আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশি কুটনীতিকের গাড়িতে ভারতীয় পতাকা -- পরজীবি দালাল নিমচন্দ্রের কাহিনী।

........................... মানবজমিন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০১১ ফেঁসে গেছেন নিমচন্দ্র মানবজমিন ডেস্ক: নারী কেলেঙ্কারি, স্কলারশিপ দিতে ঘুষ, অন্য দেশের পতাকা নিয়ে গাড়িতে ভ্রমণ করেই থামেননি নিমচন্দ্র ভৌমিক- মাওবাদী প্রসঙ্গে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছে। বলিউডের এক সময়ের সাড়াজাগানো নায়িকা মনীষা কৈরালার বাড়ির সামনে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতে না পেরে উল্টো দেনদরবার করে দেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছেন- এ আলোচনা সর্বত্র। তদন্ত প্রতিবেদনে স্থানীয় বেশ ক’জন নারীকে দূতাবাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিয়েছেন বলে বলা হয়েছে। নানা ঘটনার জন্ম দিলেও নেপালের রাষ্ট্রদূত পদে বহাল থাকায় নিমচন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও। নিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত হয়েছে।

গত মে মাসে দেয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। চার পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে নিমচন্দ্র ভৌমিকের যাবতীয় অকূটনীতিসূলভ আচরণের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেবো। শিগগিরই তদন্ত কমিটি কাঠমাণ্ডু যাবেন বলেও সংবাদ মাধ্যমকে জানান তিনি।

কি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাওয়া হলে এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস বলেন, ‘আমরা জানি, আমাদের কি করতে হবে। ’ তবে নিমচন্দ্র তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক নীলদলের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক নিমচন্দ্র বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালে নেপালের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ পান। এর আগে আওয়ামী লীগের গত সরকার আমলে তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ছাত্র বিক্ষোভের সময় তিন জন শিক্ষকের সঙ্গে নিমচন্দ্রও গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে রাষ্ট্রদূত ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক সমপ্রতি নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে অফিসিয়াল প্যাডে মুজিবনগর দিবস/স্বাধীনতা দিবস/পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান স্পন্সর করার আবেদন জানান মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়েই। তাদের কাছে দাবি করা হয়- ১) ডায়মন্ড স্পন্সরশিপ (দুই লাখ টাকা), ২) গোল্ড স্পন্সরশিপ (এক লাখ টাকা) এবং ৩) এসোসিয়েট স্পন্সরশিপ (৫০ হাজার টাকা)। দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়েই তিনি এভাবে ২০১০ সালে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। তিনি যেসব ইভেন্ট আয়োজন করেছেন তাতে খরচ হয়েছে ৩০ লাখ নেপালি রুপির কিছু বেশি।

অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে নগদ। কিন্তু সংগ্রহ ও তা খরচের খাতটি রয়ে গেছে অস্বচ্ছ। এ ঘটনাকে চাপা দেয়ার জন্য তিনি ২ থেকে ৩টি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর একটি কপিও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। নেপাল থেকে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসা ছাত্রছাত্রীদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

যদি কোন স্থানীয় ছাত্র সরাসরি আবেদনপত্র জমা দেয় তাহলে তাকে ভিসা দেয়ার কাজটি বিলম্বিত করা হয়। তখন অন্যরা তাদেরকে ঘুষ দেয়ার একই পন্থা অবলম্বনের কথা বলে। যারা শিক্ষা বিষয়ক কনসালটেন্সি করেন তাদের মাধ্যমে ওই ঘুষ দেয়ার কথা বলা হয়। নেপালি ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশ সরকার যে বৃত্তি দিয়েছে তা এভাবে ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অপব্যবহার করা হয়েছে। নেপালের ভিআইপি’র আবেদন, এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আবেদন তিনি অগ্রাহ্য করেছেন।

পরিস্থিতি এক পর্যায়ে এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে, ঢাকায় অবস্থানরত নেপালি ছাত্রছাত্রীরা পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্যাপক অভিযোগ আছে যে, বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি ৩৬ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলারের ৬টি বৃত্তি দেয়ার প্রস্তাব করে নেপাল সরকারের কাছে। এগুলো দূতাবাসের ঘনিষ্ঠ শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শক সংস্থার মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়া হয়। এভাবে নেপালে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খাটো করা হচ্ছে। ২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ড. ভৌমিক কাঠমাণ্ডুর প্রধান সড়ক রিং রোডে দুপুরে একটি সড়ক র‌্যালি বের করেন।

এমন আয়োজন কোন কূটনৈতিক সুবিধা এনে দেয় না। বিভিন্ন মিশনের প্রধানরা এবং ডিসিএমরা সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তারা এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেন। তারা দেখেন অগোছালো একটি আয়োজন। তারপর তারা শুরুতেই অথবা রাজপথ থেকে ফিরে যান।

ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ২০০৯ সালের শেষের দিকে এই দূতাবাসে যোগ দেন। তারপর থেকেই তিনি কাঠমাণ্ডুতে নিয়োজিত ভারতীয় দূতাবাসের কাউন্সেলর/মুখপাত্র মিসেস অপূর্বা শ্রীবাস্তবকে ত্যক্ত করতে থাকেন। বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত তাকে মাঝেমধ্যেই দিনের বেলায় অফিসে ডেকে পাঠাতেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলতেন। এমনকি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক তাকে বিরাটনগরে সফরে যেতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

এ বছর একবার তিনি শ্রীবাস্তবের বাসায় গিয়ে হাজির হন। তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন কোন পূর্ব সিডিউল ছাড়াই। কিন্তু তাকে ফিরে যেতে বলা হয়। বাংলাদেশী ৫ চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজন করা হয় পেইন্টিং এক্সিবিশন। সিদ্ধার্থ গ্যালারিতে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বলিউডের সুপরিচিত চলচ্চিত্র নায়িকা মনীষা কৈরালা।

