আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষক কেন বাবার মতঃ প্রসঙ্গ প্রথম আলোর "‘পার’ করে দেন অসীম স্যার" শীর্ষক লিখাটি

দুপুর একটা ১৫ মিনিট! মহাসড়ক দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে বাস-ট্রাক। ত্রস্তপদে এক ব্যক্তি ডানে-বাঁয়ে হাত নেড়ে মহাসড়ক পার হচ্ছেন। হাতে ও কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে জড়সড় হয়ে পিছু পিছু তাঁকে অনুসরণ করছে একদল খুদে শিক্ষার্থী। সতর্কতার সঙ্গে মহাসড়ক অতিক্রমের পথনির্দেশক ওই ব্যক্তির হাতের ইশারায় চলন্ত যানবাহন হয় গতি কমিয়ে চলে নতুবা থেমে যায়। বিদ্যালয়ে ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মিনিট দশেকের জন্য রাস্তা পারাপারের এই কাজটি করেন তিনি।

তিনি অসীম স্যার। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক লাগোয়া সিলেটের দয়ামীর এলাকার আবদুস ছোবহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অসীম চক্রবর্তী। ১৯ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুদে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সড়ক পার করে দেন। তাঁর এই উদ্যোগ সমাদৃত হয়েছে যানবাহন চালকদের মধ্যেও। মহাসড়ক মাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া ওই বিদ্যালয়ে যাতায়াতের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় খুদে শিক্ষার্থীদের জন্য এ যেন তাঁর রুটিন বাঁধা এক কাজ।

নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজ করায় বিদ্যালয়ের আশপাশে এ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। পা বাড়ালেই মহাসড়ক: আবদুস ছোবহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামীর এলাকার অন্যতম পুরোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৭৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে সিলেট জেলার অংশে ১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। এর মধ্যে আবদুস ছোবহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একেবারে মহাসড়ক লাগোয়া।

বিদ্যালয়টিতে ৫৩৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। নিজ দায়িত্বেই খুদে শিক্ষার্থীরা পারাপার হয়ে আসছিল। ১৯৯২ সালের ৯ মার্চ পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয় থেকে বদলিসূত্রে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন অসীম চক্রবর্তী। প্রথম দিনই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট চওড়া সড়ক দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসার সময় একটু অসতর্ক হলেই অকালে ঝরে পড়তে পারে কোনো কোমল প্রাণ—এ আশঙ্কায় অসীম চক্রবর্তী ‘পার’ করে দেওয়ার এ কাজ শুরু করেন।

অসীম স্যারের বাড়তি এ দায়িত্ববোধ অভিভাবকদের উদ্বেগও কমিয়েছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শুক্লা রানী দে বলেন, ‘পাঠদান শেষে সাধারণত অনেকেই ক্লান্তি অনুভব করেন। কিন্তু আমরা দেখি বিদ্যালয়ে ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই অসীম স্যার শ্রেণীকক্ষের বাইরে অপেক্ষা করেন। যেন এ কাজটি তিনি না করলে স্বস্তি পান না। আমরা তাঁকে এ কাজের জন্য সম্মান করি, কৃতজ্ঞতা জানাই।

’ বিদ্যালয় শুরুর ঘণ্টা যখন বাজে, তখন শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের অভিভাবকদের সহায়তায় বিদ্যালয়ে আসে। কিন্তু ছুটির ঘণ্টা বাজলে আর কোনো অভিভাবককে আসতে হয় না। বিদ্যালয় ছুটির দুটি পর্বে চলে এই পারাপার। দুপুর একটা ১৫ মিনিট একবার এবং বিকেল চারটা ১৫ মিনিটে আরেকবার। ছবাব আহমদ নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমরা পারলে অসীম স্যাররে মাথায় তুইলা রাখতাম।

’ ফারুক মিয়া নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘অসীম স্যারের জন্য আমরা নির্ভাবনায় আছি। ’ সিলেট-কুমিল্লায় চলাচলকারী ‘কুমিল্লা ট্রান্সপোর্ট’-এর চালক রাহাত উদ্দিন বলেন, ‘আমরা অনেকেই তাঁকে চিনি এবং শ্রদ্ধাও করি। হাইওয়ে রোডের একজন গাড়িচালক হিসেবে তাঁর এই কাজ দেখে আমার মনেও সতর্কতা জাগায়। ’ অসীম স্যারের মুখোমুখি: কথা হয় অসীম চক্রবর্তীর সঙ্গে। একগাল হেসে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘এ আর এমন কি! আমি তো নিজের মন থেকেই করছি।

বাচ্চাদের নিরাপত্তায় কিছু সময়ের জন্য বিশ্বরোডে ব্যারিকেড দিই...!’ অসীম চক্রবর্তী সপরিবারে সিলেট শহরে থাকেন। দাড়িয়াপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস। তাঁর স্ত্রী স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তীও একজন শিক্ষক। তাঁদের দুই মেয়ে, দুজনই স্কুলে পড়ছে। অসীম বলেন, ‘ওই বাচ্চাদের মধ্যে নিজের দুই মেয়ের মুখ দেখতে পাই।

একদম মন থেকেই ওই কাজ করছি। প্রথম যেদিন বিদ্যালয়ে যোগদান করলাম, সেদিনই পার হওয়া নিয়ে আমার মনেই এক ধরনের ভয় ঢুকে যায়। আমি ভাবি, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ আমি। আমার নিজের মনেই যদি এমন ভয় ঢোকে, তাহলে কোমলমতি ওই বাচ্চারা তো আরও বেশি ভয়ে থাকার কথা। তাই আমি এ কাজ করে আসছি।

’ আগামী বছরই তিনি অবসরে যাবেন। অবসরে গেলে তাঁর অনুপস্থিতিতে এই ‘পার’ করার কাজ কে করবে? প্রশ্ন শুনে অসীম বলেন, ‘আমার সঙ্গে নির্মল কান্তি ধর নামে একজন প্রায়ই সহযোগিতা করেন। তিনি ওই বিদ্যালয়ে নৈশকালীন পাঠদানের একজন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক। কোনো দিন বিদ্যালয়ে আসতে না পারলে আমি তাঁকে আগেই বলে রাখি। ’ এরাও শিক্ষক, আর পরিমলরাও শিক্ষক! এই শিক্ষকের কথা শুনে আমার কলেজের স্যার জনাব নুরুজ্জামান মোল্লার কথা মনে পড়ছে, স্যার কে নিয়ে কথা বললে রচনা হয়ে যাবে, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের গল্প তাকে ছাড়া লিখা সম্ভব না।

স্যার ছিলেন আমাদের গনিত বিভাগের প্রধান। এস এস সি ও এইচ এস সি তে যেদিন গনিত পরীক্ষা থাকে সেইদিন স্যার মসজিদে ১০ জন করে লোক ঠিক করে দেন যারা সারাদিন কোরআন পড়ত আর আমাদের পরীক্ষা যেন ভাল হয় সেই দোয়া করত। স্যার আমাদের অনেক বকাঝকা করতেন, স্যার এর হাতে ভালো মার ও ছিল! তাই স্যার কে অনেকেই পছন্দ করত না, কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে এসে স্যার এর এই কাজ শুনে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে আমাদের মস্তক। আজ জীবনের এই পর্যন্ত যে পর্যায়ে আসতে পেরেছি, তার জন্য মোল্লা স্যার এর কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। এইসব শিক্ষকদের জন্য শ্রদ্ধা, চির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.