সাইফ শাহজাহান
শুচি সৈয়দ
‘জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তর’ কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত-র আÍজৈবনিক উপন্যাস বলা হয়েছে। গ্রন্থটিকে কতটা আÍজীবনী আর কতটা উপন্যাস বলা যাবে সে বিতর্ক সাহিত্যের বোদ্ধা সমালোচকদের জন্য তোলা থাক আমরা পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে বরং মূল্যায়ন করি।
হরিপদ দত্তর জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তরে-র যে নায়ক হরিপদ দত্ত সে নায়কের ভেতর একটু সূক্ষ্মদৃষ্টিতে চাইলে আমরা এক বাঙাল অপুর প্রতিমা পেয়ে যাবো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিরন্তন বাঙালি অপুর আদলে। তখন এই বইটিকে বাঙালের পথের পাঁচালী বলে বোধ হবে।
পথের পাঁচালী অপু এবং জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তরের নায়ক হরিপদ-র মধ্যে কালিক ব্যবধান আছে। একজনের জš§ ব্রিটিশ উপনিবেশে, আরেকজনের সূচনা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভাজিত উপমহাদেশের পাকিস্তান রাষ্ট্রে। দুজন দুই বাস্তবতা এবং দুই কালের মানুষ তারা। একজনের উপমহাদেশের বাইরে যাবার অভিজ্ঞতা নেই অপরজনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে পৃথিবীর অন্য গোলার্ধ ঘুরে আসার।
কথাশিল্পী হরিপদ দত্ত-র সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর লেখা পড়ে।
অনেক পরে তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় তাঁর আমেরিকা প্রত্যাবর্তনের পরপরই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ব্যথিত একজন লেখক। যিনি তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে স্বীয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা উদ্ভূত আরেকটি রাষ্ট্র ভারতে পাঠাতে বাধ্য হনÑ কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তিনি নিজে সেই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অভিবাসী হননিÑ হলে যে স্বর্গাদপি গরিয়সী জননী জš§ভূমিকে ছোট করা হয়। স্বীকার করে নেয়া হয় মাতৃভূমির অপমানÑ সেই অনুভূতি থেকে বরং বেছে নেন অন্য গোলার্ধের অভিবাস। কিছু সংখ্যক সাম্প্রদায়িক, অবিবেচক মানুষের সাম্প্রদায়িকতার দায় তিনি মাতৃভূমির কাঁধে চাপাতে চাননি।
তাই পরিবার পরিজন যখন ভারতে তিনি পাড়ি জমান আমেরিকায়। অন্য গোলার্ধের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় অভিবাসী জীবন কাটিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন আবার মাতৃভূমির কোলেই। ভারতে পাড়ি জমাননি। উনিশ শত নব্বইয়ের দশকে তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। তার ফিরে আসার পর থেকেই তার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয়, যোগাযোগ।
তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তবে সত্যিকথা বলতে কি তার ভেতর যে চিরন্তন অপরাজিত এক নায়ক অপু লুকিয়ে আছে সেই নায়ককে কিন্তু আমার অবলোকন করতে হচ্ছে এই আÍজৈবনিক রচনার ভিড় থেকে।
খুব সম্ভবত কৃষণ চন্দরের একটি গল্প আছে এক অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে নিয়ে লেখা। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগি হয়ে যাবার পর এক পাগলা গারদের অধ্যক্ষ আবিষ্কার করেন তার পাগলা গারদে একজন মুসলমান পাগল রয়ে গেছেÑযার দায়-দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। অতি বুদ্ধিমান অধ্যক্ষ পাগলা-গারদ থেকে পাগলটিকে জোর করে ঠেলে সীমান্তের অপর পারে অর্থাৎ মুসলমানদের বাসভূমি পাকিস্তানে পাঠাতে চেষ্টা করলে অনিচ্ছুক অপ্রকৃতিস্থ সেই মানুষ শেষ পর্যন্ত দুদেশের সীমান্তে আধাআধি লাশে পরিণত হন।
কোনও দেশই তার দায়িত্ব নেয় নাÑএই গল্পের অপ্রকৃতিস্থ লোকটি যদি সাম্প্রদায়িকতার মূর্তিমান প্রতিমূর্তি উপমহাদেশের ভবিষ্যত প্রতীক হয় তবে তা আমাদের নির্বুদ্ধিতারই অকাট্য প্রমাণ রূপে অতীতের বেদনার মতোই ভবিষ্যতের অনপনেয় এক লজ্জা বটে!
