প্রতিদিন যা পড়ি পত্রিকার পাতায়, ভাললাগা-মণ্দলাগা সবই শেয়ার করি সবার সাথে। ডিসিরা দেশে কার্যত একটি সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছেন। সুপ্রিম কোর্টের অধীনেই এই রিপাবলিকের বিচারিক ক্ষমতার শতভাগ অনুশীলন ঘটবে—এটা মানতে আমলাতন্ত্রের দারুণ আপত্তি। এ জন্য বিচার বিভাগ পৃথক্করণ বানচাল করতে তাঁরা সর্বাত্মকভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু এটা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
শক্তিশালী প্রশাসন ক্যাডার কিন্তু অসফল নয়। তাঁদের ঝুড়িতে ইতিমধ্যে অনেক সাফল্য জমা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অধ্যাদেশের একটি তফসিল আছে। এই তফসিলের মেদ ক্রমে বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁরা সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচারের দাবি জানিয়ে ছিলেন।
এখনই কিছু না ঘটলেও নিশ্চিন্তে থাকা যাবে না। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাইনি। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে আসবে। আর যদি ডিসিদের চাপে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হয়, তাহলে আম ও ছালা দুটোই যাবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ডিসিদের দাবি নিয়ে সরকার ভাবছে না।
এতে সান্ত্বনার কিছু নেই। কারণ, ডিসিদের স্বপ্ন ক্রমে বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ছিল তাঁদের জন্য এক সান্ত্বনা পুরস্কার। আমাদের কাছে এটা বিষবৃক্ষ। এই বৃক্ষ বিস্তৃত হয়ে চলেছে।
বিষবৃক্ষ একটি নয়, দুটি। একটির নাম ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্যটি ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় সংযোজিত ৪ উপধারা। এর অধীনে নির্বাহী হাকিমদের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা বা কগনিজেন্স পাওয়ার অর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ২০০৭ সালের অধ্যাদেশে ছিল না।
ওই দুটি বিষবৃক্ষই বিচার বিভাগ পৃথক্করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) নীতির পরিপন্থী। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের লঙ্ঘন। এ মামলাটি আপিল বিভাগে চলমান। আদালত অবমাননার জন্য আমলারা এখনো কাঠগড়াবিদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে নিচ্ছেন সাধারণতন্ত্রের (ড. আনিসুজ্জামান রিপাবলিকের অনুবাদ প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে সম্প্রতি সাধারণতন্ত্র ব্যবহার করেছেন) বিচারিক ক্ষমতা।
তাঁরা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে নিত্যনতুন আইন ঢোকাচ্ছেন। আর তক্কে আছেন, কখন কোন সুযোগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারার ৪ উপধারার আওতায় কগনিজেন্স পাওয়ার গলাধঃকরণের। ওই মোবাইল কোর্ট আইন এবং ওই ৪ উপধারাটি অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক উৎ স।
জরুরি অবস্থায় ডিসিদের তড়পানিটা কমজোরি ছিল। এখন তীব্রতা পাচ্ছে।
মোবাইল কোর্টে তাঁরা গোড়াতে শুধু অর্থদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা পান। তফসিলের পেটে ছিল দুই ডজন আইন। নির্বাচিত আমলে তাঁরা অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা বাগিয়ে নেন। এটা করে দেশে ‘দ্বৈত বিচারের’ পর ‘দ্বৈত দণ্ডনীতি’ চালু করা হয়েছে। আর এখন পারলে তাঁরা পুরো দণ্ডবিধিটাই ওই তফসিলের পেটে চালান করে দেন।
বর্তমানে শতাধিক আইন আছে। আরও তাঁরা বাড়াবেন। এখন নাকি তাঁরা কগনিজেন্স পাওয়ারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন।
কগনিজেন্স পাওয়ার মানে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, কগনিজেন্স পাওয়ার একটি বিচারিক ক্ষমতা।
এটা সর্বতোভাবেই বিচার-প্রক্রিয়ার অংশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই অভিমত দেন। তাহলেই প্রশ্ন, ডিসিরা ও তাঁদের অধীন নির্বাহী হাকিমরা কি বিচারক? ওঁরা বিচারক না হলে ওঁদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে কেন?