ওই প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান শেষে ওইদিনই রাত প্রায় ৯টায় কোন ঘোষণা ছাড়াই ড. ভৌমিক গিয়ে হাজির হন মনীষার বাসভবনে। সেখানে তাকে গেটের বাইরে প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় মনীষার সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ ওই বাসার গেট খোলেনি। অভিযোগ আছে তিনি মাঝেমধ্যেই একাউন্ট্যান্ট হারুনুর রশিদের মোটরসাইকেলের পিছনে আরোহণ করেন। কেউ জানে না তিনি কখন কোথায় যান।

তবে একথা সবার জানা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাঠমাণ্ডুর নাচের ক্লাবে, রাতের অনুষ্ঠানে, লোকাল বারে যান। অনেক সময় তিনি বারে গিয়ে বেরিয়ে এসেছেন পুরো মাতাল অবস্থায়। পরিষ্কার অভিযোগ আছে যে, ড. ভৌমিক নেপালি কয়েকটি মেয়ে ও মহিলার পিছু নিয়েছিলেন। প্রথমদিকে যেসব নারী চিত্রশিল্পী তার আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। পরে তারা তা আর দীর্ঘায়িত করেন নি।

বলাবলি আছে, রাষ্ট্রদূতের অফিস এলাকায় মাঝেমধ্যেই স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নারীকে দেখা যায়। তারা সেখানে প্রচুর সময় অবস্থান করেন। ২০১০ সালের মধ্য ডিসেম্বরে বাংলাদেশের চার যুবতীকে (ড্যান্সার) বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এক পর্যায়ে ফার্স্ট সেক্রেটারি মিসেস নাসরিন জাহান লিপিকে প্রত্যাহার করা হয়। ড. নিমচন্দ্র ভৌমিকের অসদাচরণ, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ, কাজকর্ম নেপালে মারাত্মকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।

শুধু তাই-ই নয়, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারেরও ক্ষতি করেছেন তিনি। ২০১০ সালের ১৭ই মার্চ মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠান হয় ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি মিটিং হোটেলে। সেখানে তিনি নেপালি আর্মি ব্যান্ডকে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের জাতীয় সংগীত বাজাতে বলেন। পরের দিন তিনি জেনারেল জ্যাকবের কাঠমাণ্ডুর কয়েকটি মিটিংয়ে ভারতীয় পতাকা ওড়ানো গাড়িতে করে যোগ দেন। নিমচন্দ্র ভৌমিক এখনও নেপালের কূটনৈতিক সমপ্রদায়ের কাছাকাছি যেতে পারেন নি।

তাকে ভারতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যতটা সম্মান দেখাতে দেখা যায় ততটা তিনি অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখান না। এসব কারণে কূটনৈতিক মিশনের কাজ মাঝেমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়ে। খুব কম ইভেন্ট সম্পর্কেই দেশের মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। এমনকি যখন উচ্চ পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন হয় তখন দেখা যায় প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে, যোগাড়যন্ত্র অপ্রতুল, বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগই করা হয় নি। সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সম্মান প্রদর্শন দেখাই যায় না।

নিমচন্দ্র ভৌমিকের আচরণে মারাত্মক ত্রুটি আছে। দেড় বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে নেই বললেই চলে। এমনকি এ বছরের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধান অতিথি করে তাদের কোন প্রতিনিধিকে পাঠাতেও ইতস্তত করে। অনেক বার তিনি কূটনৈতিক নিয়ম না মেনে দূতাবাসের নিম্ন পদস্থ কিছু স্টাফকে নিয়ে গেছেন নেপালের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে। এমন অবস্থায় নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছেন তাকে পাল্টে নতুন একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিতে।

তিনি নেপালের মাওবাদীদের মতো করে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। তিনি বিভিন্ন জনসভায় যান। মাওবাদীদের ছাড়া কি করতে হবে- তিনি তা নিয়েও লোকজনকে পরামর্শ দেন। ড. নিমচন্দ্র ভৌমিকের মিশনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এও’র হাতে।

তিনি রাষ্ট্রদূতের সামনেই এ ব্যাপারে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করেন। অন্য দু’জন কর্মকর্তাকে উপেক্ষা করে তিনি মিশনের বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃত্ব ফলান। এও হারুনুর রশিদ প্রকাশ্যে পণ্য কেনা, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি মেরামত, হোটেল বিলসহ বিভিন্ন খাত থেকে কমিশন নেন। বেশির ভাগ কেনাকাটাই ভুয়া বিল ধরে বেশি দরে কেনা হয়। বাংলাদেশ সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের প্রতিও ড. ভৌমিক চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগত কাজে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই ৩০ বারের বেশি ঢাকা সফর করেছেন। এ ব্যাপারে প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাকে বলা হলে তিনি উল্টো মন্ত্রণালয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি নিয়ম উপেক্ষা করে মিশনের স্টাফদের জন্য ব্যবহৃত টয়োটা করোলা সেডান গাড়িটি এক বছরের জন্য বেচে দিয়েছেন। এর বাজার মূল্য ১০০০০ ডলার হলেও তিনি কেবল ৩০০০ ডলারের বিনিময়ে সেটা বিক্রি করেছেন। ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে যে, ড. ভৌমিক এবং এওসহ আরও বেশ কয়েকজন স্টাফের কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানে একটি চক্র গড়ে উঠেছে।

এদের মধ্যে স্থানীয় ২-৩ জন ‘শিক্ষা উপদেষ্টা’ও যোগ দিয়েছেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।