হরিপদ দত্তর ‘জš§-জš§ান্তর’ উপন্যাসে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে পাসপোর্ট হারানো এক মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য আছে। আÍপরিচয় হারানোর প্রতীক সেই মানুষটি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য চেতনাকে। কিন্তু করুণ সত্য এটাই উপন্যাসের চরিত্র যা পারে ঔপন্যাসিক তা পারেন নাÑ আর সে কারণেই তাকে বয়ে বেড়াতে হয় অন্তহীন বেদনা। লিখতে হয় বেদনার গাথা।
ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং-এর ট্রেন টু পাকিস্তান, কৃষণ চন্দরের গাদ্দার কিংবা সাদাত হাসান মান্টোর লেখায় আমরা যে বীভৎস সাম্প্রদায়িকতার চেহারা দেখি দাঙ্গার তেমন বীভৎস চেহারা পূর্ব পাকিস্তানে দেখা যায়নি কিন্তু সংখ্যালঘু আক্রান্ত হয়েছে পূর্ব বাংলায়ও ফলে একটা সার্বক্ষণিক ভয়, আতঙ্ক, ভীতি তাড়িত এ মাটির সন্তানেরা পাড়ি জমিয়েছেন রাতের অন্ধকারে যে শান্তি ধামে সেখানে গিয়েও তারা সর্বস্ব হারা হয়েছেন।
পায়নি মানবিক মর্যাদা। ইতিহাসের এই দায়Ñ ভিকটিম হয়তো সাক্ষাৎ প্রতিপক্ষের কাঁধে চাপিয়ে সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন কিন্তু এর শেকড় সুদূর বিস্তৃত। সেই শেকড় এতই সুদূর বিস্তৃত যেÑ একুশ শতকের সূচনা লগ্নেও উপমহাদেশের গুজরাটসহ কোথাও কোথাও উত্থিত হয় হিংস্র আস্ফালনে।
২.
এক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন লেখক। সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে যেমন গ্রামে গেছেন, গেছেন মুক্তিযুদ্ধে।
কমিউনিস্ট নেতা দেবেন সিকদারের পরিণতি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। করেছেন কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক বদরুদ্দিন উমরের রাজনীতিও। তার জীবন এক বিচিত্র পরিভ্রমণ। আর এই সমস্ত পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে পরিস্র“ত হয়ে আসেন যে হরিপদ দত্ত তার পেটে শীতলক্ষ্যার জল। যে জল গঙ্গার জলের চেয়েও পবিত্র তার কাছে, তার জীবনে, তার অনন্য গর্ব খানেপুর গ্রামবাসীর জীবনেÑ যে-রকম গ্রাম ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেইÑ অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে।
আমার মনে হয়েছে আহা আমাদের এই দেশটি যদি সম্পূর্ণরূপে খানেপুর গ্রাম হয়ে উঠত তাহলে কতই না ভালো হতো, কতই না সুন্দর হতো এই দেশ! কিন্তু তা যে হয়নি তারই তো সাক্ষী এই বই। এই বইয়ে সংখ্যালঘু হিসেবে একজন হরিপদ দত্তর ব্যক্তি অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধÑ অনেক সংখ্যালঘুর বেদনা হয়তো এখানে অনুপস্থিত কারণ এই লেখক সারাটি জীবন কাটিয়েছেন সংখ্যালঘুত্বের উপলব্ধির বিরুদ্ধে। যতটা না তার বন্ধু তার ধর্মের লোকেরা তার চেয়ে বেশি বন্ধুত্ব অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনি উপলব্ধি করেন সর্বত্র