আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপালে আনন্দময় দশদিন

পোর্ট ভবনে ঢুকেই মিতুল ঝটপট ফরম পূরণ করতে শুরু করে দিল। এবারের ভ্রমণে আমার পরিবারের সকল সদস্য-- অর্থাৎ বেবী, কীর্তি, অর্থী আর শ্রেয়া আছে। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে মিতুল; সে কীর্তির সূত্রে গত ডিসেম্বরে আমাদের পরিবারের সদস্যপদ পেয়েছে। তাছাড়া বন্যা, টুটুল আর জয়িতাও এসেছে। জয়িতা এই প্রথমবারের মতো মাটির মায়া কাটিয়ে আকাশে উড়ছে, প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখছে।

ওর চোখ একেবারেই স্বপ্নমাখা। সব কিছুই ও দেখছে অন্যভাবে। আর জয়িতার উপর একটু পািন্ডত্য খাটাবার চেষ্টা করছে অর্থী আর শ্রেয়া। কারণ ওরা আরও দু-একবার উড়োজাহাজের সিটবেল্ট পেটে বেঁধেছে।
বিমানবন্দরের আয়োজন খুব একটা জোরদার আর গোছানো নয়।

বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে সন্দেহের চোখে দেখতে হয়, তা যেন এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেননি এখানকার লোকেরা। অন্যদের পাসপোর্টে সিল পড়ার আগে আমি আর শ্রেয়া বাইরে বের হয়ে এলাম। একটু দূরে একটা ছাউনির নিচে নেপালি টুপি পরে এক শীর্ণকায় ভদ্রলোক আমার নাম ছাপা একটা কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি তাকে ইশারা দিতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “নমস্তে। ”



বিমানবন্দরের বাইরে বেশ গরম।

পাহাড়ি দেশ নেপালে এতটা গরম থাকবে, এটা আমরা আশা করিনি। আমাদের সঙ্গে শীতবস্ত্রও আছে। এগুলোর যে কী গতি হবে কে জানে! আমরা বুকিং দিয়েছি পার্ক ভিলেজ হোটেলে। মূল শহর থেকে এটির দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি।
আমাদের মাইক্রোবাস শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে।

শহরময় নানা ধরনের নির্মাণ কাজ চলছে। ধুলোময় রাস্তাঘাট। সবকিছু পেরিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা হোটেলে এসে পৌঁছুলাম।
নেপালে হোটেল আর রেস্টুরেন্টে সকল বিলের উপর ২৩% ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ যোগ হয়। এ হোটেলের প্রতিটি রুমের ভাড়া ১২০ থেকে ১৭০ মার্কিন ডলার।

তার উপর ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ যোগ হবে। তবে এখানে দামাদামি করা চলে। আমরা টেলিফোনে দামাদামি করে ১৫০ ডলার মূল্যের রুম ভ্যাট-সার্ভিস চার্জসহ ৭৫ ডলারে চুক্তি করেছি।
চট করে রিসেপশন কাউন্টারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রুমের দিকে রওনা হলাম। অবশ্য তার আগে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করার আদেশ দিতে ভুললাম না।

কারণ আমরা সবাই ততক্ষণে বেশ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি।
হোটেলের পরিবেশটি এক কথায় চমৎকার। চারদিকে অনেক বাগান, গাছপালা; নিরিবিলি পরিবেশে পাখির কলকাকলি আমাদের মুগ্ধ করে দিচ্ছে। হোটেলটির পেছনদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। অবশ্য নেপালের সর্বত্রই পাহাড় আর পাহাড়।

এখানে সূর্য ওঠে পাহাড় ডিঙিয়ে, আবার অস্ত যায় পাহাড়ের আড়ালে।
রুমে গিয়ে এর সাজগোজ দেখেও আমরা মুগ্ধ হয়েছি। চমৎকার সব আয়োজন। রাতে বাইরে বসে চাঁদের আলোতে আড্ডা দেওয়া যাবে। অবশ্য আকাশে এখন চাঁদ ওঠে কিনা, এখন পূর্ণিমার সময় কিনা কে জানে? পূর্ণিমার সময় এখানে এলে ভালো হত।

তাড়াতাড়ি গোসল করে আমরা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেবী চট করে নামাজ পড়ে নিচ্ছে।
সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কেবলা কোন দিকে হতে পারে?”



আমি ঘরের ভেতর কোনো নির্দেশনা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলাম। এর কোনো চিহ্ন পেলাম না। অগত্যা ঘরের বাইরে এসে সূর্য কোনদিকে যাচ্ছে তা পরীক্ষার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু অনেকক্ষণ সূর্যদেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করেও তার গতিপথ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারলাম না।
এ সময় একজন মালিকে এদিকে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “গুড আফটারনুন। ভাইসাহেব, বলেন তো কেবলা কোনদিকে?”
ভদ্রলোক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী বললেন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, ওয়েস্ট কোনদিকে? সূর্য কোনদিকে ওঠে আর কোনদিকে ডোবে?”
ভদ্রলোক দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বললেন এবং চলে গেলেন। অগত্যা আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা দিক নির্ধারণ করলাম এবং বেবীকে সেই দিকটি দেখিয়ে দিলাম।


