লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। রাইটার্স ব্লক
মোহাম্মদ ইসহাক খান
তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন কাগজটার দিকে। কাগজে পরপর অনেকগুলো লাইন লেখা আছে।
সবগুলো একই বাক্য।
আমি কিছু লিখতে পারছি না।
আমি কিছু লিখতে পারছি না।
আমি কিছু লিখতে পারছি না।
আমি কিছু লিখতে পারছি না।
আমি কিছু লিখতে পারছি না।
আমি কিছু ... ...
তাঁর সহসা রোখ চেপে যায়। দলামোচড়া করে কাগজটাকে পাকিয়ে নিক্ষেপ করেন মেঝেতে। তখনই খেয়াল হয়, তিনি এতক্ষণ ধরে কী করেছেন।
মেঝেতে পড়ে আছে অসংখ্য কাগজ, ঠিক এই কাগজটির মতো, যেটা একটু আগে তিনি ছুঁড়ে ফেললেন।
দলা পাকানো কাগজ, রাশি রাশি কাগজ, যেন তিনি অনেক কাগজের ভেতরে ডুবে আছেন।
তাঁর মাথার ভেতর যন্ত্রণা হয়। ভোঁতা, কিন্তু সাংঘাতিক যন্ত্রণা। অক্ষমতার যন্ত্রণা, লিখতে না পারার যন্ত্রণা। আজ সাতদিন ধরে তাঁর কলম থেকে একটি গল্পের লাইন বেরোয় নি।
নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তাঁর, জরাগ্রস্ত, অথর্ব, পঙ্গু, অক্ষম বলে মনে হচ্ছে। কলমটাকে মনে হচ্ছে এমন একটি অস্ত্র, যার গুলি ফুরিয়ে গেছে, শতবার ট্রিগার চাপলেও কোন লাভ নেই। তবুও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অথচ তিনি গত কয়েক বছর ধরে কত সহজেই না লিখে গিয়েছিলেন। একজন লেখকের লেখার জন্য কত ভাবনার দরকার হয়, একটি গল্পকে মাথার ভেতরে তৈরি করতে, সেটার রূপরেখা দাঁড় করাতে কত নির্ঘুম রাত কেটে যায়।
তাঁর এসবের বালাই ছিল না। তিনি লিখতেন যেন বাতাসের বেগে। মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ভরিয়ে ফেলতেন পাতার পর পাতা। একই সাথে চলত তাঁর চিন্তা আর লেখা, ভাবতে ভাবতেই লিখে ফেলতেন চমৎকার সব গল্প। গল্প লেখার জন্য তাঁর একটা শর্তই ছিল, লিখতে বসা।
বসলেই কিছু না কিছু একটা তৈরি হয়ে যেত।
একজন প্রতিষ্ঠিত গল্পকারকে প্রকাশকের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকতে হয়। বইমেলা, ঈদ, পুজো এসব উপলক্ষে একটা না একটা লেখা জমা দিতে হয়। শুধু লেখা হলেই হয় না, ভাল লেখা হতে হয়, যাতে পাঠক আমোদ পায়। অনেক লেখকের সেই ক্ষমতা থাকে না, তাঁরা সময় নেন, তারপর নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর লেখা শেষ করতে না পেরে সময় পিছিয়ে দেন।
তাঁর ভেতরে এই সমস্যা কখনোই ছিল না। তাঁর কাছে সবসময় দুটো-তিনটে লেখা তৈরি থাকতো। প্রকাশক হয়তো আবদার করতে এসেছেন, ভাই, সামনের সপ্তাহে কিন্তু একটা লেখা দিতেই হবে, সময় অতি অল্প। জানি, আপনার জন্য একটু জুলুম হয়ে যাবে, কিন্তু কী আর করা, আমরা তো প্রকাশনীর লোক, ব্যবসায়ী, আমাদের কিছু নিয়ম মানতেই হয় ... ...
মুখের কথা শেষ হবার আগেই তিনি উঠে গেছেন। দেরাজ খুলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বের করে এনেছেন একটা নতুন গল্পের পাণ্ডুলিপি।
প্রকাশক তো হতবাক। আপনি আগেই লিখে রেখেছেন?
