The only person u should try to be better than, is the person u were yesterday. স্কুল পালিয়েছন কখনো ? চুপি চুপি করে স্কুলের মূল ফটক বা পিছনের বাউন্ডারির দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ‘দূরু’, ‘দূরু’ বুকে ভো দৌড় দিয়েছেন কখনো ? যে দৌড় দেওয়ার সময় কখনোই মাথায় আসেনি ‘ধরা পরলে কি হবে’ বা ‘মাইর কি হাতে খাবো না বেত দিয়ে’... পালিয়েছেন কখনো স্কুল ?
আজকে আপনাদেরকে একটা গল্প বলি। গল্পটা হয়তো আপনাদের ভালো লাগবে না... তারপরও বলি... আমার স্কুল পালানোর গল্প ...
২০০৪ এর কথা হবে। আমি তখন পড়ি কুমিল্লা জিলা স্কুলের মর্নিং সিফটে। মর্নিং সিফটের সময় সূচি ছিল সকাল ৭ টা হতে ১২টা। আর টিফিন আওয়ার ছিল ১০ টা থেকে ১০টা ১৫ পর্যন্ত, যাকে বলা হয়ে থাকে স্কুল পালানোর সব থেকে উৎকৃষ্ট সময়।
আমার ধারণা সরকারকর্তিক যদি স্কুল পালানোর কোনো সময় সূচি নির্ধারণ করা হতো, তাহলে তা হতো ‘১০টা থেকে ১০টা ১৫’ এর মধ্যে। তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে সরকারও যেরকম কোনো সময়সূচী ঘোষণা করেনি, সেরকম আমাদের স্কুলও না। বরং আমাদের স্কুল থেকে ‘হুলিয়া’ জারি করা হয়েছিল ‘বিদ্রোহীদের’ উপর। আর তাই যখন এসকল ‘বিদ্রোহী’দেরকে কুমিল্লা শহরের চিপা-চুপা থেকে ধরে আনা হতো, তখন সারা স্কুলে মাইরের দামামা বাজতো। আর এসব বিদ্রোহীদের উপর চালানো বেত্রাঘাতও আমরা উপভোগ করতাম মনভরে... কত রকম, কত কায়দায় আর কত রকম ‘খিস্তি’ দিতে দিতে যে স্যারেরা যে এসব বিদ্রোহীদের ‘পিডাইতো’ তা শুধু ওরাই জানবে যারা কুমিল্লা জিলা স্কুলে একদিনের জন্য হলেও ক্লাস করে থাকবে।
আর মাইর খাওয়ার সময় বিদ্রোহীদের অঙ্গভঙ্গিও করতো দেখার মতো। আপনাকে উদাহরণসহ বললে হয়তো সহজে বুঝতে পারবেন। ‘মাইকেল জ্যাকসনের’ নাচ দেখেছেন কখনো ? যদি দেখে থাকেন তাহলে শুনে রাখুন চৌধুরি সাহেব, সেই নাচ কেবল মাত্র আপনিই দেখননি... আমরাও দেখতাম প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস করার সময়। মিউজিক ছাড়া বিদ্রোহীদের ওঃ সে কি নাচ... তবে মিউজিক না থাকলেও ‘বিদ্রোহীরা’ র্যাপ করতে করতে নাচতো বেশীরভাগ সময়...
“স্যার... ছ্যার... স্যার... ভু...ল হয়া গেছে স্যার...
মাফ কইরা দেন... ছ্যা...র... ছ্যার স্যার, স্যার... স্যার...
আর করমু না স্যার, স্যার... ছ্যার... ছ্যার...”