চটপট আমরা চলে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ইতোমধ্যে আমাদের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। খাবারের দাম কিছুটা বেশি হলেও ভালোই লাগল। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন রুচির পর্যটক আছে। কেউ দেশি মুরগি আর রুই মাছের চচ্চরি ছাড়া কিছুই খেতে চায় না।

আবার কেউ কাঁকড়া-বিছে কড়কড়ে ভাজি পেলে খুশি হয়। তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই রুমে গেলাম। উদ্দেশ্য, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার সবাই একত্র হয়ে গেল।
সবার বক্তব্য, এখানে তো আমরা বিশ্রাম নিতে আসিনি।

এক্ষুনি বেরোতে হবে, থামেলে যেতে হবে। কাঠমান্ডু শহরের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে থামেল। আমরা সবাই রেডি হয়ে গাড়ি খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু এখান থেকে কোনো গাড়ি পাওয়া মনে হয় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ কেবল যাত্রী পেলেই ট্যাক্সিগুলো এখানে আসে।

আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে দুটো ট্যাক্সি জোগাড় করলাম। প্রতিটি ট্যাক্সি ৬০০ রুপি করে মোট ১ হাজার ২০০ রুপি ভাড়া নেবে।
প্রথমে আমরা গেলাম দরবার এলাকায়। সেখানে অনেক অনেক পুরনো মন্দির আছে। কারুকার্যখচিত এসব মন্দির দেখতে দেখতে আমাদের বিকেল কাটল চমৎকারভাবে।

আমি আর টুটুল দুটো নেপালি টুপি কিনে মাথায় পরে অনেক ছবি তুললাম। একটা মন্দিরে বয়েসী মানুষেরা একসঙ্গে বসে কীর্তন গাইছিলেন। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে কীর্তন শুনলাম এবং তাদের ছবি নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা আবারও ট্যাক্সি নিয়ে থামেল এলাকার দিকে রওনা হলাম। থামেল হচ্ছে কাঠমান্ডুর মূল পর্যটন কেন্দ্র।


আমরা যখন থামেলে পৌঁছলাম, তখন সবাই একবাক্যে জানাল যে তারা সবাই এখানে চলে আসতে আগ্রহী। পার্ক ভিলেজ হোটেলটি সুন্দর হলেও সেখানে কেমন যেন একা একা লাগে। ভালো লাগে না। তাই সবাই এই থামেল এলাকার যে কোনো হোটেলে থাকবে। এখানে আশপাশে শপিং সেন্টার আছে, ঘোরাফেরার জায়গা আছে।

গভীর রাত পর্যন্ত এলাকাটি জেগে থাকে। আর এলাকাকে জাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা আমাদের পালন করতে হবে না। কিন্তু পার্ক ভিলেজ হোটেলে আমরা ঘুমিয়ে গেলে সবই শেষ।



আমরা তখন একই গ্রুপের হোটেল কাঠমান্ডু রেস্ট হাউজে গেলাম। এখানকার রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হল।

তবে এখানে রুমের ভাড়া ১৫০ হতে ২২০ মার্কিন ডলার; সেই সঙ্গে ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ মিলে আরও ২৩%। কিন্তু আমি তো ইতোমধ্যে দরকষাকষি শিখে ফেলেছি। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে বলে শেষে সবকিছুসহ ৮০ ডলারে রুম ঠিক করে ফেললাম।
কাল ১১টায় ওদের গাড়ি গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবে। আমরা আবারও কিছুক্ষণ শপিংমলে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্তির বোঝা বাড়ালাম।

তারপর পার্ক ভিলেজে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো ট্যাক্সিই ওদিকে যেতে চায় না। তাদের একটাই কথা, ওখানে গেলে শূন্য অবস্থায় ফিরে আসতে হবে।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত দুটো ট্যাক্সিকে রাজি করানো গেল। আমরা পার্ক ভিলেজে পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে যার যার ঘরে চলে গেলাম।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল, রাতে বাইরে বসে জম্পেস আড্ডা হবে। কিন্তু বাইরে ততক্ষণে শীত শুরু হয়ে গেছে। নিরিবিলি পরিবেশে শীত যেন পাহাড় থেকে উড়ে উড়ে আসছে।
সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠলাম অনেকটা বেলা করে। কারণ আজ আমাদের কোনো প্রোগ্রাম নেই।

সকাল ১১টার মধ্যে রেডি হয়ে চেক আউট করে নিলেই হল। আমরা নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ পর ব্যাগ নিয়ে রিসেপশন কাউন্টারে এসে দেখি কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা চেকআউট করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে বসলাম।
কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজে আমাদের দেওয়া রুমগুলো খুবই সুন্দর। জানালা দিয়ে একটা সবুজ মাঠ দেখা যায়।

মাঠের পাশে ওদের নানা ঐতিহ্য লালিত সরঞ্জামাদি রাখা আছে। একপাশে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি। এখান থেকে বই নিয়ে পাশে থাকা খোলা বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যায়। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, একটা মেয়ে সেখানে শুয়ে বই পড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি এই পাঠিকা হচ্ছে আমাদের অর্থী।

