আমি সত্য জানতে চাই
আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক পঞ্চাশের দশকের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজ উপেক্ষিত এক বিস্মৃত নাম। অথচ মননশীলতার ক্ষেত্রে সাহিত্যে তার অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার মতো নয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ সারা দেশে তাঁর সুনাম ও খ্যাতি বিস্তৃত। একান্ত নিভৃতচারী, ঐতিহ্যসচেতন ও আদর্শনিষ্ঠ এই জ্ঞানসাধক ও সাহিত্যসেবকের লেখালেখি বা রচনার পরিমাণও একেবারে কম নয়। আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম মননশীল গদ্যশিল্পী, সমালোচক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের বহু বিচিত্র বিষয়াভিসারী রচনাগুলো বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার ন্যায্য দাবিদার।
কিন্তু যোগ্য হাতের কলমে তার সৃষ্টিকর্ম মূল্যায়নের অভাবে বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান বা স্থান নির্ধারণের বিষয়টি অপরীক্ষিতই রয়ে গেছে। ১৯৯২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাঙলা সাহিত্যের নিভৃতচারী এই লেখক। আজ তাঁর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রাবান্ধিক আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জ্ঞানতাপস আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক ১৯২৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার জাটিয়া ইউনিয়নের বড়ইবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৩৬১ বঙ্গাব্দে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মুহাম্মদ ইসহাকের লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। পরিণত বয়সে তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক দেশ, দৈনিক পয়গাম, দৈনিক জাহান, আজকের বাংলাদেশ, আজকের স্মৃতি, দৈনিক ভূমণ্ডল প্রভৃতি জাতীয় ও আঞ্চলিক কাগজে লেখালেখি করেন। তেমনি মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক আল-ইসলাহ, মাসিক জালালাবাদ, জাগরণ, শিখা, চিন্তা, মহুয়া, ঊষশী, শীষ, জনমত, কলতান, মাসিক মদীনা, নেদায়ে ইসলাম, সাপ্তাহিক জাহানে নও, মাসিক নওরোজ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত তার রচনা পত্রস্থ হয়। বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, রিয়াজ উদ্দীন মাশহাদী, মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এয়াকুব আলী চৌধুরী, এস ওয়াজেদ আলী, সৈয়দ এমদাদ আলী, অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ আদর্শনিষ্ঠ মননশীল লেখক যে-সাহিত্যধারা সৃষ্টি করেছিলেন, সেই ধারারই অন্যতম যোগ্য উত্তরসূরি আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক।
মুহাম্মদ ইসহাকের রচনায় বহু বিচিত্র বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে।
ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, সমস্যা, বিতর্ক, পত্র, জীবনচরিত, সমালোচনা ইত্যাদি বিষয়ে তার লেখনীর সক্রিয়তা দেখে আমরা বিস্ময় বোধ করি। আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গন্থসমূহঃ
১। মিলাদ ও কিয়াম সমস্যা (১৩৭৫), ২। ১২ই রবিউল আউয়াল (১৩৭৫), ৩। মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের অবদান (১৯৭০), ৪।
সাহিত্য বিচিত্রা (১৯৭১), ৫। রবীন্দ্রনাথ, ৬। হিন্দুধর্ম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ (১৩৭৬), ৭। প্রীতিকথা (১৩৭৬), ৮। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভূমিকা (১৯৭০), ৯।
আল-কোরান: বিশ্বমানবের জন্যে (১৯৭১), ১০। হৃদয় আমার কথা কয় (কবিতা, ১৯৭৯), ১১। ফুরফুরার পীর হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রহ: (১৯৮০), ১২। উজ্জীবিত আত্মা (কবিতা, ১৯৮৬) ১৩। বিতর্ক বিচিত্রা (১৯৮৮), ১৪।
