মনের মধ্যে লুক্কায়িত কোনো ভাব -ভাষা সুরের মাদ্যমে প্রকাম করাই সংগীত বাগান। মনের মধ্যে যখনই কোন ভাবের উদয় হয় তখনই মুখ দিয়ে গানের সুর গু নগু নিয়ে বের হয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথের গানের বরাত দিয়েও বলা যায় ‘কার ছোঁয়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়, কাঁপে হৃদয় তাই রে, গু নগু নিয়ে গ্ইারে। ’
হ্যা, সেই ছোট বেলা থেকেই মনে হয় মাঠে-ঘাটে পথে -প্রান্তরে অর্থাৎ ঘরে বাইরে গু নগুন করেছি এবং এখনও করি। হয়ত কিছু বুঝে আবার কিচুটা না বুঝেই।
আর হবেই বা না কেন ? মনোযোগ সহকারে খেয়াল করলে অনুরাবন করতে সহজ হবে যে প্রকৃতির প্রতিটি স্থানে প্রতিটি জিনিষের মধ্যে প্রতি নিয়ত সুরের অনুরধন। কোথাও কোথাও বৈসাদৃশ্য মনে হলেও তার মাঝেও একটি অনন্য একক বা বৃন্দ সুর মূর্ত হয়ে ওঠে অর্থাৎ সুর ছাড়া কোন কিছু মনে হয় কল্পনা করাও যায় না। এবং সে কারণেই প্রকৃতির অংশ হিসাবে আমার আপনার সকলের মধ্যেই সুর আছে, সুরে ডুবে আছি আমরা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সংগীত মনোভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম উপায়। আমরা যখন কবিতা পাঠ করি, তখন তাহাতে অঙ্গনীনতা থাকিয়া যায়;সংগীত আর কিছু নয়- সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে কবিতা পাঠ করা।
’ সাধারণভাবে বলা যায়- মনের ভাব ভাষার মাধ্যমে ছন্দের আকারে ব্যক্ত করা কবিতা, সেই কবিতা ভাব ও ভাষা মোতাবেক সুর সৃষ্টি করে ভাবটি অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই গানের বৈশিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংগীত চিন্তা পুস্তকে ২ ও ত পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন “ আমাদের কষ্ঠ-নিঃসৃত বিভিন্ন স্বর বিভিন্ন মনো বৃত্তির শরীরগত বিকাশ। আমাদের মনোভাব বেগবান হইলে আমাদের কন্ঠস্বর উচ্চ হয়, নইলে অপেক্ষাকৃত মৃদু থাকে। উত্তেজনার সময় আমাদের গলার স্বরে আমেজ আসে। সচরাচর সামান্য বিষয়ক কথোপকথনে তেমন সুর থাকে না।
বেগবান মনোভাব সুর আসিয়া পড়ে। রোষের একটা সুর আছে, উল্লাসের একটা সুর আছে। সচরাচর আমরার যে স্বরে কথাবার্তা কহিয়া থাকি তাহাই মাঝামাঝি স্বর। সেই স্বরে কতা কহিতে আমাদের বিশেষ পরিশ্রম করিতে হয় না। কিন্তু তাহার অপেক্ষা উঁচু বা নীচু স্বরে কথা কহিতে হইলে কন্ঠস্থিত মাংশ পেশীর বিশেষ পরিশ্রমের আবশ্যক করে।
মনোভাবের বিশেষ উত্তেজনা হইলেই তবে আমরা আমাদের স্বাভাবিক মাঝামাঝি সুর ছাড়াইয়া উঠি বা নামি। অতএব দেকা যাইতেছে বেগবান মনোবৃত্তির প্রভাবে আমরা স্বাভাবিক কতাবার্তার সুরের বাইরে যাই। ” যা হোক অন্যত্র তিনি বলেছেন ‘আমাদের মনোভাব গাঢ়তম তীব্রতম রূপে প্রকাশ করিবার উপায় স্বরূপ সংগীতের স্বাভাবিক উৎপত্তি। যে উপায়ে ভাব সর্বোৎকৃষ্টরূপে প্রকাশ করি, সেই উপায়েই আমরা ভাব সর্বর্োৎকৃষ্টরূপে অন্যের মনে নিবিষ্ট করিয়া দিতে পারি। অতএব সংগীত নিজের উত্তেজনা প্রকাশের উপায় ও পরকে উত্তেজিত করিবার উপায়।
”
রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম ও একেশ্বরবাদী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে তাঁর আত্মত্যাগ, স্রষ্টার প্রতি নিবেদন, উৎসর্গের মহিমায় মহিমান্বিত। আমার তো মনে হয় মানুষ্য জীবনে এমন কোন মুহূত ‘অর্থাৎ জীবন-মরণ, সুখ দুঃখ, ভাব-ভালোবাসা, বিরহ-মিলন, প্রেম-বিচ্ছেদ কষ্ট-আনন্দ ইত্যাদি ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্র-চিন্তা বিচরণ করে নাই বা গানে প্রকাশ করে নাই।