লেখকের সাদামাটা শান্ত জবাব, পড়ে দেখুন কেমন লাগে। ভাল না হলে আরেকটা আছে।
প্রকাশক আনন্দে গদগদ হয়ে, ধন্যবাদ দিতে দিতে চলে যেতেন। অন্য লেখকেরা সব ভাবের জগতে বাস করেন, একটা নতুন লেখা চাইলে এমন করুণা মেশানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন যেন পায়ে না ধরলে লেখা দেবেন না।
খ্যাতির বিষ একেই বলে। আর এই লেখক? তিনি অন্য সব বিষয়ে নির্লিপ্ত, কিন্তু একটি লেখা চাইলে কখনো না করেন না। এত দ্রুত, এত বেশি, এতদিন ধরে একটানা, কোন বিরতি ছাড়াই লেখার ক্ষমতা অবহেলা করার নয়। লেখালেখি শুরু করার পর এমন একটি দিনও যায় নি, যে দিন তিনি কিছু না কিছু লেখেন নি।
তাই বলে কি তাঁর লেখা সস্তা? তিনি কি সময় বাঁচাতে যেমন-তেমন একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দেন? মোটেই না।
তাঁর লেখা স্বচ্ছ, সুন্দর, আর অত্যন্ত প্রাঞ্জল; বিদঘুটে দুর্বোধ্য নয়। প্রথম পাতাতে যদি কেউ চোখ বুলোয়, তাহলে গল্পের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সে যেতে বাধ্য। তাঁর প্রতিটি লেখা পড়লেই বোঝা যায়, অসম্ভব মমতা নিয়ে তিনি লিখেছেন। লেখা তাঁর সত্তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তিনি লেখার মধ্যে বাস করেন, লেখালেখি আর এই লেখককে আলাদা করা কখনো অসম্ভব। নিজের কাজের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা না থাকলে এটা হতো না।
তাই তো তিনি অল্পদিনেই সব পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন, মন জয় করেছেন, প্রিয় গল্পকার তথা গল্প-বলিয়ে হয়ে উঠেছেন। জাতীয় জীবনের সমস্যা নিয়ে কাঠখোট্টা উপন্যাস নয়, দাঁতভাঙা শব্দচয়নে মানব মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ নয়, তাঁর এক-একটি গল্প অতি সহজ ভাষায় বর্ণিত সাদামাটা বাস্তব, যেটা পাঠক ভীষণ পছন্দ করে। তারা বিশ্বাস করে, গল্পগুলোতে লেখক মন থেকে চেয়েছেন পাঠকের কাছে আসতে, তাদেরকে একটা সুন্দর গল্প শোনাতে।
লেখা নিয়ে ছিলেন তিনি, ভালোই ছিলেন, সুখে ছিলেন। মনের আনন্দে তৈরি করে চলেছিলেন একের পর এক গল্প।
কোনদিন থামতে হবে, থমকে দাঁড়াতে হবে, নিরবচ্ছিন্ন গল্প লেখায় ছেদ পড়বে, তিনি ভাবেন নি। ভাবেন নি বলেই, প্রস্তুতি নেন নি বলেই কীনা আজ এই সমস্যাটি ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তিনি রাতদিন ভাবছেন, লেখার চেষ্টা করছেন, হচ্ছে না। কলম খুলে বসছেন, কয়েক লাইন, নিদেনপক্ষে একটি বাক্য লেখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেটিও যখন পারছেন না, তখন তাঁর চোখ ফেটে কান্না আসছে।
এই সমস্যাটির নাম "রাইটার্স ব্লক।
" জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে প্রায় সব লেখকই এই অসুখে পড়েন। সমস্যাটি আপাতদৃষ্টিতে এমন গুরুতর কিছু নয়, কিন্তু একজন লেখকের জন্য কালব্যাধির চেয়েও খারাপ, কুৎসিত, অসহনীয়। কারণ লেখা তো শুধু তাঁর পেশা নয়, তাঁর জীবন, তাঁর খোরাক, তাঁর অস্তিত্ব, তাঁর পরিচয়। কাজেই যখন একজন লেখক লিখতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু সাদা কাগজের ওপর কয়েকটি আঁকিবুঁকি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না, তখন অস্থির হয়ে যান।