সে বেশ পড়ুয়া। কিন্তু এ হোটেলে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে লাইব্রেরি আর আয়েশি ভঙ্গিমায় পড়ার স্থানটা চিনে ফেলেছে, এটাই আশ্চর্যের বিষয়। আমি ক্যামেরা বের করে অর্থীর কটি ছবি তুলে নিলাম।
দুপুরে আমরা কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের পাশে থার্ড আই রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। রেস্টুরেন্টটি বাইরে থেকে অনেকটা সাদামাটা মনে হলেও ভেতরটা বেশ অন্যরকম।

এখানে প্রত্যেক রুমে স্তরে স্তরে উপরে-নিচে টেবিল পাতা হয়েছে। সব টেবিলের সঙ্গেই বসার জন্য তাকিয়া দেওয়া আছে। জুতো বাইরে খুলে এসে আসন পেতে বসতে হয়। আমরা একটা রুম দখল করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে গেলাম। রাজদরবারের চাপরাশিদের পোশাকে সজ্জিত বেয়ারাগণ বেশ ভাঁজ মেরে মেরে মেন্যু হাজির করলেন।


আমরা অনেক গবেষণা করে দুই ধরনের খাবারের অর্ডার দিলাম।
এখানে আমাদের টেবিলে প্রাধান্য পেল সাদা ভাত আর সাধারণ তরকারি। অন্যদিকে ছোটদের টেবিলে দেখা গেল ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে নানা ধরনের উদ্ভট নামের কারি। খাওয়া শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহরে ঘুরতে। অনেকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে আমরা চলে এলাম সিভিল মলে।

এটি কাঠমান্ডুর অতি আধুনিক শপিং সেন্টার। এখানকার মডার্ণ ছেলেমেয়েদের পদচারণায় সিভিল মল তাদের আঁটোসাঁটো কোটের সঙ্গে রংবেরংয়ের টুপি পরার সংস্কৃতি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূর, পশ্চিমে। তবে পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতির ঢল এখানে এখনও নামেনি।
সিভিল মলের প্রবেশ পথের দুধারে অনেক খোলামেলা খাবারের দোকান। এগুলোর মধ্যে চটপটি, ফুচকা, আইসক্রিম, মমো ইত্যাদির দোকান উল্লেখযোগ্য।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠেই একটা কাউন্টার থেকে টাকা দিয়ে খাবারের জন্য টিকিট কিনতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে লাইন দিয়ে খাবার নিতে হয়।
শ্রেয়া এ সিস্টেম না বুঝে ফুচকার দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই যে মেয়েটি ফুচকা তৈরি করে ক্রেতাদের দিচ্ছিল সে শ্রেয়াকে একটা ফুচকা দিল। শ্রেয়া সেটি খেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর কোনো ফুচকা পেল না। শেষ পর্যন্ত আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে ফুচকা দিতে বলায় সে টিকিট ঘরের দিকে দেখিয়ে দিল এবং টিকিট কিনে আনতে বলল।


আমি দেখলাম, টিকিট কেটে এনে লাইনে দাঁড়ালে ও আর সিনেমা দেখতে পারবে না। কীর্তি এরই মধ্যে ওদের জন্য সিনেমার টিকেট কেনে এনেছে। সিনেমা শুরু হতে আর মিনিট দশেক বাকি আছে। অগত্যা মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সবাই আইসক্রিম খেয়ে ওঠে পড়লাম।
এখানে টুটুল আর বন্যা একটা হিন্দি সিনেমা দেখবে।

বাকিরা দেখবে থ্রি-ডি ইংলিশ কার্টুন। আমি আর বেবী সিনেমা দেখার বদলে রুমে ফিরে বিশ্রাম নেব। ওরা সিনেমা হলে ঢুকে গেলে আমি আর বেবী একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরে আসার পরপরই একটা টেলিফোন পেলাম। কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের একজন কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে তার পরিচয় দিলেন।

ভদ্রলোকের নাম সতীশ। বাংলাদেশ থেকে আসার আগে তার সঙ্গেই আমার কথা হয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসলাম। কমদামে হোটেল বুক করার ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। এরপর বললাম, “আমরা এ গ্রুপের হোটেলেই থাকতে চাই।

আমরা যেহেতু পোখরা যাচ্ছি সেখানেও তোমাদের হোটেলেই থাকব। তবে আমাদের কাছ থেকে কম ভাড়া নিতে হবে।
বেশ দামাদামি করে এবার প্রতি রুম ৬০ ডলারে ঠিক করে ফেললাম। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে আমি আবার রুমে ফিরে এলাম। বেবী তখন একা একা শুয়ে আছে।

বহুদিন পর যেন আমি ওকে একা খুব কাছে পেয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে আমরা জম্পেস আড্ডা দিলাম। ব্যস্ততাহীন, দুঃশ্চিন্তাহীন নিখাদ এই আড্ডায় আকাশ-পাতাল অনেক কিছুই উঠে এল। আমাদের শেষ জীবন কীভাবে কাটবে তাও আলোচিত হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ করলাম রাত দশটা বেজে গেছে।

আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলো কয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে জানি না। তড়িঘড়ি করে আমরা খাবারের সন্ধানে বের হলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক রেস্টুরেন্ট দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের রেস্টুরেন্টে তো কোনো লোকই পাওয়া গেল না। থার্ড আই রেস্টুরেন্ট এইমাত্র দরজা বন্ধ করল।

আমরা অনেক খুঁজে নিউ অর্লিন্স ক্যাফে নামক একটি রেস্টুরেন্ট পেলাম। এখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে আছে। আমরা ভেতরে ঢুকে মেন্যু দেখলাম, খাবার পছন্দ হল না। অগত্যা আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে আরও কোনো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় কি না খুঁজতে গেলাম।



ঠিক এমনি সময়ে মিতুল আর কীর্তিকে দেখি-- ওরা হন্যে হয়ে রেস্টুরেন্ট খুঁজছে।

এছাড়া অন্যরা কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের সামনের লনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। খাবার পাওয়া যাবে কি না কে জানে? ওদের বেশ উদগ্রীব দেখাচ্ছিল। আমি জানালাম যে, ওখানে একটি রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। তবে ওটাতে রুটি আর ডাল ছাড়া আপাতত আর কিছু পাওয়া যাবে না। মিতুলের পরামর্শ অনুসারে আমরা আবার ওই রেস্টুরেন্টে ফিরে গিয়ে একই স্থানে আবার বসলাম।

ভাবটা এমন, যেন আমরা ওদের আনতে গিয়েছিলাম। আমরা এখানে রুটি আর ডালের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি। আর ওদিকে মিতুল, কীর্তি আর টুটুল হেঁটে হেঁটে দূরের একটি ফাস্ট-ফুড রেস্টুরেন্ট থেকে বার্গার খেয়ে এল।
ব্যাগ গুছিয়ে রেখে আমরা বেশ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই আমাদের রওনা হতে হবে পোখরার উদ্দেশে।

নেপালের অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে পোখরা অন্যতম। কাঠমান্ডু হতে পোখরার দূরত্ব ২০৮ কিমি; কিন্তু সড়কপথে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা; কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি। পাহাড়ি রাস্তা, পাশে নানারকম মৃত্যুখাদ। এর মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়।
সকালে ওঠে আমরা হোটেলের সৌজন্য নাশতা খেতে গিয়ে দেখি গুণে গুণে কটি পাউরুটির টুকরো, এক বাটি জেলি, আর কিছু পাহাড়ি কলা রাখা আছে।

বিশ্বের অন্য কোনো হোটেলেই এর চেয়ে নিম্নমানের নাস্তা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রেস্টুরেন্টের বেয়ারাদের আচরণও নাস্তার মানের মতোই।
নাস্তা খেয়ে আমরা ব্যাগ নিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। এটি ১৪ সিটের একটি মাইক্রোবাস। চাররাত আর পাঁচদিনের জন্য আমরা এটি ভাড়া করেছি ৩৫ হাজার রুপি দিয়ে।

পাঁচদিনে আমরা কোথায় কোথায় যাব, তা আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়িতে ওঠার পর গাড়ি বেদমগতিতে ছুটে চলছে।
কাঠমান্ডু শহর ছেড়ে আমরা শহরের উপকণ্ঠ থেকে শুরু হওয়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগুচ্ছি। গাড়ির ভেতর প্রচ- গরম লাগছে। কারণ এর এসি চলছে না।

গাড়িতে কেবল ড্রাইভারের পাশের জানালা খোলা যায়, অন্যগুলো আটকানো। এসির বিষয়ে ড্রাইভারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন, গাড়ির এসি ভালোই আছে, তবে এসি চালু করা হবে না। কারণ গাড়ি ভাড়া করার সময় এসি চালানোর কথা বলা হয়নি। এখন এসি চালাতে হলে ২০% বেশি দিতে হবে। আমাদের তো মাথায় হাত।

এসি যদি চালানো না হয় তাহলে গরমে আমরা অতীষ্ঠ হয়ে যাব। ট্যুর ম্যানেজার মিতুল তো বেশ বিব্রতই হয়ে গেল। এখন কী করা যায়! আরও ঘণ্টাদেড়েক পথ চলার পর নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট দেখা গেল। পাশে একটা টং টাইপের মুদির দোকান। আমরা চা খাবার জন্য এখানে গাড়ি থামাতে বললাম।

এরই মধ্যে সবাই গরমে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমরা লাফিয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম।
এটি একটি খোলা রেস্টুরেন্ট। নদীর পাড়ে অনেকটা জায়গাজুড়ে টেবিল-চেয়ারগুলো ছড়ানো আছে। চারদিকে বেড়া নেই।

নদীর দিক থেকে হুহু করে উত্তুরে বাতাস বইছে। মুহূর্তে যেন আমাদের শরীর জুড়িয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, অর্থী আমাদের কাছে নেই। ও ঢালু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এক্কেবারে নিচে নেমে নদীর পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। অর্থীকে এ অবস্থায় দেখে নিচে নামার চ্যালেঞ্জ নিল জয়িতা আর শ্রেয়া।

