আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবীন্দ্রনাথের রঙ

ছায়ায় হারাই

২৯ জানুযারি/০৯ পাঠ- কিছু রঙের প্রতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত ছিল। তিনি সংস্কৃতজাত শব্দের ভূবন থেকে রঙের শব্দ ধার করতেন। কখনো পারস্য থেকেও নিয়েছেন। বাংলাদেশে সাধারণ লাল ও সবুজের ব্যবহার খুব বেশি হয়। তিনি তা করেননি।

তিনি রাঙ্গা ও শ্যামল শব্দদুটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। বিস্তৃত ছায়ার প্রকাশে শ্যামল এসেছে তার হাতে। এই শব্দটা নিয়েছেন পাতা থেকে, মাটি থেকে, মানুষের গা থেকে। এটা তিনি একটা প্রতীকের মতো ব্যবহার করেছেন। তার সবুজের ধারণাটি অন্যাদের চেয়ে ভিন্ন।

লাল রংটিকে তিনি ব্যবহার করতে চান অনেকটা পরোক্ষে- ব্যতিক্রমী ঢঙ্গে। যখন সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের বর্ণনা করেছেন তিনি বারবার হতাশ এবং অসহায় বোধ করেছেন নির্বাচনে। তিনি এক্ষেত্রে সোনালী রঙের দিকে গিয়েছেন। তার ল্যান্ডস্কেপে তাই হলুদ অথবা কমলা-হলুদ এসেছে। তার কবিতা ও গানে লাল বেদনার প্রকাশমাত্র।

বসন্তের বিরহকে সম্ভবত কিঙ্শুক ফুলের লালের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। খুব কমই লালের উদাহরণ আছে তার গদ্যে। যেমন- লালচে চোখ, রাগী, হতভম্ব বা ব্রীড়ানত লাল মুখ। এভাবে বলেননি তিনি। মানুষের মুখকে তিনি অন্যদের চেয়ে অন্যতরভাবে দেখতে পেতেন।

রাতের রঙ প্রকাশ করেছেন লালের মধ্যে দিয়ে- এটা সাধারণত দেখা যায় না। কৃষ্ণচূড়া পাতা নিয়ে বলেছেন। বলেছেন- তার পাতার উপরের ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার কথা, সূর্যের আলো কথা, রাতের ডালপালার কথা। কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলের কথা এড়িয়ে গেছেন। বহুদেশ ঘুরেছেন।

কিন্তু ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায় হেমন্তের পাতার বর্ণনা তিনি ঘুনাক্ষরেও বলেননি। ধ্বংস ও মৃত্যুর রঙের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। অন্ধকারকে এঁকেছেন লাল রঙে- এটি নেতির প্রকাশ। রক্তভীতির কারণে তিনি রক্তের বর্ণনা করেছেন কালোতে। ভয়ংকর সন্ত্রাস এবং আগ্রাসনের প্রকাশ হিসেবে তিনি অন্ধকারকে দেখেছেন।

তাই তিনি করেছেন কালো। র্নিলজ্জতা, রাগ, মৃত্যু, সন্ত্রাস, রোগের প্রকাশে এসেছে লাল রঙ। এটা নেতির দৃশ্যেকল্পে এসেছে। অশুভের বিপরীতে শুভময় লালের কথা ভেবেছেন। তিনি তা বলেছেন তীব্র ঝংকারে।

রাঙ্গা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে, রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল। ৩০জানুয়ারি/০৯ পাঠ- রবীন্দ্রনাথের লালের বহুরকম বিন্যাস। কখনো তীব্র, কখনো হালকা। ধ্বনির সুতায় বাঁধা। মাঝে মাঝে খেয়াল করে দেখা গেছে কখনো রঙের বর্ণনায় ধ্বনিপ্রভাব, কখনোবা ধ্বনিদৃশ্য ব্যবহার করেছেন।

আবার কখনো এদুটোকেই ব্যবহার করেছেন সম্মিলিতভাবে। যেমন- "রক্ত রঙ্গের কিঙ্কিণীঝংকার" পড়লে কানের মধ্যে দিয়ে মর্মে এসে লালের ধারনাটা আসে। এখানে ধ্বনিময়তার মধ্যে দিয়ে দৃশ্যের অনুভতিটা আসে। নীল রঙ রবীন্দ্রনাথের প্রিয়। আনন্দের প্রকাশে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে প্রয়োগ করেছেন নীল।

এই নীল রঙ যেন টিকে থাকার লড়াইয়ের আকাশ- অস্তিত্বের কবজ। "তবু, হে অপূর্ব রূপ, দেখা দিলে কেনো কে জানে-"" এ গানটি তিনি নীলমণি লতাটিকে দেখে করেছেন। এটা পরিস্কার যে, তিনি লাল রঙের কারণে ভাবনাটি পাননি। শান্তি নিকেতনে নীলমণি লতা এখনো ফোটে। নীলমণি নীল নয়-বেগুনী।

নীলের চেয়ে বেগুনী রঙটিই ঠিক মনে হয়। লাল রঙ যখন গাঢ় হয়ে কালচে হয়ে ওঠে তখন তিনি তাকে বলেছেন বেগুনী এবং গোলাপী। এদুটো রঙই তার কাছে রক্তের কালচে এ রঙটির যথার্থ প্রকাশক। এটি তার কাছে নীলের পরিবর্তিত মোহিনী রূপ। নীল তার অস্তিত্বের প্রতীক।