প্রসঙ্গত তিনি বলেছেন যে আমি এক জনমে তিন জনমের কাজ করে গেলাম। পরজনমে যেন বাংলাদেশে জন্মি তা’হলে আমাকে আর কাজ করতে হবে না।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় গানের মধ্যেই স্রষ্টার প্রতি অবিচল আনুগত্য ও অনুরাগ, প্রেম ও নিবেদনের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর দর্শন ভাব আবেগ ও ভাষা সম্পর্কে ভালভাবে জানা দরকার বলে আমি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ রচিত গীত বিতানে প্রায় আড়াই হাজারের মত বৈচিত্রময় গান আছে, এগুলি তিনি নানা পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেমন- পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, বিচিত্র, আনুষ্ঠানিক, কাবা-নাট্যাংশ ইত্যাদি। অনেকে মনে করেন- রবীন্দ্র সংগীতের সুর এক ঘেয়ে, কিন্তু তাঁরা হয়ত ঠিক জানেন না যে রবীন্দ্রনাত তাঁর সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে সকল রাগ-রাগিনী, উপমহাদেশের প্রাচীন সংগীত, লোক সংগীত, রাউল, মরমী গানসহ দেশী - বিদেশী সকল প্রকার সংগীত নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তা তাঁর সংগীত প্রকাশ করে গেছেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের গানে যে বৈচিত্রময় সংগীত বিদ্যমান তা কোন বাংলা গানে একেবারেই অনুপস্থিত।
এক্ষেত্রে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সাধারণভাবে প্রচলিত কিছু রবীন্দ্র সংগীত শুনে এ সম্পর্কে কোন প্রকার মন্তব্য করা একেবারেই অনুচিত। বরীন্দ্রনাথের গান ভিন্ন ভিন্ন আমেজের বা স্বাদের এবং নানান চন্দে তালে গীত হয়। গতানুগতিক প্রচলিত তালের বাইরে তিনি কিছু নূতন ণূতন অনবদ্য তাাল সৃষ্টি করেছেন, যেমন-ঝস্পক, ষষ্টি (৪/২ ছন্দ) রূপকড়া, নবতাল, একাদশী নবাপঞ্চতাল। দেশের যে কি অবস্থা হচ্ছে তা আপনারা সবাই আজ বুঝতে পারছেন। খুন, ধর্ষন, বলাৎকার, হাইজেকিং কিডনেপিং, মাদকপান রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে যেমন বাংলা ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান দরকার এবং তার গানের ভাষা ও আকুতি অনুধাবন করতে হলে তাঁর গানের ভাব হৃদয়ে গ্রহণ করে অনুভব করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সংগীত সৃষ্টিতে জ্ঞানী গুনীজনকে অবাক হতে হয়। তাঁর প্রতিটি গানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক সুক্ষ মেলবন্ধনের আভাষ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর নিবেদনের মনোভাব যে ভাষায় ব্যক্ত করেছেন ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তেমনই যথাযথ সুর সৃষ্টি করে গেছেন- যা’ থেকে বিচ্যুত হলে তাঁর গান আর তাঁর গান থাকে না। এ কথা মানতেই হবে ব্যক্তিগত গায়কীতে অনুমোদিত সুরের শতভাগ প্রকাশ করা সম্ভব নাও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ গীতালী সংস্থার উদ্বোধনী ভাষণে ‘সানুনয় অনুরোধ’ করেছিলেন- ‘আমার গান যাতে আমার গনা বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো।
আরো হাজার গান হয়তো আছে-তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি-তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান গুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য।
’
রবীন্দ্রনাথ তা৭র আশি বছর বয়সের মধ্যে বাংলাদেশের বহুস্থান ঘুরে দেখেছেন, প্রকৃতির রূপ-রস আস্বাদন করেছেন। এরই মধ্যে তিনি স্রষ্টার মহিমা খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর অনুগ্রহ পেতে নিবেদিত চিত্তে তাঁর গুনগান তিনি গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। বাংলার পথে-প্রান্তরে বাউলের উদাসি সূর রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছে তাই তিনি বাংলার বাউল সম্্রাট লালন ফকির ও গগন হরকবর গানের সুর মাধুয অনুসরণ করে অনেক হৃদয়গ্রাহী গান সৃষ্টি করেছেন। যেমন-গ্রাম ছাড়া এই রাঙামাটির পথ, আমার সোনার বাংলা, তোমার খোলা হাওয়া, আমার মন যখন জাগলি নারে ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন।