নির্বাহী বিভাগ প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ বিচার করবে। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও শাসনগোষ্ঠী এই মন্ত্র মানতে নারাজ।
সে কারণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণবিরোধী শক্তি বিয়াম মিলনায়তনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিচারিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে ডিসিদের তর্জনগর্জন সেই বিদ্রোহের সুতোয় বাঁধা। সেই থেকে তাঁরা ওত পেতে আছেন। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, খাবলা মেরে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।
নির্বাচনী অপরাধের বিচার বিচারিক হাকিমদেরই করার কথা।
কিন্তু গোপনে কোনো আলোচনা ছাড়াই জরুরি অবস্থায় নির্বাচনী আইনে ঠিকই ঢুকে পড়ে প্রশাসন ক্যাডার। বিচারকার্যের মাতব্বরিটা আমলাদের হাতেও থাকা চাই।
সম্প্রতি ডিসিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬০ ও ২৬২ ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশের তফসিলের পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার আবদার করেছেন। কিন্তু সিআরপিসির সংশোধন ছাড়া এটা করা যাবে না। অবশ্য তাতে কী।
কী করে সংসদে হাঁ জয়যুক্ত করাতে হয়, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। ওটা আমলাতন্ত্রের নখদর্পণে। সরকারি দলকে টোপ দেওয়া সহজ। সামনে নির্বাচন। ডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। তাঁরা বলতেই পারেন, ওটা আমাদের দিন। দেখুন আমরা কী করি। কারণ, তখন নির্বাহী হাকিমরা ‘নির্বাচনে ঘুষ’, ‘এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির ভোট দেওয়ার’ মতো নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচার করতে পারবেন।
সত্যি বলতে কি, আমলাচালিত কোর্টকে ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হয় না।
ক্যাঙারু কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর, তিনিই বিচারক। মোবাইল কোর্টেও তা-ই; বরং ক্যাঙারু কোর্টে আসামি আইনজীবীর সুবিধা পান। মোবাইল কোর্টে তা-ও লাগে না। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে ক্যাঙারু কোর্টগুলো আরও বুনো হয়ে উঠতে পারে। সিআরপিসিতে ১৯০ ধারার ৪ উপধারাটির সংযোজন তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি ছুরিকাঘাত।
এটা এক অব্যাহত হুমকি। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে দেশে রাতারাতি একটি ব্যাপকভিত্তিক সমান্তরাল বিচার বিভাগের জন্ম নেবে। মুহূর্তেই দেশের আদালতপাড়ার চিত্র বদলে যাবে। খুনখারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই, টেন্ডার-সন্ত্রাস কিংবা বাড়ি দখল—অপরাধ যতই জঘন্য হোক, ডিসিরা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা ইত্যাদি আমলে নিতে শুরু করবেন। এর সবচেয়ে বড় মজা ও মওকা হবে জামিন দেওয়া।
মন্ত্রীদের টেলিফোনে কত দিন তাঁর জামিন প্রদানের সুখবঞ্চিত!