কারণ ওরা যদি এই ঢালু রাস্তাটি বেয়ে না নামতে পারে তাহলে তাদের ইজ্জত একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই ওরা অনেক কষ্টে ঢালু পথ বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেল। আমরা মজা করে চা খেলাম। এখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটালাম। টুটুল মুদি দোকান থেকে কলা কিনে আনল।

আমাদের দেশে বান্দরবানে এ ধরনের কলা পাওয়া যায়। চা-কলা খাবার পর আমরা আবার গাড়িতে চড়ে পোখরার দিকে রওনা হলাম। এরমধ্যে গাড়ি বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে, সাঁ-সাঁ করে এসি চলছে। আমরা খুব আশ্চর্য হলাম। মিতুলকে জিজ্ঞেস করলাম, “বিষয় কী? ঠান্ডা আসে কোত্থেকে?”
মিতুল জানাল, তাকে ফিট করা হয়েছে।

পাঁচদিনের ডিউটি শেষে একটু বখশিস দিলেই চলবে।
দুপুর দেড়টার দিকে আমরা একটি কালচার ভিলেজ রেস্টুরেন্টে থামলাম। এটি পোখরা যাওয়ার পথে তানাহুন নামক স্থানে একটি আবদ্ধ ও খোলামেলা রেস্টুরেন্ট। মানে এর একাংশ দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ করা, আর অন্য অংশ চারদিকের দেয়ালহীন, খোলামেলা। রেস্টুরেন্টের বাইরেটা বেশ সুন্দর।

আমরা খোলামেলা অংশে গিয়ে নদী আর পাহাড়ের মুখোমুখি হয়ে বসলাম।
এ রেস্টুরেন্টের মেন্যু একেবারেই বাংলাদেশি খাবারের মতো। সাদা ভাত, পাতলা ডাল থেকে শুরু করে ডিম ভাজা পর্যন্ত সবই আছে। আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে আড্ডাবাজিতে মেতে উঠলাম। অল্পক্ষণ পরেই খাবার আসতে লাগল।

খাবার যে ভালো ছিল এর প্রমাণ হচ্ছে সব টেবিল থেকেই আবারও নতুন নতুন অর্ডার দেওয়া হল। গাড়িতে এসি দেওয়া বা না দেওয়ার মালিক ড্রাইভার সাহেবকে আমরা যা ইচ্ছা তাই দিয়ে পেট ভরে খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম।
খাওয়া শেষ হওয়ার পরও আমরা এখানে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। জায়গাটা সবার কাছেই ভালো লাগছিল। তারপর এক সময় আবার আমাদের ছুটে চলা শুরু হল।

আমরা পোখরা পৌঁছুলাম দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর। আমাদের গাড়ি পোখরা শহর পেরিয়ে শহরের উল্টোদিকে এগিয়ে চলল। পাকা রাস্তা ছেড়ে শুরু হল ভাঙা রাস্তা দিয়ে যাওয়া। এবার আমার মনে ভয় ঢুকে গেল, এটাও তাহলে পার্ক ভিলেজের মতোই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন একটা রিসোর্ট। ওখানে গেলে বাইরে আসার নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা।

গাড়ি আরও কিছুদূর এসে বামে ঘোরার পর দেখলাম, আমাদের চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এ এলাকার সুন্দরতম রিসোর্ট ওয়াটারফ্রন্ট। সামনে বিশাল সুইমিংপুল, তারও সামনে এক টুকরো সবুজ মাঠ পেরিয়ে আবার বেশ বড় লেক। আর ওপারে বিশাল পাহাড় আকাশের অনেকটা ঢেকে রেখেছে। পাহাড়ের শীর্ষে একটা সাদা মন্দির। রিসোর্টটা দেখে কেন জানি আমাদের মনটা নেচে উঠল।

আহা, তিন তিনটে দিন আমরা এই সুন্দর রিসোর্টে কাটাব। কতই না মজা হবে!
রিসেপশন কাউন্টারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রুমে চলে গেলাম। আমাদের পাশাপাশি চারটা রুম, দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অন্য রুমের বারান্দাগুলোও দেখা যায়। চটপট হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই আমরা কজন বেরিয়ে পড়লাম। এ দলের মধ্যে আমার সঙ্গে বেবী, বন্যা আর টুটুল আছে।

বাকিরা রুমেই সিনেমা ইত্যাদি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আমরা হোটেলের সামনের লন পার হয়ে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে ছোট্ট দরজাটি দিয়ে বাইরে চলে এলাম। এখানে চমৎকার একটি সবুজ মাঠ। আমরা মাঠটি পেরিয়ে লেকের পাশে এসে দেখি নিচে বসে অনেকেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা আরও একটু দূরে এসে ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলাম।


পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ি ফুরফুরে বাতাস আমাদের মনকে যেন কোন সুদূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমরা অনেকক্ষণ বসে গল্প করলাম, অনেকগুলো ছবি তুললাম। সন্ধ্যার আগে আগে হঠাৎ ঝপ করে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল আর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। আমরা দৌড়ে হোটেলে চলে এলাম। হোটেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি থেমে গেল।