অনেক দেশী এবং বিদেশী বরেণ্য লেখককে এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
তাঁদের নাম আর না-ই বা বলি। একজন লেখকের অনেক ক্ষমতা, হাজার হাজার পাঠককে হাসাতে পারেন, আবার আকুল করে কাঁদাতে পারেন, কিন্তু এই অসুখটি তাঁদেরকে করে দেয় খুব অসহায়। প্রথম অবস্থায় হতাশা এবং ক্ষোভ জন্মায়, তারপর দেখা দেয় নানারকম মানসিক বিকার। মস্তিষ্কের যুদ্ধ চলতে থাকে এই মানসিক সমস্যাটির সাথে, সে নানা উপায়ে একে ঠেকানোর চেষ্টা করতে থাকে। কোন কোন লেখক পাগল হয়ে যান, কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, অথবা সবার সাথে অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকেন, কেউ বা অসম্ভব খিটখিটে হয়ে যান, লেখালেখির ওপর ঘেন্না ধরে যায়; আর যদি মন খুব সবল হয়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তাহলে কয়েকটি বিরল ক্ষেত্রে এই সমস্যা কোন অজানা উপায়ে কাটিয়ে ওঠেন।
আমাদের এই লেখকের কাছে ফিরে আসি। তিনি এখন একটির পর একটি কাগজ কুচিকুচি করে ছিঁড়ছেন। যেন সব দোষ এই কাগজগুলোর, যেন এরাই তাঁকে লিখতে দিচ্ছে না।
কাগজগুলোকে পায়ের নিচে ফেলে পদাঘাত করতে লাগলেন তিনি। কলমটাকে ছুঁড়ে ফেললেন দূরে।
কেন তিনি লিখতে পারছেন না, কেন?
ভয়াবহ বিষণ্ণতা তাঁকে পেয়ে বসলো, সদা হাসিমুখ শুভ্র চেহারায় কয়েক পোঁচ কালি লেপে দিলো যেন কেউ। আহারে মন রইলো না। কী করেই বা থাকবে? এই খাবার তো দেহের খোরাক। কিন্তু লেখা? লেখা তো তাঁর জন্য আরও প্রয়োজনীয়, আত্মার খোরাক। তা না থাকলে, লিখতে না পারলে তিনি কেমন করে খেতে বসবেন? কাজেই শুকনো রুটির টুকরো তাঁর গলায় আটকে যেতে লাগলো, নিচে নামতে চাইলো না কিছুতেই।
তিনি খাবারের পাত্র পাশে সরিয়ে রেখে ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন। কপালের ওপর হাত রেখে, চোখ আড়াল করে।
এপাশ-ওপাশ করেন তিনি, ঘুম আসে না। বুকের ওপর চেপে বসে আছে যেন একটা ভারী পাথর, এই পাথর যতক্ষণ না সরছে, তাঁর সুনিদ্রা হবে না।
তিনি চোয়াল শক্ত করেন।
আবার চলে আসেন তাঁর লেখার ঘরে, কলম তুলে নেন। পারবো আমি, নিশ্চয়ই পারবো। আমার লেখার ক্ষমতা আছে, নইলে এতদিন কী করে লিখলাম? কে বলেছে আমি লিখতে পারছি না? এই দেখো, হাতে কলম যখন নিয়েছি, লিখতে যখন বসেছি, কিছু একটা লিখবোই। এই শুরু করলাম ... ...
তাঁর হাত কেঁপে ওঠে। কম্পিত হাত থেকে কলম পড়ে যায়।
অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ করেন, তাঁর হাতে কলমটি খানিকক্ষণ অবস্থান পর্যন্ত করতে চাইছে না।
লেখক ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ঘরের দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকছেন তিনি। এই মাথার ভেতরে কত অনায়াসে জন্ম নিয়েছে কতশত গল্প, সুন্দর সুন্দর নিটোল গল্প, আজ তারা কোথায় চলে গেল? বিশ্বাসঘাতক কলম, নিষ্ঠুর কাগজ! কেন আমার সাথে তোমাদের এত শত্রুতা? কী অপরাধ করেছি আমি? কেন তোমরা আমাকে একটু দয়া করছ না?