আর এসব র্যাপারদের কে ফিচারিং করতো আমাদের স্যাররা... খিস্তি দিতে দিতে... কি সব খিস্তি দিতো তার যদি ১০% আমি লিখি, আমি নিশ্চিত আমাকে সামু থেকে ব্লক করা হবে চিরেদিনের জন্য। তারপরও বলছি, ধরুন একজন বিদ্রোহীকে ধরে আনা হয়েছে পেটলা শাহজাহানের সামনে।
(পেটলা শাহজাহান হচ্ছে আমাদের স্কুলের নামকরা বদরাগী স্যারদের মধ্যে অন্যতম। স্যার যদিও ছিল ছোট খাটো সাইজের, কিন্তু তার পেটটা ছিল ডাবল জমজ বাচ্চা প্রসব করা প্রেগনেন্ট রোগিদের মতো, আর স্যার পেন্টটা পরতো ঠিক তলপেটের একেবারে নিচের দিকে, যেখানে গিয়ে... থাক আর বললাম না, আশা করি বুদ্ধিমান পাঠক বুঝতে পেরেছেন। যাইহোক পেটলা শাহজাহান ছিল জিলা স্কুলের অন্যতম আতংক। স্কুল ছুটি হওয়ার পরও পোলা-পাইন ভয়ে থাকতো, কখন না আবার ‘পেটলার’ সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। কথিত আছে কুমিল্লা শহরের জিলা স্কুলে পড়ুয়া ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ স্রেণীর ছাত্ররা যদি নাকি রাতের বেলা না ঘুমাতো যেত, তাহলে তাদের মা তাদেরকে বলতো, “শুয়ে পর লক্ষ্মী সোনা বাবু, না হয়তো পেটলা শাহজাহান খেয়ে ফেলবে তোমাকে” এর পর বাচ্চারা আর দেরী করতো না।
ছু ছু করে এসেই শুয়ে পরতো লক্ষী সোনা বাবুদের মতো। ) পেটলা শাহজাহান চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই বাম হাতে ভিকটিম এর কলার চেপে ধরে প্রথমে ৪-৫ টা ঝাকি দিতো। ঝাকি আবার লম্বা লম্বি ভাবে দিতো না, দিত ডানে বামে করে, অনেকটা পেন্ডুলামের মতো লাগতো তখন ভিকটিম কে। ঝাকি দিতে দিতে খুব শান্ত ভাবে বলত,
“এই তোর ‘ফাদারের’ নাম বল?”
ভিকটিম তার ফাদারের নাম কাঁপা কাঁপা গলায় বলতো ঝাকি খেতে খেতে...
“আরে ফোকিরন্নির পোলা, তুই তোর এই ফাদারের নাম বল” – পেটলা শাহজাহান এই কথা বলতো নিজের দিকে ডান হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে। এরপর পরই শুরু হতো ফুটবল খেলা।
পেটলা শাহজাহান এতক্ষণ ধরে ওয়ার্ম আপ করার পর ভিকটম নিয়ে শুরু করতো তার ফ্রী হ্যান্ড ফুটবল খেলা, যেই খেলার রেফারির নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’, কোচের নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’, টিমের নাম হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’ এমন কি একমাত্র প্লেয়ার এর নামও হচ্ছে ‘পেটলা শাহজাহান’। আপনি হয়তো এখন জিজ্ঞাসা করতে পারেন,
‘আপনি না বললেন ভিকটিম এর সাথে খেলা শুরু করার কথা !! তাহলে প্লেয়ার একজন কেন, প্লেয়ারতো দুজন হউয়ার কথা!! তাই নয় কি ?’
জ্বী, তাই। তবে এক্ষেত্রে ভিকটিম প্লেয়ার হিসেবে নয় বরং তার অবতার হয় ‘ফুটবল’ হিসেবে। শাহজাহান স্যার খিস্তি দিতে দিতে কখনো তাকে দেয়ালের সাথে বারি মারে, কখনো তাকে লাথি মারে, কখনো তাকে নিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ খেলে। আর বলে, ‘তুই নাকি তোর বাপের জাইঙ্গা পইড়া স্কুল পালাইছোস ?’ ‘কথা বল হা______, কথা বল চো_______, কথা বল... কথা বল...’
এভাবে মাইর ফিচারিং খিস্তি চলতেই থাকতো, যতক্ষণ না স্যার এর ইচ্ছা করে থামার...