আমরা রুমে আসার পর অর্থী আর জয়িতা এসে জানাল যে ওদের ক্ষিধে পেয়েছে। আমি নিচে ওদের রেস্টুরেন্টে গিয়ে মেন্যু দেখতে দেখতে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। প্রতিটি জিনিসের দামই আকাশছোঁয়া। ওরা নিশ্চয়ই দাম বেশি রেখে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের একটা কৌশল নিয়েছে। কারণ এখান থেকে শহরে খেতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

এখান থেকে ট্যাক্সি জোগাড় করা সম্ভব নয় বললেই চলে। আমাদের বিষয়টা অবশ্য অন্যরকম। কারণ আমরা পাঁচদিনের জন্য গাড়ি নিয়েই এসেছি।
আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা এঁকেবেঁকে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেছে।

এদিকটায় লোক চলাচল খুব কম, গাড়ি-ঘোড়া একদম নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটর সাইকেল এ পথে চলে। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দোতলা পাকাবাড়িতে ‘হোটেল ও রেস্টুরেন্ট’ লেখা সাইনবোর্ড দেখে এগিয়ে গেলাম। নিচে একটা রুমে একটা কম্পিউটার সামনে নিয়ে একটা মেয়ে বসে কাজ করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে রেস্টুরেন্টটি কোথায়?”
সে আমাকে সিঁড়ি দেখিয়ে বলে দিল, “দোতলায়।


আমি দোতলায় গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। একটা রুমে গোটাতিনেক টেবিল আর তার সঙ্গে বেশ কটি চেয়ার রাখা আছে। বাইরের খোলা ছাদেও একটি টেবিল আর চারটি চেয়ার পাতা। আমি জোরে জোরে ডাকলাম, “এখানে কেউ আছেন?”
পাশের একটি রুম থেকে দরজা ঠেলে একটি মেয়ে আমার সামনে এসে হাসিমুখে দাঁড়াল। তার পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও নীল টি-শার্ট।

বিনয়ের সঙ্গে কুর্নিশ করে মেয়েটি বলল, “নমস্তে। ”
আমি ধন্যবাদ দিয়ে বললাম “তুমি কি এই রেস্টুরেন্টে কাজ কর?”
“হ্যাঁ। ”
“তোমার নাম কী?”
“কুসুম। ”
“কুসুম মানে কী?”
“আমি জানি না। ”
“আমাদের দেশে কুসুম মানে ফুল।


কুসুম আমাকে একটা ছাপানো মেন্যু এনে দিল।
তাদের মেন্যু দেখে আমি খুবই খুশি হলাম। এখানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই থেকে শুরু করে সকল ফার্স্ট ফুড, ভাত, পোলাও এবং ডাল পর্যন্ত আছে। আর এগুলোর দাম অবিশ্বাস্য রকম কম। রেস্টুরেন্টটি ওদের পারিবারিক এবং খুব পরিচ্ছন্ন।

ওর বাবা একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি করেন। কুসুমের মা আর ওদের দুবোন মিলে এই পারিবারিক ব্যবসা চালায়। বাড়ির দোতলায় রেস্টুরেন্ট আর তাদের থাকার ঘর। অন্যদিকে নিচতলায় রয়েছে হোটেল, অর্থাৎ ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা। এখানে প্রধানত রাশিয়া বা অন্যান্য দেশের পর্যটকরা অতি অল্প ভাড়ায় থাকেন।


আমি কুসুমের রেস্টুরেন্টে অনেক ধরনের ফার্স্ট ফুডজাতীয় খাবারের অর্ডার দিলাম। এর মধ্যে ফ্র্যাঞ্চ ফ্রাই, মুরগি ভাজি, সব্জি ভাজি, কপি ভাজি ইত্যাদি আছে। আমার খাবার বানাতে কিছুটা সময় লাগবে বলে কুসুম আমাকে একটা চা দিয়ে গেল। এরই মাঝে ওর মা চলে এসেছেন। তিনিও খাবার বানাবার কাজে হাত লাগালেন।

আমি যাতে একা বসে বসে অস্থির না হয়ে পড়ি সে জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওরা মা-মেয়ে পর্যায়ক্রমে রান্নাঘর থেকে বাইরে আসছে আর দু-একটা কথা বলে চমৎকার একটা করে হাসি উপহার দিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর কুসুমের মা আমার হাতে খাবারের প্যাকেটটি তুলে দিলেন। খাবারের প্যাকেট দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। খাবার যাতে ঠান্ডা না হয়ে যায় সে জন্য সেগুলো ফয়েল পেপার দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে মুড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা। দাম চুকিয়ে দিয়ে হোটেলে এসে সবার সামনে আমি খাবার খুলতে লাগলাম।

এ সময় সবাই এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এতগুলো খাবার হাওয়া হয়ে গেল। আমার খুব ভালো লাগল এই খাবারগুলো সবাই পছন্দ করেছে বলে।
রাতে আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে খেতে গেলাম। প্রথমে সবাই দোকানপাটে ঘুরে বেড়াল।