বিচারের জন্য প্রস্তুত বা রেডি ফর ট্রায়াল বলে একটা কথা আছে। ওই ৪ উপধারা বলেছে, নির্বাহী হাকিমরা শুধু বিচারের জন্য কোনো মামলা বিচারিক হাকিমদের কাছে পাঠাবেন। এর আগেই অনেকগুলো পর্যায় পেরোতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তদন্ত ও জামিন। একই সঙ্গে একই ক্ষমতা দেশের বিচারিক আদালতগুলোরও থাকবে।
সুতরাং, পুলিশ ও টাউটরা মিলে একই মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ডিসি অফিস ও আদালত চত্বর দুই স্থানে লাইন লাগাবে। যেখানে সুবিধা পাবে, সেখানে তারা মামলা ঠুকতে পারবে। মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষরা এখন সাত ঘাটের পানি খেলে তখন খাবে চৌদ্দ ঘাটে।
আমরা অবশ্যই মনে রাখব, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়া সত্ত্বেও আদালত থেকে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে—এমন আস্থা জনমনে সৃষ্টি হয়নি। সে জন্য যথা ওষুধ লাগবে।
বিচার-বস্ত্র ডিসিদের হরণ করতে দেওয়া যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহ কিংবা সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তাঁদের আগ্রহের মামলাগুলো থেকে তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী তাঁরা আদালতে বেশ প্রতিকার পান। একইভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী অনেক কম প্রতিকার পান। এ অবস্থায় যখন আমরা বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছি, তখন আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে আরেকটি সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
সরকার এটা চাইলে সহজেই করতে পারবে।
বিরোধী দল এ নিয়ে লোক-দেখানো হট্টগোল করলেও রাস্তায় পিকেটিং করবে না, হরতাল দেবে না; পুলিশের সঙ্গে কেউ ধস্তাধস্তির ঝুঁকিও নেবেন না। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মোবাইল কোর্টকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন তখনই, যখন হরতালের পিকেটাররা মোবাইল কোর্টের মার খাচ্ছিলেন।
বর্তমান সংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতারা আমাদের অনেক ক্যারিকেচার দেখতে বাধ্য করছেন। সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের পুরোটাই অনন্তকালের জন্য সংশোধন অযোগ্য। এমনকি এগুলো হচ্ছে মৌলিক কাঠামো।
সাধু সাধু। অন্যদিকে ক্যাঙারু কোর্টের এমন অনেক বিধান আছে, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের ৩৫ অনুচ্ছেদের ভয়াবহ লঙ্ঘন। সংবিধান বলছে, কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো যাবে না। কিন্তু ওটাই প্রকৃতপক্ষে ক্যাঙারু কোর্ট চালানোর মূলমন্ত্র।
সাম্প্রতিককালে হরতালের পিকেটারদের যাঁদের জেল দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের রায়ে নির্বাহী হাকিমরা লিখেছেন, তাঁরা সবাই দোষ স্বীকার করেছেন।
এত বড় একটা ধাপ্পা ও প্রতারণাপূর্ণ বিচারব্যবস্থার নাম ভ্রাম্যমাণ আদালতব্যবস্থা। এর একটা জনপ্রিয় মুখোশ রয়েছে। নির্বাহী হাকিমরা মিডিয়া (এম্বেডেড) টিম নিয়ে, পুলিশ নিয়ে ভেজালবিরোধী অভিযান কিংবা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমে পড়েন। গরম গরম শাস্তির বিবরণ ছাপার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটি অংশ বুঝে হোক, না-বুঝে হোক আদিখ্যেতা দেখিয়ে থাকে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের বিরুদ্ধে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি যিনি দিয়েছিলেন, তিনি নাম কামিয়েছিলেন গরম গরম শাস্তি দিয়ে।
সামনে রমজান মাস। পুরান ঢাকার অনেক গলি-ঘুপচিতে ভেজাল সেমাই, মসলা ইত্যাদি হরেক রকম খাদ্য তৈরি হবে। এসবের বিরুদ্ধে ঘটা করে বিচার-ভ্রমণ শুরু হবে। দৃশ্যটা অনেকটা কোরবানির হাটে সাজগোজ করে গরু নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের মতো। একদল লোক পেছন পেছন হল্লা করে ছোটে।
লোকজন মজা পায়। ভেজালবিরোধী অভিযানের দৃশ্যটাও অনেকটা তা-ই। গরম গরম পেঁয়াজু খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি গরম গরম শাস্তি দেওয়ার দৃশ্য অবলোকন করার আমেজও অন্য রকম।
আমরা সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট নামের দ্বৈত বিচারব্যবস্থার অবসান চাই। ১৯০ ধারার ৪ উপধারার অবিলম্বে বাতিল চাই।
সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা দাবি করাকে ডিসিদের পক্ষে গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ বলে দেখা উচিত। বিচার বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল কোর্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের অবিলম্বে শুনানি আশা করি। ভারত ডিসিদের দ্বারা জজিয়তি না করিয়ে যদি সুশাসন ও প্রবৃদ্ধি দুটোই দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অক্ষম হবে কেন। আওয়ামী লীগের এটা মনে রাখা ভালো যে, তারা প্রশাসন ক্যাডারের স্বপ্নের ক্যাঙারু কোর্ট এবং ওই ৪ উপধারা বাতিল না করলে এসব অস্ত্র বিএনপি বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে।
এক মাঘে শীত যায় না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
প্রথম আলো ১/৮/২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।