তিনি ‘হিন্দু বলে গণ্য’ যতই ‘মানুষ বলে গণ্য’ হতে হবার অভিপ্রায় পোষণ করুন না কেন? চেষ্টা করুন না কেন? তার যে-পিতা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে যেতে রাজি হননিÑ সার কারখানার জন্য বাস্তুভিটে থেকে উচ্ছেদ হওয়া সত্ত্বেও সেই পিতাই স্বাধীন বাংলাদেশে দাঙ্গার কারণে দেশত্যাগ করেন অথচ এই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল তাঁর সন্তান। লেখক বলেছেন, ‘খানেপুর গ্রামে একটি রাজাকারেরও জš§ হয়নি।
’ তাসত্ত্বেও তার পিতাকে নির্বাসনে যেতে হয়। তার চিতাভস্ম শীতলক্ষ্যা নদী নয়, অন্যদেশের ভিটেয় বিলীন হয়।
এই সমস্ত পরিণতির পেছনে ক্রিয়াশীল যে রাজনৈতিক-অর্থনীতি তা এই লেখকের চেয়ে আর কারও ভালো জানার কথা নয়Ñ কারণ তিনি ছিলেন সমাজ বদলের রাজনীতির দীক্ষিত কর্মী।
মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে তিনি ঢুকে গেছেন মুসলিম ছাত্রীর হƒদয়ে। যে ছাত্রী উদ্বিগ্ন তার প্রিয় শিক্ষক বিধর্মী ‘হিন্দু’ বলে তার মৃত্যুতে একজন ভালো মানুষ দোজখের বাসিন্দা হবেন এই ভাবনায়! এতটাই ভালোবাসা পেলেন ব্যক্তি হরিপদ দত্ত কিন্তু জনবিচ্ছিন্নতায় তার রাজনীতি জনভিত্তি হারিয়ে সংখ্যালঘুর চাইতেও সংখ্যালঘুতে পরিণত হল কেন? এই ব্যর্থতার দায় কার? কাদের?
তার কিছুটা স্বীকৃতি তার লেখায় রয়েছে বটেÑ
‘আমি বিপ্লবী নই।
বিপ্লব ছিল আমার স্বপ্নে, রক্তে নয়। তাই নতুন ঠিকানা শিক্ষক এক সিনিয়র মাদ্রাসায়। সে আরেক জগৎ। তবে সে সময় তালেবানি যুগ ছিল না। আমি দ্বিধাহীন স্বীকার করছি শিক্ষকতা জীবনে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যতখানি সম্মান বা মর্যাদা পেয়েছি তা পনের আনাই সেই মাদ্রাসায়।
নম্রতা, ভদ্রতা, আদব-কায়দা যতটুকু দেখেছি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা সেখানেই। ’ (জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তর, পৃ. ৭৫)
‘তবু আজ দীর্ঘদিন পর সেই মাদ্রাসার কথা আমার মনে পড়ে। মায়া হয়। ভালোবাসা জাগে। মনে হয় কি যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি।
যা হারিয়েছি তা ছিল আমার প্রিয়। ’... (জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তর, পৃ.৭৭)
না, এই মাদ্রাসা নিশ্চয়ই দেশের সবগুলো মাদ্রাসার চিত্র নয়Ñ নিতান্তই একটি মাদ্রাসার চিত্র যেখানে তিনি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তো সেই মাদ্রাসাগুলোও কিভাবে হয়ে উঠল তালেবানি আর কি করেই বা প্রগতিশীল বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষেরা ‘পেকে’ কিংবা ‘পঁচে’ বুর্জোয়া দলগুলোর তল্পিবাহকের তালিকায় নাম লিখিয়ে মন্ত্রিত্বের খাতায় নাম তুলে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি হলেনÑ সমাজ না বদলে, বদলে দিলেন কেবল নিজেদের। তারা বদলেও গেলেন, আর বদলেও দিলেন কিন্তু বদলালো না গণমানুষের ভাগ্য!
