good রাজনীতির খেলায় ক্ষত-বিক্ষত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রীতিমতো ‘ডেড লক’ হয়ে পড়েছে এর শিক্ষা কার্যক্রম। ছাত্রীরা ক্লাস রুম ছেড়ে রাজপথে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। প্রতিষ্ঠানের পেশাদার শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ-বিব্রত।
ভর্তি, নিয়োগ , পদোন্নতি এ প্রতিষ্ঠানের সর্বত্রই রাজনীতি। ছাত্রী উত্ত্যক্তকারী পরিমল জয়ধরের শাস্তি এবং তার আশ্রয়দাতাদের অপসারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যখন আন্দোলনে তখন এ নিয়ে শুরু হয় খেলা। এ খেলারই অংশ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জন অধ্যক্ষ নিয়োগ, নাটকীয়ভাবে পরিচালনা পর্ষদ বাতিল ও এডহক কমিটি গঠন। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানে আসলে কি ঘটছে? এসব পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন এক কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষক পরিচয়ে ছাত্রী উত্ত্যক্তকারী পরিমলের নিয়োগ থেকে শুরু করে যে করেই হোক তাকে রক্ষা- এসবই হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।
পরিমলের সঙ্গে আরও পাঁচ শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরিমলের অপরাধ ধামাচাপার চেষ্টায় অধ্যক্ষ প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাই তার অপসারণ নিয়ে যখন উত্তেজনা তৈরি হয় তখন সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাবোর্ড সর্বত্রই এর ঢেউ লাগে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এত দিন এ নিয়ে শিক্ষাবোডের্র কোন তৎপরতাই ছিল না। অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগমের অপসারণের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর হঠাৎ বোর্ডের ইউটার্ন।
সরকারের তরফে বোর্ডই সব করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে অধ্যক্ষের কক্ষে কথা হয় দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে। তারা জানান, সিনিয়র শিক্ষকসহ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আম্বিয়া খাতুনকে শিক্ষাবোর্ডে ডাকা হয়েছে। ওইসব শিক্ষকের দলে ছিলেন মিন্নাতুল মোহর, মঞ্জুয়ারা বেগম, রোকসানা শামীম, আখতারী বাশার ও সুফিয়া খাতুন। বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকেই ঘটে নাটকীয়তা।
বৈঠকে বসেই চেয়ারম্যান বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। পরিচালনা পর্ষদ অবৈধভাবে এ নিয়োগ দিয়েছে। তাছাড়া পর্ষদই বাতিল করা হয়েছে। তাই বিধিমোতাবেক আম্বিয়া খাতুন অধ্যক্ষ নন। চেয়ারম্যানের বক্তব্য মেনে নিতে পারেননি উপস্থিত শিক্ষকরা।
তারা প্রতিবাদ করেন। সবচেয়ে সিনিয়র আম্বিয়া খাতুনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত চান তারা। কিন্তু চেয়ারম্যান তার বক্তব্যে অবিচল থাকেন। হোসনে আরা বেগম ছুটিতে যাবেন জানিয়ে চেয়ারম্যান চলতি দায়িত্ব দেয়ার জন্য শিক্ষকদের পরামর্শ চান। এ সময় উপস্থিত শিক্ষকরা অনুরোধ করেন আম্বিয়া খাতুনকে দায়িত্ব দিতে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও চেয়ারম্যান আপত্তি করেন। বলেন, আম্বিয়া খাতুনকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। কোন কারণ ব্যাখ্যা করতে চাননি তিনি। বলেন, তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। সিনিয়র শিক্ষক আম্বিয়া খাতুনকে রেখে অন্য কাউকে নিয়োগ দিলে তাকে অপমান করা হবে বলে দু’জন শিক্ষক কান্নাজড়িত কণ্ঠে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন।
তাকে অন্তত তিন মাসের জন্য নিয়োগের অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু তাতেও চেয়ারম্যান রাজি হননি। বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। শিক্ষকরা বলেন, সিনিয়র হিসেবে নিয়োগ হলে আম্বিয়া খাতুনই অধ্যক্ষ হতেন। পরিচালনা পর্ষদও তাই করেছিল।
কিন্তু জেদের বশে সরকার তা কার্যকর করতে দেয়নি। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন মিন্নাতুল মোহর। তিনি এ সিদ্ধান্তে বিব্রতবোধ করেছেন। আম্বিয়া খাতুনকে বাদ দিয়ে তার নাম প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে প্রতিবাদটি জোরালো করেছেন।
অধ্যক্ষ পদের জন্য হোসনে আরার সঙ্গে তিনিও প্রার্থী হয়েছিলেন। দু’জনকে টপকিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা মঞ্জুয়ারাকে দায়িত্ব দেয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তার এ পরিচয়ের বাইরেও পরিচয় রয়েছে। বড় পরিচয় তিনি সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর খালা শাশুড়ি। তবে বোর্ড চেয়ারম্যান এ নিয়োগের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সিনিয়রিটির দিক বিবেচনা করলে প্রথমজনকে নিয়োগ দেয়া যেতো। আমি শিক্ষকদের কাছে নাম চাই। দ্বিতীয় সিনিয়র শিক্ষক নিজে দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করায় মঞ্জুয়ারাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