কবি লায়লা রাগিব (১৯৯০) ১৫। ময়মনসিংহ জিলায় ইসলাম প্রচার ও মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধি (১৯৯৫, লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত)। এছাড়াও প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে লেখকের আরো অন্তত ১৩-১৪টি পাণ্ডুলিপি। জ্ঞানতাপস আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের আজীবন একনিষ্ঠ সাধনার ফসল এসব সাহিত্যকর্ম।
আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।
তার রচিত ‘বলাকার কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যুমাধুর্য’ প্রবন্ধ দু’টি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রথম প্রকাশিত হয়। ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দুই দল সাহিত্যসেবকের মধ্যে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখন উভয় দল থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে মুহাম্মদ ইসহাক রবীন্দ্র-মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হন। বিভিন্ন মাসিক ও দৈনিক কাগজে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তার গবেষণামূলক ও তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধ নিয়েই ‘রবীন্দ্রনাথ, হিন্দুধর্ম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এটিই ছিল তার সমকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ।
লেখক জীবনের শুরু থেকেই আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমালোচক সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় কবি গোলাম মোস্তফা পরিচালিত ‘মাসিক নওবাহার’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুল-বিরোধী লেখালেখির যথোচিত সমালোচনা করে জনাব ইসহাক দৈনিক আজাদ ও মাসিক আল-ইসলাহ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এ-সংক্রান্ত আলোচনা দৈনিক আজাদের সাহিত্য-বিভাগে মাসব্যাপী প্রকাশিত হয়। এর ফলে মাসিক নওবাহারের নজরুল-বিরোধী আস্ফালন থেমে যায়।
আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক ছিলেন আদর্শনিষ্ঠ মননশীল লেখক।
তিনি ছিলেন জ্ঞানের সাধক। ধর্মনিষ্ঠ হলেও ফ্যানাটিজম বা ধর্মান্ধতা তাকে আক্রান্ত করেনি। তার বিশ্বাসের তরুমূলে জল ঢেলেছে ইসলামের সুমহান আদর্শ। ইসলামের স্বরূপ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ইসলামের ধাতুগত অর্থ শান্তি ও আত্মোৎসর্গ। কাজেই ইসলাম কোনো জাতি বিশেষের ধর্ম হতে পারে না, ইসলাম সমগ্র মানবজাতির ধর্ম ও জীবনাদর্শ।
সংকীর্ণতার স্থান ইসলামে নেই। কারণ কোনোরূপ সংকীর্ণতা মানুষের ধর্ম নয়। সাহিত্য মানুষের জন্য এ বিশ্বাস ও প্রত্যয় ছিল তার অন্তরে প্রোথিতমূল। জ্ঞানের নিরলস চর্চায় তিনি অর্জন করেন এক উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তাই মানবতার সেবায় ও কল্যাণে তিনি নিবেদন করেছেন তার কলমসাধনাকে।
সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে, অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদর্শের লড়াইয়ে কলম ছিল তার নিরাপস হাতিয়ার। আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বাসের বিরুদ্ধ স্রোতে গিয়ে তিনি কখনো প্রতিষ্ঠা কামনা করেননি। চলতি হাওয়ার পন্থী ছিলেন না বলে হুজুগপ্রিয়তাকে মনেপ্রাণে অপছন্দ করেছেন। স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক ছিলেন সত্য ও সুন্দরের পথে নির্ভীক কলমসৈনিক। সুফিজম বা মরমিবাদের প্রভাব ছিল তার মনোলোকে।
পরম সুন্দরের সাক্ষাৎলাভের জন্যে তার বিরহী অন্তরে ছিল অন্তহীন ব্যাকুলতা। তার মনোভূমি নির্মাণে ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা রুমি, আল্লামা ইকবাল, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের আধ্যাত্মিকতা প্রভাব বিস্তার করেছে।
১৯৯২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন জ্ঞানতাপস আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক। আজ তাঁর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। একান্ত নিভৃতচারী আদর্শনিষ্ঠ মননশীল লেখক আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।