তবু হাতড়ে খুজে ফিরি আলো
১.
সারারাত ঘুমাইনি। রাতভর journey তে গান এর পর পর গান গান চলেছে, ঘুমানোর সময় পাওয়া যায়নি। শেষে যখন কক্সবাজার পার হয়ে টেকনাফ তখন চোখ জড়িয়ে এসেছে ঘুমে। আমি আর জনি পাশাপাশি সিটে, ও বেচারার অবস্থাও খারাপ। কারণ রাস্তা খুব সুবিধার না।
প্রচন্ড ঝাকি দিয়ে আমাদের আকাশে তুলে আচমকা ছেড়ে দিচ্ছে। শান্তির ঘুম হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
জনি বলল, মামা......
আমি বললাম, কি?
সিগারেট আছে?
নাই। নামার পর কিনব।
আচ্ছা।
নামার পর দে ঘুম। উঠলাম দুপুরে। দেখি খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে।
আমরা যেখানে উঠেছি সেটা হচ্ছে রাশিয়ান ফিশারিজ নামক একটা সংস্থার প্রাচীন পরিত্যক্ত ভবন। আমাদের টিম এর আগে দুজন এসে এই বিল্ডিং পরিস্কার করেছে।
বাথরূমের অবস্থা খারাপ। ছিটকিনি নাই। মঈন কলম দিয়ে দরজা আটকানোর একটা বুদ্ধি বের করল। এরপর যেই যাচ্ছে সে হাতে কলম নিয়ে যাচ্ছে।
স্যার ঘোষনা দিলেন, আজকে আমরা সবাই জার্নি করে এসেছি।
টায়ার্ড। সো আজকে কোন কাজ হবে না। তবে..
তবে?
তবে আমরা সবাই নাফ নদীর তীর পর্যন্ত ঘুরে আসব।
নাফ নদী কতদূর স্যার?
ওই যে।
আরে তাই তো! রাশিয়ান ফিশারিজ এর পাশ দিয়েই চলে গেছে নাফ নদী।
এতক্ষন খেয়াল করি নাই। কিন্তু আমাদের প্লান ছিল এখানকার বার্মিজ মার্কেট থেকে ঘুরে আসব। কি আর করা স্যার এর আদেশ।
আমরা প্রায় ষাট জন। নাফের তীরে আশ্চর্য বাতাস।
ভাল লাগার মত সব। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল রেজা স্যার এর মধ্যেই লেকচার দেওয়া শুরু করেছে। মাস্টার মানুষগুলা বোধ হয় কোথাও গিয়ে চুপ থাকতে পারেন না। ইগনোর করতে গিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।
অরিনও দেখি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
এত ভাল ছাত্রী যদি এরকম করে তাহলে ফিল্ড শেষে আমাদের কি অবস্থা হবে। ফিল্ড রিপোর্ট তো ওরটাই কপি মারব বলে ঠিক করছি। ব্যপারটা কড়া ভাষায় বলা দরকার, কিন্তু আমি স্টেডী হয়ে গেলাম। নাফের বাতাসে তার চুল ওড়ছে, ওড়নাও। ইমেজটা হঠাৎ করেই অপার্থিব বলে মনে হচ্ছে।
রাশিয়ান ফিশারিজে ফিরে গিয়েও আমরা আবার কয়েজন ব্যাক করলাম। নাফের অপূর্ব বাতাসে সিগারেট খাওয়ার সুযোগ কে হারাতে চায়। জনিকে বলবনা বলবনা করে বলেই ফেললাম, দোস্ত অরিনকে আজকে দারুন লাগছিলো।
জনি একটা হাসি দিয়ে বলল, তাই?
হ্যা।
কিন্তু তোকে দিয়ে কিছু হবে না।
মানে?
অরিন মঈনের সাথে বার্মিজ মার্কেটে যাচ্ছে। তুই এখানে বসে বিড়ি ফুকছিস।
চল আমরাও যাবো। যাবি না তুই?
আমি তো যাব মদ কিনতে।
আমি ও যাবো।
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি এদিকে বসে বসে স্বপ্ন বুনছি আর একজন চলে গেল বার্মিজ মার্কেটে।
আমি আর জনী মিলে বার্মিজ মার্কেটে গেলাম, অরিনকে পাওয়া গেল কিন্তু জনীর জিনিসটা পাওয়া গেল না। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে বুঝতে পারলাম বৃথা এই আসা। কিছু করার না পেয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলাম।
অরিন তার মত ঘুরছে। জনী আবার রাখীকে পেয়েছে। তারা একসাথে কসমেটিকস কিনছে। আমি তাদের সাথে জুটে গেলাম।
২.