আম্বিয়া খাতুন বরাবরই শ্যাডো অধ্যক্ষ: সরকার কিংবা পরিচালনা পর্ষদের পছন্দের তালিকায় নাম না থাকলেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে তার আসন সবার উপরে। সবার পছন্দের তালিকায় শিক্ষক হিসেবে তার অবস্থান অনন্য।
বর্ণাঢ্য জীবন তার। এ প্রতিষ্ঠানেই আছেন তিন দশকের বেশি সময়। ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহের মুসলিম গার্লস স্কুল থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহের মোমেনুন নিসা সরকারি গার্লস কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে সেকেন্ড ক্লাস (৪র্থ ) ও ১৯৭৫ সালে একই বিভাগ থেকে সেকেন্ড ক্লাস (৪র্থ) নিয়ে মাস্টার্স পাস করেন।
তিনি ১৯৭৭ সালের ৩রা জানুয়ারি ভিকারুননিসার স্কুল শাখায় যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে একই প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখায় যোগ দেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তার রয়েছে নানা অর্জন। তার সহকর্মীরা বলেন, আম্বিয়া খাতুন ধার্মিক তবে গোঁড়া নন। তিনি বোরকা ও হিজাব পরেন।
শিক্ষক হিসেবে কলেজে অত্যন্ত জনপ্রিয় তিনি। বিলুপ্ত পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য বলেন, পর্ষদের সভাপতি দেশে নেই। সদস্য সচিব ৬ দিন ধরে ছুটি ছাড়া অনুপস্থিত। এ অবস্থায় বৈঠক করে সবার মতামত নিয়ে সিনিয়র হিসেবে আম্বিয়া খাতুনকে ভারপ্রাপ্ত করা হয়েছিল। এতদিন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও বোর্ড এগিয়ে আসেনি।
সঙ্কট নিরসনে পর্ষদের সদস্যরা যখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন পাল্টা পর্ষদই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আম্বিয়া খাতুনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সিনিয়র শিক্ষক বিবেচনাতেই। তিনি কোন রাজনীতি করেন না। একজন শিক্ষক বলেন, অধ্যক্ষ হোসনে আরাকে অপসারণ ও আম্বিয়া খাতুনকে অধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি সরকার।
সরকার পাল্টা অ্যাকশনে যায়। পর্ষদের বৈঠকে যে ৫ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন তাদের একজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আম্বিয়া খাতুনকে অধ্যক্ষ হিসেবে যাতে মেনে না নেয়া হয় এ জন্য একটি মহল অপপ্রচার চালায়। বলা হয়, তিনি মৌলবাদী। অথচ হোসনে আরা বেগম অধ্যক্ষ থাকাকালে আম্বিয়া খাতুনই তার সব কাজকর্ম করতেন।
সব বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাকে নিয়ে সরকার অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছে। আগামী ৩১শে অক্টোবর তিনি অবসরে যাবেন। তার স্বামী লিয়াকত আলী খানও শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে অধ্যাপনা করে এখন তিনি অবসরে।
নিঃসন্তান এ শিক্ষক দম্পতির প্রশংসা শোনা যায় ভিকারুননিসার শিক্ষকদের মুখে মুখে।
বিলুপ্ত পর্ষদের অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত চলছে: পোড় খাওয়া রাজনীতিক রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ভিকারুননিসার বহুল আলোচিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ফাহিমা খাতুন। গতকাল দুপুরে মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি কাজ করছে। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে পরিমলসহ এ আমলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের নিয়োগ বাতিল হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্তে অবৈধ প্রমাণ হলে আমরা বাতিলের জন্য মাউশিকে সুপারিশ করবো।
তিনি বলেন, ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখায় পরিমল জয়ধরসহ যে ৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তার পেছনে কারও উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝা যাচ্ছে। আশা করি, তদন্তে সব খোলাসা হবে। বোর্ডের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনেই বোর্ড হস্তক্ষেপ করেছে, এখানে অন্য কিছু নয়। আমরা পাল্টা অ্যাকশনে গিয়েছি- এটা ভাবা ঠিক নয়। প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদে কারা রয়েছেন তা আমরা আগেই জানতাম।
ঘটনার পরপর পর্ষদ পরিস্থিতি সামাল না দিয়ে হঠাৎ করেই হোসনে আরাকে অপসারণ করে আরেক জনকে নিয়োগ দিয়েছে। এর পেছনে অবশ্যই বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। মঞ্জুয়ারা বেগমকে কোন বিবেচনায় অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়েছে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।