রাত গভীর হচ্ছে, লেখক ক্লান্ত দেহে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিছু একটা, অতি সামান্য হলেও কিছু একটা লেখার। কিন্তু তাঁর লেখা হচ্ছে না।
জোর করে কলম দিয়ে কাগজের ওপর দাগ কেটে কিছু লিখতে গেলে হয়ে যাচ্ছে বিদঘুটে কোন আঁকিবুঁকি, সেটাকে "লেখা" বলা চলে না। এই মুহূর্তে তাঁকে দেখলে মনে হবে, দুর্বল কোন ছাত্র ভীষণ জটিল একটি অংক মেলাতে চেষ্টা করছে, পারছে না।
প্রথমদিকের ক্ষোভ তাঁর স্তিমিত হয়ে গেছে বেশ আগেই। এখন তিনি মিনতি করে চলেছেন। মনে মনে গুমরে যাচ্ছেন প্রতিটি মুহূর্তে।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে লাগলেন, হে পরম করুণাময়! আমাকে সবার সামনে অপমান কর, আমার সবকিছু কেড়ে নাও, আমি কিছু মনে করবো না, কোন অভিযোগ করবো না। কিন্তু আমার লেখার ক্ষমতা কেড়ে নিও না। লেখাই আমার সব। আমাকে একটু দয়া কর, আমাকে একটু দয়া কর। তিনি বারবার করে বলতে লাগলেন, হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।
চাঁদনী রাত। তিনি বসে আছেন তাঁর বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায়। উতলা বাতাস আর জোছনা এসে লুটোপুটি খাচ্ছে সেখানে, পুরো বারান্দাকে যেন ধুয়ে দিচ্ছে জোছনার কোমল, পবিত্র, শাদা আলো।
লেখকের স্ত্রী এসে তাঁর পাশে বসেছেন। কিছুদিন ধরে লক্ষ করে চলেছেন প্রিয়তমের এই অবস্থা।
কিন্তু তিনি কী করবেন? তাঁর তো কোন ক্ষমতা নেই এই লেখককে একটি লাইন লিখে দিয়ে সাহায্য করার। তাই তিনি তাঁর সাধ্যের মধ্যে যতটুকু আছে, ততটুকুই করছেন। স্বামীর হাতটি কোলের ওপর নিয়ে বসে আছেন। মুখে বলে কী সান্ত্বনা দেবেন, তা তাঁর জানা নেই।
দু'জন চুপচাপ।
কেউ কথা বলছেন না।
লেখকের স্ত্রী এবার সাহস করে নীরবতা ভঙ্গ করলেন।
কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছ?
হুঁ। লেখক বিশেষ সাড়া দিলেন না।
তুমি কিন্তু তাকিয়ে দেখনি।
দেখোই না।
লেখক অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালেন। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। রুক্ষ মাটি আর পাথর দিয়ে ঢাকা চাঁদ। কলঙ্কযুক্ত চাঁদ।
কিন্তু তবুও, সৃষ্টির শুরু থেকেই, পৃথিবীতে মানবের বসতি শুরু হবার পর থেকেই এই চির পরিচিত চাঁদটি কেমন একটা রহস্যময়তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সবার কাছে, আজও যে রহস্যময়তা রয়ে গেছে।
লেখক ওপর দিকে তাকিয়ে আছেন, অপলক দৃষ্টিতে দেখছেন চাঁদ। জোছনার আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে।
শুনছ?
বল।
তুমি কিছুদিন ধরে লিখতে পারছ না, তাই না?
লেখক জবাব দেন না।
তাঁর বুকটা আরও ভারী হয়ে উঠেছে।
কথা বল।
এবার লেখকের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি তাঁর কোলের ওপর পড়ে।
তাঁর স্ত্রী পরম মমতায় মুছিয়ে দেন সে অশ্রু। আমার মনে হয় কি জানো?
কী?
তুমি আবার লিখতে পারবে।
আগের মতোই।
কী করে? আমি একটি লাইনও লিখতে পারছি না। একটি শব্দ না, একটি অক্ষরও না। আমার মস্তিষ্ক কোন গল্প তৈরি করতে পারছে না, আমি ফুরিয়ে গেছি। আমার ক্ষমতা শেষ।
সেটা মিছে কথা।
তুমি এত নিশ্চিত হলে কী করে?
