেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা স্বাভাবিক গতি এবং চরিত্র ফিরে পেয়েছিল। অর্থাৎ, আজ যে বিচার ব্যবস্থায় খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে সেই বিচার ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল খালেদা জিয়ারই দেশপ্রেম! সুতরাং, আমি নেড়িকুকুর, আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, অগাধ আস্থা ও গভীর বিশ্বাস রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিচারকদের উচিত আইনের পাশাপাশি সঠিক ইতিহাসেরও জ্ঞান রাখা। বাংলাদেশের সঠিক ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে যদি বিচারকরা অবহিত থাকেন তাহলে ড. স্যামুয়েল জনসনের কালজয়ী উক্তিটি বিচারকদের ক্ষেত্রে নয়, শুধু পলিটিশিয়ানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। (শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

এর লেখা থেকে সংকলিত) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.