তারপরের দিন থেকে দৌড়ের উপর।
ডাকছড়া আর গেম রিসার্ভ ফরেস্ট ঘুরে সন্ধ্যায় যখন রাশিয়ান ফিশারিজে ফিরে এসে দেখি শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। রাতে কোনরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমাবো, দেখি জনি নাই। কই গেল শালা? ফোন দিলাম, কোথায়?
জনি বলল, তাড়াতাড়ি আয়। বাইরে দাড়াইছি।
আমি খুব টায়ার্ড।
আয় বললাম, নাহলে মিস করবি।
বের হয়ে দেখি, জনি, শুভ দাড়িয়ে। জনি বলল, চল, নাফের পাড়ে যাব।
এত রাতে কেন?
মাল খাব।
দোস্ত ধরা খাইলে কিন্তু ঝামেলা।
আরে, রেজা স্যার নিজেই মাতাল হয়ে আছে। চল যাই।
গহীন রাত নেমে এসেছে, কিন্তু নাফের জল ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আর বাতাস আসছে যেন অন্য কোন জগৎ থেকে। আমরাও চলে গেলাম অন্য জগতে।
জনি বলল, শোন অরিনের পিছনে ঘুরে লাভ নাই। শি ইজ মুলা।
আমি বললাম, মার খাবি কিন্তু। তুই যে রাখির সাথে ফিল্ডিং মারিস! বদের হাড়ি। আর আমার পিউর লাভ নিয়া তোর সমস্যা।
আমার কোন সমস্যা নাই। আর রাখিরে নিয়া আমার অন্য টার্গেট। কিপ ইট সিক্রেট। শুভ তুইও।
শুভ মাথা ঝাকালো।
ওকে।
আমি বললাম, আমি বলে দিব।
জনি আমার দিকে তাকালো, কেন তোর জ্বলে নাকি? তোর যদি মনে হয় রাখিরে তোর লাগবে, ঠিক আছে।
না। আমি শুধু অরিন।
শুভ সিগারেট খাবি?
শুভ বলল, খাব।
কিন্তু আমার কাছে ম্যাচ নাই।
জনি বলল, আমার কাছে আছে। সিগারেট দে।
কিন্তু শুভর কি হবে?
শুভর কিছু হবে না।
প্রেম? নারী?
তুই মাতাল হয়ে গেছিস তপু।
তুইও। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তোর হাত কাঁপছে।
জনি সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে বলল, আমরা সবাই মাতাল। অ্যান্ড লাইফ ইজ বিউটিফুল।
শুভ বলল, আই এগ্রি।
আমি বললাম, মি টু।
জনি আবার বোতল খুলে বলল, দেন চিয়ার্স এগেইন।
কতটা মাতাল হয়েছিলাম জানি না। তবে সকালে যথারীতি রাশিয়ান ফিশারিজ এর পরিত্যক্ত ভবনের যে ঘরে বেড পাতা সেখানেই ঘুম ভাঙল।
৩.
টেকনাফ বীচ যে কতটা সুন্দর সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনা ছিলনা। আমাদের ম্যাক্সিমামের experience কক্সবাজার বীচের ভিড় দেখে। কিন্তু এখানে বড় নির্জন আর স্নিগ্ধ। এখানে জনতা না থাকলেও মানুষ আছে। মনের মানুষ।
বিকেল হয়ে এসেছে। আমরা চিংড়ির পোনা চাষের একটা ফ্যাক্টরি ভিজিট করে বের হলাম। চরম disgusting. কিন্তু সৌভাগ্য যে সেটা একেবারে সমুদ্রের তীরে। আমাদের কেউ কেউ নামল। আমাকে দূরে দাড়িয়ে দেখতে হল।
সাতার জানিনা এবং পানিতে নামতে ভয় পাই। আমার সমুদ্র আমার চোখ আর কল্পনার অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ।
কিন্তু অবাক করা বিষয় অরিন পানিতে নেমে ঝাপাঝাপি করছে। অবিকল জলপরী মনে হচ্ছে। ঈর্ষায় আমার বুক ফেটে যাওয়ার অবস্থা হল।
আমাকে অবাক করে দিয়ে অরিন চিৎকার দিয়ে বলল, অ্যাই তপু নামবি না?
