“বাঙলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছেন , সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মত অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না, মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগন্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দেবে যে বাঙালি এখনো মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না। ’’ পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, পাছে অশ্রু ধরা পড়ে সেই সংকোচে বারবার সংবরণের চেষ্টা করছিলাম। ৭১’এ মাকে লিখা এক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি।
এমন সব চিঠি দিয়ে গ্রথিত হয়েছে এই বইটি-“ একাত্তরের চিঠি’’। বইটি ঘণ্টা কয়েক আগে কর্মস্থলের বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপঢৌকন হিশেবে পাওয়া। ঘরমুখো হওয়ার সময় পড়ছি। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ি যেন খুব দ্রুত যাচ্ছে আজ।
গাড়ির কাঁচ দিয়ে সুস্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। সব কিছু কেন যেন আজ মাত্রারিক্ত ঝাপসা হয়ে আসছে। এই পথের দু’ধারের ক্ষেত, জলাশয়, খাল, নদী, ঘর-বাড়ী, সংগ্রামী দুঃখী মানুষ ওদেরকে প্রতিনিয়তই দেখেছি আর কত কি ভেবেছি। ভেবেছি টেলেমেকাস হয়ে আসব একদিন ওদের দুয়ারে। আজ আর ওদের ভাল দেখতে পেলাম না।
সপ্তাহান্তেই ছাড়তে হবে প্রিয় স্বদেশ । জীবনের প্রয়োজনে, সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে। বিদায়ের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যেন থেকে থেকে মন বাঁধা পড়ছে কতকিছুর সাথে। ক্ষণে ক্ষণে মন হুঁ হুঁ করে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়ে কেনা আমার প্রিয় বইগুলোতে আর নিয়মিত হাত পড়বে না, কবিতার খাতায় যোগ হবে না নুতন কবিতা, ঘরের কোনে পড়ে থাকবে কত প্রহর জড়ানো এই গিটার।
সপ্তাহ ঘুরে শ্রেফ ভালোবাসার টানে ছুটে যাওয়া হবে না বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের গাড়িতে। পারব না হতে হাজির চেরাগী পাহাড়ের মোড়ের সেই নিয়মিত আড্ডায়, যেখানে প্রাণ দিত রবীন্দ্রনাথ থেকে নেরুদা, অবনীন্দ্রনাথ থেকে প্রিয়তমার কাছে কান বাজি রেখে আত্মপ্রতিকৃতি আঁকা সেই ভ্যানগঁগ, মার্ক্স থেকে বঙ্গবন্ধু, সক্রেটিস থেকে আহমদ শরিফ। এমন সব ভাবনায় যেন এক লহমায় কাটেগেল কয়েকটি দিন,এল বিদায়ক্ষণ।
আজ আমার জন্মদিন। এমন দিনেই বিদায়।
আব্বার কোরান পাঠের ধ্বনিতে যেন ঘরময় নিশ্চলতা। চারিদিকের সবকিছু যেন তন্ময় হয়ে সেই সুরের সুধা পানে মগ্ম। মায়ের চন্দ্রাননে এত অশ্রু দেখিনি কখনো, দেখিনি প্রিয় বন্ধুর শিশুর মত এমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। এত সব মুখের কান্নার রোল জগদ্দলের মত ভারি করে তুলে মন। স্বপ্ন ও সময় এমন জগদ্দলকেও করে জঙ্গম।
সময়ের চেয়ে বড় ত্বারক আর কি হতে পারে?
সঙ্গে নিলাম আটপৌরে স্বপ্ন, বাহান্নর বর্ণমালা, স্বাধীন পরিচয়ের আত্মহংকার আর স্বদেশ প্রত্যাবতর্নের দৃঢ় প্রত্যয়। বিদায়ের দিন বারবার মনে পড়ছিল একাত্তরের চিঠিগুলোর ভাষা। কি দুরন্ত সাহস, সীমাহীন ভালবাসা আর চেতনা নিয়ে ওরা নিশ্চিত মৃত্যুর পথে দিয়েছিল পা! কত কত যুবক দিল অকুণ্ঠ প্রাণ। কতই বা হবে তাদের বয়স? মনে পড়ে মা বলত, বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার সেজো মামাকে মুক্তিবাহীনির প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কারন সে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল।
এইসব শিশু কিশোরগুলোর চেতনার কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। এত এত সোনার সন্তানের মাতৃভূমি আজ ক্ষত বিক্ষত, এবড়ো থেবড়ো শরীরের হৃতকমনীয়তা আমাদের যেন বিচলিত করে না,পীনস্তনী এই বাঙলা যেন আজ দুগ্ধশূন্য। আমরা কি তবে অযোগ্য, অক্ষম এক উত্তর প্রজন্ম? আমরা শুধু অভিযোগ আর অভিমানেই এড়িয়ে যাই সব। আমরা জানি আমরা পারি। শুধু দরকার একটা ক্ষণ, একটা চেতনা, একটা আঘাত, একটা ডাক-“জাগো বাহে কোনঠে সবাই”।
শৈশবে খুব ছোট একটা কাজে বড় একটা শিক্ষা দেয়া হতো। মাঠময় আবর্জনা পরিষ্কারের লক্ষ্যে সবাইকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে যার যার আশেপাশের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য নির্দেশ দেয়া হত, ফলাফল- মাত্র দু’তিন মিনিটেই বিশাল মাঠ সাফ।
দেখতে দেখতে কেটে গেল বিলেতের দু’ বছর। শত ব্যাস্ততার মাঝেও জন্ম নিয়েছে একটি নুতন কবিতার খাতা। ডেনভারের গান ছাপিয়ে আজ এমন বিরলে গিটারে ভাঙ্গা স্বরলিপিতে বেজে উঠে লোকগীতি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কফির কাপ হাতে জানলায় বসে দেখি হাজার হাজার ফুট উচুঁতে উড়ে যায় বিমান, আমি স্বপ্ন দেখি। পাঠ চুকিয়ে ফিরব আমি ভাটির দেশে, পদ্মা মেঘনা যমুনার দেশে, আমরা ফিরব পতাকা হাতে। স্বপ্ন ও অঙ্গীকার মরে নি, মলিন হয়নি এতটুকু। হয়তো পারবনা দিতে সিন্ধু সম ঢের পারব দিতে এক বিন্দু, বলব না কভু লিখে রেখো।
রউফুল আলম,
Sweden
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।