এতসব মাইর দেখা ও খাওয়ার পর ও আমরা পালাতাম।
স্কুল পালানোটা ছিল আমাদের কাছে নেশার মতো। যে নেশাকে পেটলার মাইর ও দমতা পারেনি... স্কুল পালানো সেই সময়ে ছিল জিলা স্কুলের ট্রেন্ড। সবাই পালায়, এমনকি আমাদের ক্লাস কেপ্টেনও। পালানোর কোনো নির্দিষ্ট সময় সূচি ছিলো না। যে যার মতো সুযোগ পেলেই পালাচ্ছে।
কেউ পালাচ্ছে ২য় পিরিউডে, কেউ পালাচ্ছে ৫ম পিরিউডে, কেউ টিফিন পিরিউডে, আর কেউ কেউ একেবারে ৭ম পিরিয়ডে এসে! তাই পিরিয়ড এখানে মূখ্য বিষয় না, পালানোটাই হচ্ছে মূখ্য বিষয়।
আমি পুরো স্কুল জীবনে হাতে গোনা ১৪ কি ১৫ দিন পালিয়েছি। এই ১৫ দিনের ১০ দিনই হয়তো টিফিন পিরিউডের পর পালিয়েছি। ও সে কি অভিজ্ঞতা .... স্কুল পালানোর মূহুর্তটার অভিজ্ঞতা বা তৃপ্তি বলে বোঝানো অসম্ভব। যারা কখনো স্কুল পালান নি তারা তার স্বাদ কখনোই বুঝার চেষ্টা করলেও কখনোই বুঝতে পারবেন না।
যদিও স্কুল পালানোর পর তেমন কিছুই করার থাকতো না। করার কিছু থাকতো না, কারণ আমার রাস্তার পাশের ভিডিও গেমসর প্রতি আসক্ত ছিলাম না, ক্রিকেট-ফুটবল কিছুই খেলতে পারতাম না... শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম... তারপরও ওই সময়গুলো ছিলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো।
১৯৯০ - ২০০৭ সাল পর্যন্ত ছিল মিসেস সাবিনা গণির অর্থাৎ আমার মায়ের ছিল 'কড়া শাসনামল'। আমার মা আমার পড়াশোনা নিয়ে কখনোই ডাক দেইনি, কিন্তু কখনো বাহিরের জগতের সাথে মিশতেও দেইনি। স্কুল আর একটা প্রাইভেট পড়া ছাড়া আমার একটা মিনিটও বাহিরে থাকার অনুমতি ছিলো না, এমনকি ঈদের দিনও না।
সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে আমি চার দেয়ালের মাঝে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তাই সম্পদ যে দিন আমাকে নিয়ে প্রথম স্কুল পালালো, সেদিন ছিল আমার জীবনের একটি স্বরণীয় দিন। কুমিল্লা শহরের ঈদগাহ, পার্ক, ধর্মসাগরের পাড়, অজানা রাস্তার অলিগলিতে দুইজন উদ্যেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরতে লাগলাম টোকাইদের মতো। যা যা দেখছিলাম, তার সবকিছুই মনে হচ্ছিল চক চকে নতুন টাকার মতো নতুন। যেই নোট খরচ করার বদলে পকেট থেকে একটু পর পর বের করে হাত নেওয়ার মতো মনে হচ্ছিল।
সময় যে কখন চলে যেত, টেরই পেতাম না...ছোট মামার দেওয়া ডায়ালের কালার চেঞ্জ হওয়া ঘড়িতে একসময় আবিষ্কার করতাম, বাসায় ফিরে যাবার সময় হয়েছে। প্রথমবার পালানোর দিন বাসায় ফিরে আসার পর প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিলাম, আমি বাসায় চার দেয়ালের মাঝে বন্দী। এর বাহিরেও একটি পৃথিবী আছে...