এ বইয়ে এই বদলে যাওয়ার চিত্র আছেÑ কিন্তু বদলে যাওয়ার পটভূমি আবছায়া, অধরা, অশরীরী যেন। একটি স্থানে সামান্য উঁকি দিয়েছে কারণটি, পিতার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের উল্লেখে।
উল্লেখ করছিÑ
‘আজো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, জিয়াউর রহমানের যুগের প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের গ্রামের এমন একজন যুবক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল যার পিতা গরু চুরির অপরাধে সাজা ভোগ করতে গিয়ে জেলখানায় মৃত্যুবরণ করে। সেই যুবকও ডাকাতি করতে গিয়ে গুলি করে মেরেছিল এক বৃদ্ধকে। নির্বাচনে জিতে যুবকটি গিয়েছিল আমার পিতার কাছে দোয়া নিতে। ... উদ্ধত কণ্ঠে বাবাকে সে বলেছিল, ‘মনুমিঞার (আহমদুল কবির) রাজনীতি শ্যাষ। ’ শুনেছি বাবা নাকি মনে মনে বলেছিলেন, আর এই দেশে থাকা যাবে না।
’ (জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তর, পৃ. ৯৫)
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শেরে বাংলানগরের সুরম্য ভবন এদেরই অভয়াশ্রম বটে আজ! জাতিস্মরের স্মৃতির ভেতর থেকে এদেরকে শনাক্ত করার এবং এদের প্রতিরোধে করণীয় কাজে অবতীর্ণ হওয়ার কোনও বিকল্প কি আছে?
‘মনুমিঞার রাজনীতি শ্যাষ!’ বলে যারা উঠে এসেছিল রাজনীতিতে তারই ধারাবাহিকতায় মনুমিঞার সহযোগীরা যখন ‘পেঁকে’ শাসক দলের পঙ্কেই পদ্ম হয়ে ফোটে তখন অনেক কিছুই তার গৌরব হারায়। সংকটে পতিত হয় বাঙাল অপুর অস্তিত্ব। তাই সত্য ব্যক্ত এভাবেÑ
‘‘আজ আমার ভীষণ লজ্জা। আমি তো সাহস করে উচ্চারণ করতে পারি না, ‘যতখানি আমি হিন্দু তার অধিক আমি একজন বাঙালি। ’ আমি বলতে পারি না, ‘অযোধ্যা নগরীর চেয়ে পবিত্র আমার এই ঢাকা শহর।
অযোধ্যার রামমন্দিরের চেয়ে পবিত্র আমার গ্রামের বটতলার আচ্ছাদনহীন দরিদ্র দেউল। এই ভূমিই আমার মাথা নত হবার ঠিকানা। অন্য কোথাও নয়’
(জাতিস্মরের জš§ জš§ান্তর, পৃ. ৮৪)
‘‘ ...আমার কাছে বাংলাদেশের চেয়ে পবিত্র ভূমি পৃথিবীতে কোথায় আছে?”
(জাতিস্মরের জš§ জš§ান্তর পৃ. ৮৩),
“...একবার মাত্র, একবারই কেবল কটা মাসের জন্য জেনেছিলাম বাংলার মাটির চেয়ে পবিত্র মাটি পৃথিবীর কোথাও নেই। বাঙালি একটি ভূখণ্ডকেই মাথা নত করে সালাম জানায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সালটি ছিল একাত্তর।
”
(জাতিস্মরের জš§ জš§ান্তর, পৃ. ৮৫)
বাংলার মাটি, বাংলার জন্য ভগবানের আশীর্বাদে পুণ্য হয়ে উঠেছিল যে একাত্তরে সেই একাত্তরের চেতনাকে সঙ্গী করে ঐ বাঙাল অপু তার শীতলক্ষ্যা নদীকে গঙ্গার চেয়ে পবিত্রতায় উপলব্ধি করে তারই সুদীর্ঘ বয়ান নিয়ে উদ্ধৃত করছিÑ