আমার মন বলছে। তুমি সারাদিন, সারারাত নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ - একটি গল্প তৈরি করার জন্য। পারছ না। সেজন্য দুঃখ করছ কেন? গল্পকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আসতে চাইছ কেন? একটু সময় নাও, একটু বিরতি দাও, গল্প নিজেই আসবে তোমার কাছে।
সত্যি বলছ? লেখককে হঠাৎ কূল পাওয়া একজন ডুবন্ত মানুষের মতো দেখায়।
সত্যি বলছি। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। তুমি একটু নিশ্চিন্ত হও। আমি তোমার কষ্ট আর দেখতে পারছি না।
নিজেকে আর দোষী ভেবো না।
লেখকের সত্যিই নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়। ঠিকই তো, কয়েক দিনের জন্য একটু থামলে কী এমন ক্ষতি হবে? গল্প চলে গেছে, আবার আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে ছুঁয়ে বলেছেন, কাজেই এই আশ্বাস মিথ্যে হতে পারে না।
তিনি স্ত্রীর হাতের ওপরে নিজের হাতের স্পর্শ দৃঢ় করেন। বলেন, আমাকে একটা গান শোনাবে?
কোন গানটা বল তো?
ঐ যে, তুমি সবসময় গাও, তোমার খুব প্রিয়।
ও, সেই গানটা?
হ্যাঁ, সেই গানটা।
লেখকের স্ত্রী আর মানা করেন না। ধীরে ধীরে তিনি গান ধরেন।
ভরাট কণ্ঠে গান। জোছনার স্নিগ্ধ আলোর সাথে মিশে সে গানটিকে কি মধুময়ই না শোনায়।
লেখকের মনে হল, লেখালেখির আর দরকার নেই, তিনি প্রেয়সীর এই গানটি শুনে আর গোল থালার মতো দেখতে ঐ রূপোলী চাঁদটির দিকে তাকিয়ে হাজার বছর পার করে দিতে পারবেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে গান শুনতে লাগলেন, আর স্ত্রীর কোমল গালের ওপর জোছনার খেলা দেখতে লাগলেন।
***
লেখক তাঁর ঘরে বসে আছেন।
উল্টেপাল্টে দেখছেন কিছু বই। ভাল লাগলে একটি পড়া শুরু করবেন।
একটা বই টেনে নিতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন। হঠাৎ তাঁর শরীরে ভীষণ কাঁপুনি শুরু হয়েছে।
চোখ বন্ধ করলেন তিনি।
শ্বাস নিতে পারছেন না। কিছু একটা হয়েছে তাঁর, মনে হচ্ছে, তীব্র আলো তাঁর সারা শরীর ভেদ করে ঢুকে পড়ছে, আর তাঁকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
কীসের আলো এটা? নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন তিনি। কিছু একটা তাঁর শরীরে, তাঁর মনে ঢুকে পড়ছে, গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁকে।
সহসা আলোটা নিভে গেল।
তিনি আবার স্বাভাবিক বোধ করলেন। এই কয়েকটি মুহূর্তে আসলে কী হয়েছিল, তাঁর বোধগম্য হল না।
তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে টেবিলে রাখা কাগজ আর কলমের দিকে। সেগুলো তাঁকে যেন ডাকছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে, এসো, আমরা তৈরি।
একটি গল্প তৈরি করার জন্য তৈরি। খানিকটা বিষণ্ণ কি ওরা? লেখকের সাথে ভীষণ দুর্ব্যবহার করেছে যে।
তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নিলেন কলম। সহসা মনে হল, এবার তিনি পারবেন।
হ্যাঁ, সত্যিই তিনি পারবেন। স্পষ্ট অনুভব করলেন, তাঁর ভেতরে জন্ম নিয়েছে নতুন একটি গল্প। আনকোরা নতুন একটি গল্প।
তিনি চেয়ারে বসে লেখা শুরু করেন। তাঁর চোখ দিয়ে আবার জল পড়ছে।
ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তাঁর, ঠিক পিতৃত্বের আনন্দের মতো, যেন তিনি একটি শিশুর জনক হতে যাচ্ছেন। সেই শিশু কিছুক্ষণের মধ্যেই চিৎকার করে পৃথিবীতে তার অধিকার, তার আগমনবার্তা ঘোষণা করবে। হাত-পা ছুঁড়বে, হাসবে, খেলবে।
পাতার পর পাতা তিনি লিখে যেতে থাকেন, আবার আগের মতো সাবলীল গতিতে। অন্য কিছুর দিকে খেয়াল নেই তাঁর।
খেয়াল নেই বলেই লক্ষ করলেন না, ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী-ও চোখ মুছছেন।
(১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।