সেই সব দেশের মোহময় সুরকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে তিনি সাফল্যের সাথে বেশকিছু অসাধারণ গান রচনা করেছেন-যার সুর মূর্ছনা মনকে আলোড়িত করে, মুগ্ধ করে, যেমন- ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু রায, কতবার ভেবেছিনু, কেনগো সে মোরে যেন, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ইত্যাদি।
প্রচলিত অন্যান্য গানের মত রবীন্দ্রনাথের গানে তাল্লয় সবই আছে। তবে বর্তমানে পাশ্চাত্য ও আধুনিক বিশ্বে ঘুম-ধাড়াক্কার সংগীত ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কর্ণ-বিদারী শব্দ- যন্ত্রের ঝন্ঝনানিতে যদি কেউ আনন্দে আপ্লুত হয় তবে হোক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু রবীন্দ্র সংগীত নিবেদনের ক্ষেত্রে বিকট উচ্চ শব্দের যন্ত্রের ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। কারণ এই শব্দে স্লায়ুর উত্তেজনা এবং হৃদ-কম্পন বেড়ে যেতে পারে, সংগীতের মাধুর্য বিলীন হয় এবং গানটি গৌন হয়ে পড়ে।
বৈতালিক গানগুলোতে তাল যন্ত্রের ব্যবহার না করলেও তাল জ্ঞান অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। রবীন্দ্র সংগীতে যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গানের মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এস্রাজ, তালযন্ত্র হিসেবে খোল-তবলা ও মন্দিরা থাকতে পারে। মজার কথা অবৈজ্ঞানিক বলে হারমোনিয়ামকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কেননা রবীন্দনাথের গানে আবেগ মন্ডিত একসুর হতে অন্য সুরে গড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মীড়ের বিষয়টি হারমোনিয়ামে নেই, এস্রাজে পাওয়া যায়।
বরীন্দ্রনাথের গান যদি কাউকে করতেই হয় তাবে তাঁকে অবশ্যই গানের ভাষা-ভাবকে বুঝতে হবে।
সেই ভাব-ভাষাকে হৃদয়ে গ্রহণ করে আরোপিত শুদ্ধ সুরের মাধ্যমে যথাযথ তাল-লয়ে প্রকাশ করতে হবে, যা'তে সেই সুর অপরের হৃদয়ের গভীরে পৌছে নাড়া দিতে পারে।
‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর-রবীন্দ্রনাথ সরার জীবনে সীমার মাজে অসীমের সুর সন্ধান করেছেন। তিনি ছিলেন সীমার সাথে অসীমের মিলন প্রত্যাশী। রবীন্দ্রনাথ মহাসত্য জন্ম ও মৃত্যুকে উপলদ্ধি করেিেছলেন গভীরভাবে যেমন তাঁর গানে প্রকাশ পেয়েছে যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে, আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে। বুঝিবা এই বজ্র রবে নুতন পথের বাতা করে, কোন পুরাতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি।
’ তাই তো তার গানের ভাষা বাহুল্য বজিত, মার্জিত ও পরিশীলিত। তার গানের ভাব ও ভাষা অনুসারে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-মিলন নিবেদন ইত্যাদি বিসয়ে সুরের প্রকাশভঙ্গি উদার, নমনীয়, পরিমিত ও যথার্থ। রবীন্দ্রনাথের গান যেন তা৭র সারা জীবনের সাধনার ধার। রবীন্দ্রনাথের গান অযাচিত-বিক্ষিপ্ত- উদ্বেগ দূর করে, মনকে হালকা করে, মনের উত্তেজনা বৃদ্ধি করে না বরং প্রশমিত করে, অনির্বচনীয় সুর মাদুর্যে হৃদয় মন উৎফুল্ল হয়। রবীন্দ্র সংগীতের স্লিদ্ধ অনুরণন হৃদয়ে দীঘৃতর শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।
সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের গান যে কোন মানুষকে এক অনির্বচনীয় উপলব্ধিতে নিমজ্জিত করে, হৃদয়কে গভীর বোধে আবেগাপ্লুত করে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।