আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপালে একপাল ৩

[img][/img]
আগের দিনের সবকিছু আমাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো। চেয়েছিলাম গভীর একটা ঘুম। ভোর, সকাল কিছুই দেখার কোনো খায়েশ ছিলো না। বলেছিলাম গাড়ি পোখরার পথে রওনা হওয়ার আগে আমাকে ডেকে তুলে নিলেই হবে। কিন্তু কেন যেন রাতে ঘুমটা হলো না ঠিকমতো।

এরশাদের সিদ্ধান্তের মতো আমি ঘুম আর নির্ঘুমের দুই নৌকায় পা দিয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। সাধারণত এরকম রাতের পরে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে থাকে সারাদিন। সেই শঙ্কা নিয়ে বারান্দার দরজাটা খুললাম, আর তখন মনে হলো আমি আসলে এখনো ঘুমাচ্ছি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি নির্ঘাত। এতোটাই নিশ্চিত ছিলাম যে চিমটি কেটে প্রমাণ করারও প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমোদমনোভাবাপন্ন হয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

পাশের বারান্দায় দেখি পলাশ উঁকি দিলো, একটু পরে তৃষিয়া, সায়কা, তানিম ভাই, রাহিন, জ্যোতি... ব্যাপারটা যে স্বপ্ন না তা বুঝলাম। শুরু হলো ছবি তোলার পালা।
[img][/img]
[img][/img]
[img][/img]
সচলে এসব লেখা খুবই কঠিন কাজ। সচলের লোকজন আমার ধারনা মঙ্গল গ্রহের পাহাড় পর্বত নদী নালা বরফ ঝর্ণা এগুলোও দেখে ফেলেছে। ইউরোপ আমেরিকা উত্তর দক্ষিণ মেরু জয় করা লোকজনের সামনে নেপালের এক হোটেলের বারান্দা থেকে দেখা এইসব 'এক ফোঁটা শিশির' এর মতোই তুচ্ছ নিশ্চয়ই।

এ যেন শচীন টেন্ডুলকারের কাছে গলির মোড়ে ফিফটি পেটানোর গল্প বলা। কিন্তু ভাইসব, মনে রাখবেন... প্রতিবেশি দেশ বলে নেপালকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না। নাগরকোট কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচা গ্রাম। সাগর সমতল থেকে ৭০০০ ফুট উঁচুতে বসে আসমানে মেঘের সঙ্গে কথা কইতেছি ভাবতেই তো নিজেকে এভারেস্টজয়ির জুনিয়র ভার্সন মনে হইতেছিলো! বিশাল কিছুর সামনে গেলে নাকি সবারই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়, আমার হলো উল্টা... মনে হলো আমি এক দারুণ সৌভাগ্যবান, মেঘের উপর রাত কাটিয়ে দিয়েছি।
মেঘের প্রতি আমার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে।

সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আকাশও সারাক্ষণ বদলে বদলে যায়, প্রতিমুহূর্তেই নতুন আকাশ দেখতে পারে মানুষ আজীবন। এই পুরনো হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তেই নতুনত্বের স্বাদ দেয় সুন্দর খোলা আকাশ। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা। সারাজীবন এই মেঘপুঞ্জিত আকাশ দেখেছি সমতল থেকে। বান্দরবানে গিয়ে কিছুটা মেঘের কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম।

আর এই প্রথম দেখছি মেঘের উপর থেকে। কতো উপরে তা বুঝতে পারলাম নিচের গ্রামের দিকে তাকিয়ে। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাড়িঘর, জনগোষ্ঠি দেখা যাচ্ছে। সেটাও প্রায় ৭০০০ ফুট উপরেই! এখান থেকে ঢাকা শহর দেখতে কেমন লাগতো?
প্রথম দেখায় প্রেমের মতো নাগরকোটের প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। নেপালের অন্য অন্য জায়গায় সবকিছু পর্যটকের দেখার জন্য সাজিয়ে রাখা, শপিং... নাগরকোটে কোনো বিশেষ দ্রষ্টব্য নাই, সমস্তটাই দ্রষ্টব্য।


মনে পড়ে গেলো জীবনানন্দ দাশের কবিতা... প্রিয় কবিতা...
প্ল্যান অনুযায়ী সকালেই পোখরার পথে রওনা হওয়ার কথা। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। একবার মনে হলো সবাইকে বলি "তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও..." তারপর মনে হলো এভাবে হবে না, শুধু নাগরকোটে অলস সময় পাড়ি দেওয়ার জন্য আবার আসতে হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম অচিরেই আবার আসবো। এই প্যারাডাইস ইন হোটেলেই তিনদিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে কাটিয়ে দেবো।


কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, রোদ নাই। নয়তো এখান থেকেই এভারেস্টের চুড়ায় সুন্দর সুর্যোদয় দেখা যেতো। আমি আফসোসহীন মানুষ, যেটুকু পেয়েছি তাতেই আমি মুগ্ধ। আমার মন সবসময়ই ভালো থাকে, তবু কখনো কখনো অসম্ভব ভালো হয়ে যায়।

নাগরকোট আমাকে সেই চমৎকার সকালটা দিলো।
নাস্তা করলাম। তারপর দুই মাইক্রোবাস রওনা দিলো অধঃপতনের দিকে। উঁচু থেকে নিচে নামতে লাগলাম। পথে শত শত লোক ট্র্যাকিংয়ের জন্য দল বেঁধে নামছে।