জনির সতর্কবার্তা মনে এল, যারা পানি ভয় পায়, তারাই সবার আগে ডোবে। আমি বললাম, নেমে কি করব?
নেমে কি করব মানে? গাধার মত কথা বলিস কেন?
অরিন চলে গেল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই উঠে এল সমুদ্র থেকে। জলপরীও।
ইস আমি এইটা কি করলাম। হারামজাদা জনির কথা শুনে। পানিতে গেলেই কি ডুবতাম? আর এখন যে না নেমেই ডুবলাম? জনির পশ্চাৎদেশে তিরিশটা লাথি দিলেও তার সদোপদেশের ঋণ শোধ হবে না।
আগামীকাল যাচ্ছি সেন্টমার্টিন। সেখানে যা করার করতে হবে।
সরাসরি।
৪.
এত সুন্দর একটা দ্বীপ, কিন্তু আমার অসম্ভব খারাপ লাগা শুরু হল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বীচে হাটতে বের হলাম। আমি, জনি আর শুভ। বাতাস সাগরের জলে সিক্ত আর কেমন যেন মন খারাপ করা।
শুভ বলল, তোর কি মন খারাপ তপু?
না।
মন খারাপ করে আর কি হবে? মঈনের সাথে অরিনের হবে এইটা আগেই বোঝা গিয়েছিল।
তাতে আমার কি?
জনি বলল, That’s nice. তোকে একটা hypothesis দিচ্ছি। মেয়েরা হচ্ছে বাসের মত...
আমি জানি এইটা।
খালি একটা কথা, লোকাল বাস মিস করছিস সমস্যা নাই, মার্সিডিজ ধরবি এরপর।
ফাজলামো করিস না। ভালো লাগছে না।
আমি অনেক পরিশ্রম করে একটা সিগারেট ধরালাম। বাতাসে ধরানো যায় না। আমরা তিনজন নীরবে হাটছি।
জনি হঠাৎ বলল, তপু তোকে একটা জিনিস দেখাই?
কি?
ওই যে বামে দেখ।
আমি তাকালাম। আবছা আলোতেও দেখা যাচ্ছে অরিন আর মঈন। বেশ গাঢ় হয়ে বসে আছে।
আমি মঈনকে ক্যাম্পাসে গিয়ে পিটাবো।
জনি বলল, অবশ্যই। আমিও আছি তোর সাথে, কিন্তু তাতে লাভ?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আসলেই তাই। কোন লাভ নেই, যা গেছে তা গেছে। কিন্তু এরকম হল কেন? মানুষ কি তাহলে চোখের ভাষা পড়তে পারেনা?
৫.
এবার ফিরে আসা।
রাতের journey আবার। রাশিয়ান ফিশারিজ থেকে বাস ছাড়লো। আমরা এই পরিত্যক্ত ভবনটাকে কয়েকদিন সরব রেখে গিয়েছিলাম। জানি না এই নাফ আমাদের মনে রাখবে কি না, কিন্তু আমার মন পড়ে থাকবে না। সত্যি আমি ভুলতে চাই এই ট্যুর।
শুধু আমাদের ফেলে আসা মদের বোতলগুলো পরে থাকুক। বিদায়।
এইবার কোন গান নাই। সবাই প্রায় ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি জানি আমার মন আগামী কয়েকদিন খুব খারাপ থাকবে, সেইটা আমার চোখের ভাষা কেউ পড়তে পারেনা এই কারণে নাকি আমার আহত সত্ত্বা বারবার জেগে উঠবে সে কারণে তা জানি না।
কিন্তু মন ভালো করার কোন উপায় নাই।
ঘুম আসছে না। মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। আমার পাশে জনি সাউন্ড স্লিপে আছে, হা করে ঘুমাচ্ছে। এই শালা এত সুখী কেমনে? এই জিনিসটা না জানলেও অন্তত এইটা জানলাম যে “Life is beautiful” সবার জন্য সত্যি না।
বাস এগিয়ে চলছে ঢাকার দিকে, বাইরে অন্ধকার। ভেতরেও, আমার একান্ত ভেতরে।
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।