বাঁচিতে চাহিনা এই নষ্ট ভুবনে...... ইভ টিজিংয়ের মতো ভয়াবহ ব্যাধি থেকে যখন এই সমাজ বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে, তখন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কতিপয় শিক্ষক ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করছেন, বিষয়টি সচেতন সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি আমার বিবেককে দগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। কেন আমাদের শিক্ষকেরা এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি না। শিক্ষকেরা মাতা-পিতার মতো। সন্তানসম একজন ছাত্রীকে কীভাবে যৌন নির্যাতন করতে পারেন?
সম্প্রতি এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঢাকাসহ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে।
এর ফলে শিক্ষকসমাজ ও দেশবাসীর মধ্যে আস্থার সংকটও কমবেশি তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের ওপর যৌন হয়রানির বিষয়টি দেশবাসীর নজরে এসেছে। রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুল বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই শিক্ষক এ অপকর্মের দায় স্বীকার করেছেন।
আরও তিনটি ঘটনা ঘটেছে ঈশ্বরদী, আখাউড়া ও সাতকানিয়ায়।
পাবনার ঈশ্বরদীতে বাশেরবাদা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. শামসুল ইসলাম। ছাত্রীটি শারীরিক অসুস্থতার জন্য পিটিতে যোগ না দিয়ে তার শ্রেণীকক্ষে এক সহপাঠীর সঙ্গে অবস্থান করছিল। এ সময় প্রধান শিক্ষক সহপাঠীকে শ্রেণীকক্ষ থেকে বের করে দিয়ে ছাত্রীটিকে যৌন নির্যাতন করেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই শিক্ষককে চার মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভার দেবগ্রাম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক শামসুল ইসলাম (৩৫) কর্তৃক ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির জন্য মামলা হয়েছে।
জানা গেছে, ওই শিক্ষক এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটাতেন। সর্বশেষ দিনের ঘটনা ছাত্রীটি তার মাকে জানালে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয় আখাউড়া থানায়।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটিয়েছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কেরানীহাট আশ শেফা বিদ্যালয়ের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন (২৭)। স্কুলের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে সাতকানিয়া ছদাহা আদর্শ মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকালে হেলাল উদ্দিন একই অভিযোগে বরখাস্ত হন বলে জানা গেছে।
এই কয়েকটি ঘটনা সংবাদপত্রে এসেছে বলে এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। কিন্তু এ রকম অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায় বলেও শোনা যায়। যদি তা সত্য হয়, তাহলে এটা আমাদের সমাজ, শিক্ষক তথা পুরো জাতির জন্য লজ্জাজনক। এ লজ্জা থেকে আমরা কীভাবে রেহাই পাব, সেটা এখনই আমাদের ঠিক করতে হবে। এ জন্য দেশের শিক্ষকসমাজ, অভিভাবক, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সাধারণ মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন।
এর সঙ্গে প্রয়োজন রাজনৈতিক মহল, পুলিশ ও আইনজীবীদের নির্যাতনবিরোধী কঠোর অবস্থান।
ছাত্রীদের উচিত এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের জানানো। অভিভাবকদের উচিত হলো বিষয়টি স্কুলের ঊর্ধ্বতন মহল বা কমিটিকে জানানো। ভিকারুননিসা বসুন্ধরা শাখা কর্তৃপক্ষের মতো বিষয়টি চেপে না গিয়ে প্রথমেই উচিত হবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের ঘটনা চেপে যাওয়া মানে এর বিস্তারে সহায়তা করা।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত সভা বিশেষ ফল দিতে পারে।
এবার আসা যাক শিক্ষকসমাজ, স্কুলের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা কমিটির করণীয় বিষয়ে। গ্রেপ্তার হওয়া পরিমল জয়ধর, শামসুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিনসহ যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠবে, তাঁদের সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