এরপর দিন থেকে সম্পদকে আর বলা লাগেনি পালানোর কথা। নিজ উৎসাহে দিতাম ভো দৌড় ...ভিডিও গেমস, ক্রিকেট, বা কোন খেলার উদ্যেশ্য নিয়ে নয়... এক টুকরো হারানো শৈশব ফিরে পাবার উদ্দেশ্য নিয়ে পালাতাম স্কুল।
কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একদিন ধূলোয় মিশে গেল, যেদিন ধরা খেলাম একেবারেই হাতে নাতে।
কিন্তু সেদিন আমার ধরা খাওয়ার এতটুকুও সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ তারপর দিন থেকেই স্কুল বন্ধ ছিল ১ মাসের জন্য। সেদিন সকালে স্কুলের মূল ফটকে ঢুকার আগেই সম্পদের সাথে দেখা হয়ে যায়। দুইজনই সিদ্ধান্ত নেই, আজ একটি ক্লাসও করবো না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেই জায়গায় আরো একজন সেখানে উপস্থিত ছিল।
আর সেই ছেলেটির নাম 'শাহ্ ইমরান রানা '। যাকে তার কিছুদিন আগেই আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। ভয়ে ভয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমার বাসায় আমার কোনো বন্ধুদের আসা নিষিদ্ধ ছিলো। কেন নিষিদ্ধ ছিলো আমি জানি না, শুধু জানি নিষিদ্ধ ছিলো। তারপরও আমি রানাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের বাসায়।
আর সেই নিয়ে যাওয়াই আমার জন্য কাল হয়েছিল। না... আমার মা তাকে কিছুই বলেনি, বরং আদর করে বিস্কিট খাওয়েই ছিল। সেই বিস্কুট খাওয়ানোটাই আমার জন্য কাল হয়েছিল। না.... আমার মা রানা যাওয়ার পরেও আমাকে কিছুই বলেনি। বরং বলেছিল, 'ছেলেটা তো ভিষণ ভদ্র '।
আর সেই 'ভদ্র ' ছেলেটাই আমার জন্য কাল হয়েছিল।
শেষ যেদিন সাহস করে প্রথমবারের মতো, প্রথম পিরিয়ডের আগে স্কুল পালালাম ... সেদিনও আমি ভেবেছিলাম আমি 'স্বাধীন '। কিন্তু সেই ধারনা মাথার ভিতরে ধারনা অবস্থাতেই থাকলো যখন আমার দেখা ১২ টার দিকে 'জহির ' স্যারের সাথে হলো। স্যার দেখা মাত্র টক টকে লাল দুটি চোখ নিয়ে আমাকে বললো
"কিতারে, তুই রূপালীতে ছবি নি দেইখ্যা আইলি? আর এহানে তোর মা এ পুরাডা স্কুল এক কইরা লাইছে। হেই বেডিয়ে মনে করছে তোরে কিডন্যাপারে নি নিয়া গেল।
তাড়াতাড়ি বাসাত যা... "
আমি নিশ্চিত, আমি তখন ফটিকের মতো ফ্যাল ফ্যাল চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার হার্টবিট তখন মাপলে হয়তো ডাক্তারেরও হার্ট এট্যাক হয়ে যেতো। একবার ভাবতেছিলাম, মায়ের হাতে পরার চাইতে ভাইজ্ঞা অন্য কোথাও চলে যাই... চট্টগ্রামের দিকে কোনো এক গ্রামে, শুনছি সেখানে নাকি ভাড়ায় মাল-পত্র বোঝাইয়ের জন্য ভাড়াটে কামলা নেওয়া হয়। মায়ের হাতে পরার চাইতে কামলাগিরি করা বহুত ভালো। আবার স্কুল খোলার পর ধরবে পেটলা শাহজাহান...
আমি সেদিন প্রথমবারের মতো আরেকটা প্রতিভা আমার ভিতরে আবিষ্কার করলাম... আর তা হচ্ছে ...'অভিনয় '...।
আমি রিকশায় বসে প্রথমে আমার নিজের শার্টের তিন চারটে বোতাম ছিড়লাম। তারপর রিকশা থামিয়ে হাতে বালু নিয়ে প্যান্টে শার্টে ঘসাঘসি করে দাগ ফেলানোর চেষ্টা করলাম। তারপর আমার প্রিয় ছোট মামার দেওয়া হাত ঘড়িটা রিকশাওয়ালা কে দিয়ে দিলাম। মায়ের মাইরের ভয়ে স্যারের এমনি এমনি কওয়া 'কিডন্যাপের ' কাহিনীডা আমার পছন্দ হয়েছিল বেশ। তাই তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ...
আমি বাসায় এসে কারও কাছেই মার খাইনি, বরং আমার বাবা মাইনুদ্দিন ব্যাকারির একটা বার্গার না কি যেন এনে ছিলো তা খেয়েছিলাম।
'মাইনুদ্দিন ব্যাকারির 'কথা লিখতে একটা জিনিস মনে পড়লো (মাইনুদ্দিন বেকারী শাহ ইমরান রানাদের ছিলো)... সেদিন স্কুল পালানোর ঘটনা 'শাহ ইমরান রানাই ' স্যার কে রিপোর্ট করেছিল এবং স্বউৎশাহে স্যারকে বলেছিল যে, সে আমাদের বাসা চিনে ... এবং আমাদের বাসায় এসে কমপ্লেইন করতেও তার কোনো আপত্তি নেই ...
এরপর আর পালাইনি স্কুল... বন্দী হয়েই ছিলাম অনেকদিন পর্যন্ত... সেই চার দেয়ালের জাঁতাকলে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।