টুকটাক নেপালি জিনিসপত্র কেনাও হল। ভারতীয় সিনেমা দেখে দেখে জয়িতা কিছু কিছু হিন্দি বলা শিখেছে। ওর নিজের কাছে কিছু টাকাও আছে। ও যা দেখছে, তাই কিনে ফেলতে চাইছে। দোকানদারের সঙ্গে হিন্দি ভাষায় কথা বলছে সে।

দামাদামি করছে।
শহরের শেষ দিকে একটা রেষ্টুরেন্টে আমরা খেতে বসলাম। রেস্টুরেন্টটি মোটামুটি মানের। খাবার তেমন একটা ভালো লাগল না। রাতে আমরা যার যার বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে ঘুমালাম।

সকালে ওয়াটারফ্রন্ট রেস্টুরেন্টে নাস্তা সৌজন্য হিসেবে দেওয়া হবে। আমরা একটু দেরি করে সেখানে গেলাম এবং পরিচিত নানা ধরনের খাবার দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। এখানকার বেয়ারাগুলো খুব ভালো। তারা হাসিমুখে নানা ধরনের খাবার এনে দেয়। দুপুরের আগে আগে আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে চলে এলাম।

ঘুরে ঘুরে শহরটা দেখে নিলাম আমরা। চমৎকার ঐতিহাসিক একটি শহর। বহু পুরনো আমল হতেই এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। দুপুরে আমরা একটি ভেজিটারিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। আর মিতুলের নেতৃত্বে ছোটরা গেল ইকিরি বিকিরি মার্কা কী যেন একটা রেস্টুরেন্টে।

সেখানে গিয়ে তারা আজব কিছু খাবার খেয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে ফিরে এল। আর আমি সেই চিরদিনের বন্ধু ডিম ভাজি দিয়ে খেয়ে নিলাম।



বিকেলটা আমাদের কাটল কাছের একটা নদীতে বোটিং করে। চমৎকার লেইক টাইপের একটা শান্ত নদী। এর দুদিকে উঁচু পাহাড় ভর্তি সবুজ গাছ।

বিকেলের হালকা হিমেল বাতাস আমাদের আনন্দকে আরও সমৃদ্ধ করলো। সন্ধ্যার পর আমরা নদীর তীরে বসে আড্ডা দিলাম। রাতে শহর থেকে রাতের খাবার খেয়ে আমরা ওয়াটারফ্রন্টে ফিরলাম। আজ একটু সকাল সকাল ঘুমুতে হবে। কারণ কাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই সারাংকোট পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখতে যাবে।

আমি অবশ্য ঘুমুতে যাওয়ার আগে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, জীবনে বহু স্থান থেকেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখেছি। এটা দেখার জন্য ঘুম বাদ দিয়ে শেষ রাতে পাহাড়ে চড়তে পারব না।
শেষ রাতে সকলের হৈচৈ শব্দে আমারও ঘুম ভাঙল। খুব আড়ম্বরপূর্ণ সাজুগুজু করে ওরা বেরুতে যাচ্ছে। আমার আর ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এখন আমার ‘আবার সাধিলেই খাইব’ এমন অবস্থা। বেরুতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বেবী কেন জানি দয়া করে বলল, “চল না, তুমিও চল। একা একা শুয়ে থাকতে তোমার ভালো লাগবে?”
এর জবাবে আমি যদি বলি, “হ্যাঁ, খুবই ভালো লাগবে। ”
তাহলে একটা দাম্পত্য কলহের সূচনা হতে পারে। তাছাড়া আমারও ভালো লাগছিল না।

সূর্য বেচারা তো উঠবেই, এটা তার কপালের লিখন। সে না উঠে পারবে না। আমি সূর্য দেখি বা না দেখি, সবার সঙ্গে হৈচৈ তো করতে পারব! আমি যাব বলে পাঁচ মিনিটের সময় নিয়ে মোটামুটি সাড়ে এগারো মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে ওদের সঙ্গে নেমে গেলাম। গাড়ি শহর পার হয়ে অনেক ডান-বাম করে পাহাড়ে আরোহন করার পাঁয়তারা করছে। এদিকে পুব আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।

আমরা পৌঁছার আগেই সূর্য উঠে যেতে পারে এমন আশংকায় এখন সবাই কাতর। এ মুহূর্তে বন্যা আবার একটু বিটলেমি বুদ্ধি খাটিয়ে দিল।
সে বলল, “আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছুতে পারতাম, মাহফুজ ভাই সাড়ে এগার মিনিট দেরি করায় এখন সূর্যোদয় দেখতে পাব না। ”
ওর কথা শুনে সবাই এখন একটা যেন সহি কারণ পেয়ে গেল। আলোচনা শুরু হয়ে গেল আমার দেরি করা নিয়ে।

আমি দেখলাম মহাবিপদ।
আমি তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, “আগামী ১৫ তারিখ নাকি হেফাজতে ইসলামির সম্মেলন, মতিঝিল শাপলা চত্বরে। আল্লাহ জানেন কী হয়। ”
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। বন্যা এবার হুজুরদের প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল।