‘‘তবু আমি শীতলক্ষ্যার কাছে বারবার ফিরে যাই। এই নদীর জলেই মিশে আছে আমার হাজার বছরের পূর্ব পুরুষের চিতাভস্ম। আমার বাড়ি নেই, কিন্তু টিকে আছে আমার জš§ গ্রামের অবশেষ অংশ। ওখানে আমি আজ অচেনা আগন্তুক। আমার গ্রামের বর্তমান প্রজš§ যারা আমার অচেনা, যারা আমাকে মুসাফির ভাবে তারা জানে না এই খানেপুর গ্রামের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের প্রসবরক্ত।
শীতলক্ষ্যা থেকে কি আমার পিতা কিংবা স্বর্গের ঈশ্বর আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন। কেউ পারেনি। পারবেও না কোনোদিন।
কেন পারবে না? আমার জš§গ্রাম খানেপুর। সেই গ্রামে, সে গ্রামের একাত্তরের একজন রাজাকারও জš§ নেয়নি।
জš§ নিয়েছিল বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধা। তো সেই যে ’৬৪-এর দাঙ্গার কথা বললাম তখন আমাদের গ্রামের রূপকথার জš§ হয়। আজ আমি যে কাহিনীর কথা বলবো হয়তো অনেকে তা বিশ্বাস করতেই চাইবে না। এক বিকালে আমার পাড়াতো চাচা তাহের ভূঁইয়া আমাদের বাড়ি এসে হাজির। হাতে লম্বা দা।
আমার বাবাকে ডেকে তাহের চাচা ক্ষুব্ধ স্বরে জানতে চান, ‘অ মাস্টার, শুনলাম উত্তরপাড়ার যোগেন্দ্র নাকি হিন্দুস্থান পালানোর মতলবে আছে?’ বাবা ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিলে তাহের চাচা বাম হাতে দা, ডান দিয়ে বাবার হাত ধরে নিয়ে চলেন উত্তরপাড়া। যোগেন্দ্রের বাড়ি পৌছে তাকে কাছে ডেকে খুবই ঠাণ্ডা মেজাজে জানতে চান, ‘কিরে যোগেন, তুই নাকি হিন্দুস্থান চলে যাওয়ার জন্য বাড়ি জমিন বেচার তালে আছস?’
যোগেন্দ্র বিষণœ গলায় জানায়, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চলে যাচ্ছে তাই সেও যাবে। হঠাৎ তাহের চাচা দা উঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘সাবধান যোগেন, এক পা বাড়াবি তো জবো করে ফেলব। বেঈমান, শীতলক্ষ্যা গাঙের পানি তোর পেটে যায় নাই? যার পেটে এই গাঙের পানি পড়েছে সে কি পারে রায়ট করতে? সে কি পারে খানেপুর গ্রাম ছেড়ে পালাতে?’
তাই তো বলি, এ হচ্ছে রূপকথার মতো। যোগেন্দ্র পালাতে পারেনি হিন্দুস্থান।
তাহের চাচা পাহারা দিয়ে তার পালানো আটকে দিয়েছিলেন। এই তো আমাদের শীতলক্ষ্যা নদী। এর জল যার পেটে পড়েছে সে আর যা হোক সাম্প্রদায়িক হতে পারেনি। আর আজ আমাদের নদীকে হত্যা করা হয়েছে। শিল্পবর্জ্য তার জলকে করে দিয়েছে বিষেল।
তবু সে আমার নদী। আমার জš§-জš§ান্তরের নদী। যখন যেখানেই প্রাণ যায়, অন্তিম ইচ্ছা এই নদীর জলেই যেন মিশে যায় আমার চিতাভস্ম। ”
(জাতিস্মরের জš§-জš§ান্তর, পৃ. ২০৪-২০৬)
এই সুদীর্ঘ উদ্ধৃতির শেষে ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই কথাটি স্মরণ করছিÑ তিনি লিখেছেন ‘পালিয়ে কেউ বাঁচে না, আÍসমর্পণ করেও না, বাঁচতে হলে বিদ্রোহ করে বাঁচতে হয়’Ñ সব দেশে সব কালে অধিকার লড়ে নিতে হয়। অধিকার অর্জনের করে নিতে হয়।
বাঙালি অপু সেখানে নিঃসঙ্গ এক যাত্রী। তবু তার সে লড়াইয়ের আÍিক বিবরণ, আÍিক দলিল হয়ে ওঠে এই গ্রন্থ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।