দেখেই বোঝা যায় এরা সব অনু তারেকের দোস্ত বন্ধু। হায়, এরা জীবনের আরামটাই বুঝলো না
রাতে এই পথেই গিয়েছিলাম আমরা। তখন ছিলো অন্ধকার আর সবকিছুই ছিলো বন্ধ। আলোকিত সকালেও দেখলাম সব বন্ধই। সেদিন ছিলো বিজয়া দশমী।

নেপালের সবকিছুই বন্ধ!
যাওয়ার পথে বখতপুর। প্রাচীন অনেক কিছু আছে এখানে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু প্যাগোডাও নাকি এখানে। আছে দরবার হল। কিন্তু এখানে থামতে গেলে দেরি হয়ে যাবে বলে থামলাম না।

সবকিছু কেন আমাকেই দেখতে হবে?
নাগরকোট থেকে আমরা কাঠমুন্ডুর উপর দিয়ে পোখরার পথে যাচ্ছি। বৃষ্টি বেশ ভালোই পড়ছে। নেপালের মানুষ দেখছি। পথে থামলাম এক দোকানে চা খেতে। সুন্দরী দোকানীর হাতে চা খেলাম।

তাঁর অনুমতি নিয়ে একটা ছবিও তুললাম।
[img][/img]
তারপর আবার যাত্রা। উঁচু জায়গা থেকে পাহাড় ঘুরে ঘুরে নামার বিষয়টা দারুণ লাগলো। পথে পড়লো খরস্রোতা নদী। আরামহীন লোকজন এখানে রাফটিং করে।

কী দরকার বাবা এই পাথরের মধ্যে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে নদীতে ভাসার? আসিস আমাদের নদীগুলোতে, পাল তোলা নৌকার গলুইয়ে শুয়ে চাঁদ তারা দেখতে দেখতে মাঝির ভাটিয়ালি গান শুনতে কতো আরাম!
[img][/img]
বর্ণনা দিয়ে বোঝানো কঠিন কাজ, তবে কাঠমুন্ডু থেকে পোখরা যাওয়ার পথটা সত্যিই সুন্দর। অধঃপতনও ভালো লাগে।
পথে একটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের বুফে খাবারের দোকান আছে। কিন্তু সকালে ফ্রি নাস্তা পেয়ে এতোটাই সাঁটিয়েছি যে সেখানে থামলেও কেউ খাওয়ার নাম মুখে নিলো না পর্যন্ত। ড্রাইভার দু'জন খেয়ে নিলে আমরা আবার পথ চলতে শুরু করলাম।

সন্ধ্যার আগে আগে পোখরার কিছুটা আগে এক 'আল্লাহর দান' টাইপের হোটেলে গাড়ি থামালাম চা খেতে। কিন্তু সেখানে নেপালী থাল পেয়ে সবার ক্ষুধা জেগে উঠলো কুম্ভকর্ণের মতো। সবাই দেদারছে খেলো। আমি একটু বেশিই খাই। তাই আলাদা থাল না নিয়ে সবার থালে ভাগ বসাতে লাগলাম।


[img][/img]
সকাল থেকেই দেখছি দশমী উপলক্ষে নারী পুরুষ সকলে কপালে একদলা লাল রঙের ভাত আর নারীরা মাথায় দুর্বাঘাস লাগিয়ে ঘুরছেন। পরে জেনেছি কপালের বস্তুটা ভাত না অন্যকিছু। সেটা দেখতে খুব একটা আরাম না, কিন্তু খোঁপায় তারার ফুল থুক্কু দুব্বা ঘাস দেখতে ভালো লাগছিলো। খেতে খেতেই একজনকে সামনে পেয়ে ছবি তুললাম (তাঁর অনুমতি না নিয়েই)।
[img][/img]
কিন্তু খেতে বসেই হঠাৎ খেয়াল হলো, আমাদের কাছে ডলার থাকলেও কোনো রুপি নেই! প্রমোদ'দা যে নয় হাজার রুপি দিয়েছিলেন কর্জ হিসেবে সব শেষ হয়ে গেছে।

কাঠমুন্ডুতে সবকিছু বন্ধ বিধায় আমরা বদল করতে পারিনি! এখন বিল দেবো কি উপায়ে? শেষ পর্যন্ত ড্রাইভারের কাছ থেকে রুপি ধার করে খাওয়ার বিল দিলাম। ধার কর্জ করেই তো নেপাল ট্যুর হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
[img][/img]
তারপর আবার যাত্রা। পথের দু'ধারে শুধু উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ছে মেঘ।

গাছের পাতায় পাতায় আটকে থাকছে মেঘ। আহা... কী অপূর্ব। সুন্দর প্রকৃতি ছাড়িয়ে আমরা ক্রমশ ব্যস্ত নগরীর দিকে যাচ্ছি। সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে পোখরা। নেপালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান।


(আমাদের যাত্রাসঙ্গী সচল দুষ্ট বালিকার আজ জন্মদিন। আর নেপাল ট্যুরে যিনি নিজের ডিএসএলআর ধার দিয়েছিলেন ছবি তোলার জন্য, সেই রোয়েনা রাসনাত এর জন্মদিন ছিলো গতকাল। দু'জনকেই শুভ জন্মদিন)

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।