চাকরির জন্য শিক্ষকেরা আবেদন করলে এ সংবাদগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, অভিযুক্ত কেউ আবেদন করেছেন কি না। দেশের প্রতিটি স্কুল যদি এ ধরনের সংবাদ সংরক্ষণ করে, তবে ঘৃণিত শিক্ষকেরা দেশের যেকোনো প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করুন না কেন, তাঁরা ধরা পড়বেন।
এ ছাড়া আবেদনকারী শিক্ষক যে এলাকার বাসিন্দা সে এলাকার সংশ্লিষ্ট থানা বা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। সাতকানিয়ার হেলাল উদ্দিন এ ধরনের অপকর্মের দায়ে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরও, একই উপজেলার আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর চাকরি পাওয়ার ঘটনা তাকে সাহসী করে তুলেছে। পরিমল জয়ধরের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আর সাধারণ মানুষ এ ধরনের শিক্ষকদের প্রতি ঘৃণা জানাবেন তাঁদের সামাজিকভাবে ‘বয়কট’ করে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-বন্ধুদের উচিত হবে এ ধরনের নামধারী শিক্ষকদের একঘরে করে দেওয়া।
এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের সম্পর্কে তদন্তে কোনো ধরনের দুর্বলতা বা শৈথিল্য দেখানো উচিত হবে না পুলিশের। আইনজীবীদের উচিত হবে, শুধু পেশাদারি নয় বিবেকের মাধ্যমে চালিত হওয়া। বিচারকেরা যদি এ ধরনের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ না পান, তবে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নির্যাতিত ছাত্রী ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আইনি সহায়তা দিতে পারে। সর্বোপরি রাজনৈতিক কৃপালাভে যেন অপকর্মকারীরা ব্যর্থ হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে সব ধরনের রাজনৈতিক বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
আমার সন্তান বা বোন এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়নি—এমনটি ভেবে এ ধরনের অপরাধীদের বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, যারা এর শিকার হয়েছে তাদের মতো বোন বা কন্যাসন্তান আমারও আছে। এ ধরনের ঘটনা নির্মূলে আজ যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এগিয়ে আসবেন না, কাল যে তাঁর বোন বা কন্যার ক্ষেত্রে তেমনটি হবে না, সেটি কি নিশ্চিত করে বলা যাবে?
নারীরা কোথায় নিরাপদ?
সাম্প্রতিক দুটি খবর—স্বামী হাসান সাইদ কর্তৃক নির্যাতিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুর। শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষিত ভিকারুননিসা বিদ্যালয়ের ছাত্রী।
দুটি আলাদা ঘটনা হলেও দুটি ঘটনার মধ্যে মিল হচ্ছে দুটিরই শিকার নারী এবং দুটি ঘটনার দুই ব্যক্তিই শিক্ষিত, একজন আবার শিক্ষক।
একজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, অপরজন ভিকারুননিসার মতো নামকরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ রকম শিক্ষিত মানুষ দেশের সম্পদ অথচ এ রকম নৃশংস ঘটনাও ঘটান তাঁরা। কী বিচিত্র! আমরা আমাদের বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শান্তিতে থাকতে পারছি না। প্রতিনিয়ত চিন্তা করতে হবে, আমার বাচ্চা সেখানে নিরাপদ তো? নাকি পরিমলের মতো শিক্ষক এখানেও আছেন? আমরা কর্মস্থলেও নিরাপদ নই।
ছোটবেলা থেকে হেসেখেলে যে ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটা বড় হয়ে উঠছে, বন্ধুত্বের মিথ্যা আবরণে একসময় সেই ছেলেটিও হেসেখেলে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে কেড়ে নিচ্ছে মেয়েটির সর্বস্ব। বন্ধুত্বকে করছে অবমাননা। তাহলে আমরা বিশ্বাস করব কাকে?
এ পৃথিবীর কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই একটা মেয়ে নিরাপদ নয়। নিরাপদ নই আমরা মাতৃগর্ভেও। কন্যাশিশু হওয়ার অপরাধে বাবা নামের পুরুষটি নষ্ট করছে কন্যাশিশুর ভ্রূণটি।
তাই আজ সমাজের প্রতি আমার জিজ্ঞাসা,আমরা মেয়েরা আসলে কোথায় নিরাপদ? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।