ততক্ষণে আমরা সারাংকোটের একটি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন, সূর্য কেবল ভাব দেখাচ্ছে, এখনও সারিবদ্ধ পাহাড় ডিঙিয়ে উঁকি দেয়নি। আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে পাহাড়ের শীর্ষে চলে এলাম। এখানে ইতোমধ্যে বহু মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। চীন, ইউরোপ, ভারতসহ অনেক দেশের মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছে এখানে, দেখা যাচ্ছে না শুধু সুরুজ মিয়াকে।

সে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আর এই পাহাড়ের শীর্ষে লাল চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে আছে বেবী, জ্যাকেট গায়ে থিরথির করে কাঁপছে বন্যা, ড্যাবড্যাবে চোখে পুবের দিকে তাকিয়ে আছে অর্থী, শ্রেয়া আর জয়িতা। ওদিকে মিতুল আর কীর্তি ছবি তোলায় ব্যস্ত। ওদের মনে প্যারাগ্লাইডিং নিয়ে বিপুল উৎসাহ। আশপাশের পাহাড় থেকে কিছু লোক প্যারাগ্লাইডিং করছে, অর্থাৎ একটা প্যারাস্যুট নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ছে, নিচে এসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।


আজ সকাল ১০টার দিকে ওরাও প্যারাগ্লাইডিং করবে; গতকালই টিকিট কিনে এনেছে। সেই থেকে আমার মনে ভয় ঢুকে গেছে, আল্লাহ না করুক, ঠিক ওদের প্যারাস্যুটটাই যদি ফুটো হয়ে যায়!
টুটুল পাশের দোকান থেকে চার কাপ চা নিয়ে এল। এই ঠান্ডা আবহাওয়াতে গরম চা পেয়ে সবাই খুব খুশি। যারা চা পেল না তারা অন্তত দোকানের খোঁজ পেল, ওদিকে গেলে চা খাওয়া যাবে।
আমিও জ্যেষ্ঠতার সূত্রে জায়গায় বসেই আওয়াজ দিয়ে এক কাপ চা পেয়ে গেলাম।

টুটুলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলাম। এখন ধীরে ধীরে দর্শক কমতে শুরু করেছে। আরও কিছুক্ষণ পর সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ঝপাৎ করে সূর্য অনেকটা উপরে চড়ে বসল। এটা দুপুরের সূর্যের মতোই কড়া। পাশের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে যেমন নতুন কোমলমতি বউয়ের ইমেজটা পাওয়া যায় না, তেমনি আমরা লাল আভা ছড়িয়ে সেজেগুঁজে ধীরে ধীরে প্রবীণ হওয়া সূর্যের স্বাদটা পেলাম না।

অগত্যা আমাদের চলে আসতে হল।
আমরা হোটেলে ফিরে এসে নাস্তা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার মনের গহীনে একটা চাপা ভয় রয়ে গেল যে কীর্তি আর মিতুল আকাশে উড়তে যাবে। ওদের যাওয়া দেখলে আমি হয়তো আরও অশান্তিতে পড়তে পারি, এ ভয় থেকে আমি আরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। হোটেলের সামনের সুইমিং পুলে ডুবসাঁতার দেওয়ার জন্য বেবী আমাকে ডেকে উঠাল সাড়ে দশটায়।

আমরা তাড়াতাড়ি সুইমিং-এর পোশাক আর হোটেলের টাওয়েল নিয়ে নিচে নেমে এলাম। আমি আর টুটুল চেঞ্জ রুমে গিয়ে হাফপ্যান্ট পরে চলে এলাম পুলসাইডে। তারপর চটপট নেমে পড়লাম চমৎকার পানিতে।
আমি তো নরসুন্দা পাড়ের ছেলে, ছোটবেলাতেই সাঁতার রপ্ত করেছি। অবলীলায় আমি সুইমিং পুলের এপাড় থেকে ওপাড়ে সাঁতার কাটতে লাগলাম।

ওদিকে টুটুল ছোটবেলা থেকেই শহরে মানুষ। সে একটা গোল টিউব বুকের নিচে নিয়ে অনেক কষ্টে সাঁতার কাটতে শুরু করল। এদিকে বেবী আর বন্যা চেঞ্জ রুম থেকে মুখ আঁধার করে বেরুচ্ছে দেখে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ গৃহশান্তি বিঘ্নত হচ্ছে কেন? ওরাই তো সুইমিং পুলে নামার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল। এখন মুখ গোমরা করে পুলসাইড চেয়ারে বসতে যাচ্ছে কেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
বেবী মুখটাকে একটু গাব্বু বানিয়ে বলল, “সুইমিং কস্টিউম না পরলে নামতে দেবে না।

সালোয়ার কামিজে হবে না। ”
“তাহলে ওদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পরে ফেল। ”
“চুপ কর। দুনিয়ার কত জায়গায় সালোয়ার কামিজ পরে সুইমিং পুলে নেমেছি। এখন নেপাল এসে এসব পরতে হবে?”
আমরা মনের।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।