নীল হল- রূপ, নীল হল- লাবণ্য, নীল হল- আনন্দ। লাল হল- অজানা। -অদেখা। লাল দুঃখ এবং ব্যথার অনুভূতির সংগে জড়িত। লাল রঙের বিষয়ে তার ছিল নানা অস্বস্তি।

এটা নানাভাবে বলেছেন। তোমার অশোকে কিংশুকে অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে। এটা বলেছেন ফাল্গুনে- বসন্তের প্রথম মাসে। এই লেখার পেছনের আসল ভাবনাটিকে না জেনেও অনেকে গেয়ে যান। রক্তকরবীর নাটকে রক্তকরবী ফুলের লাল রঙ শক্তির প্রকাশক।

ইচ্চাকাঙ্খার প্রকাশক। এটা অনেকটা রহস্যের ঘেরাটোপে লুকানো, পলায়নপর এবং ভীতিকর। ভয়ংকর সুন্দর- ট্রাজেডি এবং মৃত্যুর সংগে সম্পর্কিত। নাটকে রাজা এই রঙের অর্থ জানতে অয়ংকর হয়ে উঠেছেন। নীল এবং হলুদও তার পছন্দ।

সরিষা ক্ষেতের রঙ দেখে গেয়েছিলেন- "নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগল"। লাল বা যে রঙে কালোর প্রাধান্য আছে অথবা যে রঙ তার কাছে অপেক্ষাকৃত জটিল সে রঙটি প্রকাশ করতে রঙিন শব্দটি বেছে নিয়েছেন। এ শব্দটি তার নিজস্ব। মেঘের রঙ তার কাছে রঙিন। তিনি মেঘের আসল রঙ এড়িয়ে গেছেন।

এই যে মেঘের পরে মেঘ জমে- ক্ষণে ক্ষণে মেঘের রঙ পাল্টে যায়- এজন্যে মেঘের নির্দিষ্ট রঙ প্রকাশের দিকে যেতে চাননি। এটাই তার নিজের ধরণ- নিজস্ব মিথ। তার কবিতা ও গানে রঙিন মেঘ একটি শক্তিশালী প্রতীক। আসলে কিন্তু আকাশে মেঘের বহুবর্ণিল বিন্যাস কদাচিৎ দেখা যায়। তিনি তার লেখায় মেঘের এই নানারঙের বর্ণনা করেছেন কখনো কখনো, কিন্তু ছবিতে একদম বাদ।

রঙ- রঙিন শব্দটি একাট শক্তিশালী প্রতীক। বহু অর্থে ব্যবহার করেছেন। করূণ বা বিষাদ বোঝাতে রঙিন শব্দটি এনেছেন। রঙিনের মধ্যে কিছু লালের অংশ আছে। রঙ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের আচ্ছন্নতা আছে।

বহু রঙের সঠিক বর্ণনায় তিনি ব্যবহার করেছেন "নানা রঙ"। এখানে আলাদা আলাদা করে রঙগুলির বিবরণ দেননি। মৌখিক ও দৃশ্য রচনায় আলো ও অন্ধকার, ছায়া ও জ্যোৎস্নার চমৎকার শব্দকোষ তিনি নির্মাণ করেছেন। সাহিত্য ও চিত্রে বারবার আলো বনাম অন্ধকার ঘুরে ফিরে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আকাশের বিস্তার ও তারাপুঞ্জ নিয়ে অন্য কবিদের লেকাজোকা তাঁর কাছে স্থুল।

দেখা ও অদেখা নিয়ে তার বিস্তৃত ভাবনা আছে। পবিত্রতাকে স্পর্শ্ব করতে "অদেখা" শব্দটিকে একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। অশুভের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে শুভর দেখা পেতে অদেখা শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। অদেখা শব্দটি ঈশ্বরের রূপক। এছাড়াও অদৃশ্যমান প্রভু- আঁধার ঘরের রাজাও অদেখা।

এটা রাজা নাটকে পাওয়া যায়। রাজার সংগে সুদর্শনার যে সম্পর্ক- আসলে মানুষ ও ঈশ্বরের সাথে সেই একই সম্পর্ক। যতক্ষণ না তার দেখা না পাওয়া যায়, ততক্ষণ তাকে দেখতে হয় অনুভূতি দিয়ে। লাল রঙ বিষয়ে ঠাকুরের যে ধারণা এটা তার সমগোত্রীয়। ঐশ্বরিক অর্থের অস্তিত্বকে আমরা বাদ দিতে পারি না।

কিন্তু তার অনুভতির অভিজ্ঞতা দিয়ে ঈশ্বরের প্রচলিত মিথকে তিনি বাদ দিয়ে ঘরের মানুষ করে তুলেছেন ইশ্বরকে। ঈশ্বর এখানে দূরের কেউ নন, আপনার জন। আনন্দ বেদনার ভাগ নেওয়া যায় তার সাথে- তাকে ভালবাসা যায়, অভিযুক্তও করা যায়। ঈশ্বরকে রকে দেখে ফেললে এই বহু ভাবনাটির অপমৃত্যু হয়ে যায়। তাই দেখার ইশ্বরের চেয়ে অদেখাই ভাল।

দেখুন- Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।