আমি সত্য জানতে চাই
(ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী)
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হলেও এরই মাঝে আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে চরম আত্মত্যাগ। ত্রিশলক্ষ শহীদ, দুইলক্ষ বীরাঙ্গনা আর আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারান, সব মিলিয়ে নতুন বাংলাদেশ আনন্দের জোয়ারে ভাসলেও বেদনা হয়ে উঠে তার সঙ্গী। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে এ দেশের সূর্য সন্তানদের।
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলা পিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
এঁদের মধ্যে রয়েছেন- ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য. ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাববী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতনচন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেকে।
তাঁদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অংশ হিসাবে তিনি অপহৃত ও পরে শহীদ হন। বাংলা ভাষার গবেষক ও শিক্ষাবিদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর জন্য আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
মননশীল প্রবন্ধকার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯২৬ সালের ২২ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার খালিশপুর গ্রামে। তাঁর পিতা বজলুর রহিম চৌধুরী ও মাতা মাহফুজা খাতুন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তান। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাবা ছিলেন সেকালের ম্যাট্রিকুলেট। মাত্র নয় বছর বয়সেই তিনি তাঁর সাহিত্যরসিক বাবাকে হারান।
তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে মামার আশ্রয়ে।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৪২ সালে নোয়াখালীর আহমদিয়া হাই ইংলিশ স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশনের অধীনে অনুষ্ঠিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
এই কৃতিত্বের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী শান্তিনিকেন্তন ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পেশাগত জীবন শুরু হয় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে। এখানে তিনি ১৯৪৯ সালে 'স্ক্রিপ রাইটার' হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তিনি এসময় সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ (বর্তমান নটরডেম কলেজ)-এও খন্ডকালীন অধ্যাপনা করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই প্রাবন্ধিক ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (School of Oriental and African Studies)-এ ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি লাভ করেন। সেখানে দুই বছর গবেষণা করার পর কথ্য বাংলার শব্দের ছন্দোবিজ্ঞানের ওপর একটি অভিসন্দর্ভ লেখেন, কিন্তু তাঁর গবেষণার ধরন তৎকালীন মার্কিন ধারার ভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণাপন্থার অতিমাত্রায় অনুসারী ছিল বলে এই অভিসন্দর্ভটি প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়নি। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমী থেকে এটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও রচনাবলিঃ
১।
Some Supra-Segmental Phonological Features of Bengali (1959).
২। Unpublished thesis. School of Oriental and African Studies. London.
৩। Colloquial Bengali (1963 and 1966). Bangla Academy. Dhaka.
৪। বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার (১৯৬২)। ঢাকা।
৫। রবি পরিক্রমা (১৯৬৩)। ঢাকা।
৬। সাহিত্যের নব রূপায়ণ (১৯৬৯)।
ঢাকা।
৭। রঙীন আখর (১৯৬৩)। ঢাকা।
এছাড়াও জীবদ্দশায় তাঁর প্রচুর অপ্রকাশিত রচনা ছিল।
এগুলো সাহিত্য-বিষয়ক গবেষণা, ব্যক্তিগত ও সৃষ্টিশীল রচনা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, চিঠি ও ভাষাবিজ্ঞান - এ ছয়টি ভাগে ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে ভাষাবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কর্তৃক সঙ্কলিত ও সম্পাদিত মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রচনাবলী শিরোনামে তিন খন্ডের বই আকারে ১৯৭৮, ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়।
১৯৬৪ সালে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাষাবিজ্ঞান পড়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এ চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। একই বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা রীডার (পরবর্তীতে এ পদের নাম বদলে সহযোগী অধ্যাপক করা হয়) পদে নিযুক্ত হন।
সাহিত্যে গবেষণার জন্য তিনি ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী তাঁকে তাঁর কনিষ্ঠ ভাই লুতফুল হায়দার চৌধুরীর বাসা থেকে অপহরণ করে। এর পর তাঁর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় ঐ দিনই তাঁকে হত্যা করা হয়।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর আজ জন্মদিন।
জন্মদিনে তাঁর জন্য আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ফুলেল শুভেচ্ছা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।