আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোরিয়ায় বাংলাদেশী ছাত্রের অসামান্য অর্জন।

বিকে অ্যাওয়ার্ড মানে হচ্ছে ব্রেইন অব কোরিয়া অ্যাওয়ার্ড। যদি এই অ্যাওয়ার্ড কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পান, তাহলে একটু অবাক তো হতেই হয়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ছেলেটার মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিল যে একদিন এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে, যেন পুরো পৃথিবীর মানুষের উপকার হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নামটাও যেন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সেই স্বপ্নটা সত্যি করার এক সুযোগ খুঁজছিলেন এনামুল হক। রাজশাহী ক্যাডেট থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে ভর্তি হন এনামুল হক।

অনার্সে প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রথম বিভাগ পেলেও প্রথম হতে পারেননি। তখনই সিদ্ধান্ত নেন দেশের বাইরেই মাস্টার্স করবেন। কাকতালীয়ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ানপুক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স এবং গবেষণা করার সুযোগ মিলে যায়।

সঙ্গে মিলে যায় আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ। বিষয় বেছে নেন ‘ন্যানো পোরাস ম্যাটেরিয়াল’। সহজ ভাষায়, অতি ক্ষুদ্র কিছু রাসায়নিক বস্তু নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। কিয়ানপুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রিন কেমিস্ট্রি’ মানে ‘সবুজ রসায়ন’ বিভাগে শুরু হয় তাঁর স্বপ্নপূরণের নতুন অধ্যায়। শুরু হলো অধ্যবসায়।

নতুন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল এনামুলকে। মাঝেমধ্যেই দেশ থেকে তাঁর বন্ধু ও প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে টেলিফোনে সাহস দেন, ‘তুমি পারবে, চেষ্টা করো। ’ এনামুলের মা ছেলেকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ধৈর্য ধরো, ভালোভাবে লেখাপড়া করো। ’ চেষ্টা চালাতে থাকলেন এনামুল। অবশেষে একদিন সফল হলো তাঁর প্রচেষ্টা।

ছাপা হলো তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র জার্মানির কেমিস্ট্রি: অ্যা ইউরোপিয়ান জার্নাল-এ। বিষয়টি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। পানি পরিশোধনের পর অনেক ক্ষতিকারক পদার্থ প্রক্রিয়াজাতের পরও রয়ে যায়। যেমন—রং, জৈবযৌগ, ফেনল ইত্যাদি। ন্যানো পোরাস ম্যাটেরিয়ালসের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ যেমন: কার্বন ডাই-অক্সাইড, পানি বিশুদ্ধকরণ ইত্যাদি কাজে লাগতে হলে ন্যানো ম্যাটেরিয়ালকে খুবই বিশুদ্ধ হতে হয়।

অনেক দিন ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন, কীভাবে অতি অল্প সময়ে পিওর ম্যাটেরিয়ালস পাওয়া যাবে। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী জি ফেরি প্রথম বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা তিন দিনে সম্পূর্ণ হতো। আর আমাদের বাংলাদেশি এই তরুণ এনামুল নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায়ই তা সম্ভব। তাঁর এই সফলতার কারণে কোরিয়ান সরকার তাঁকে ‘ব্রেইন অব কোরিয়া’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এরপর তাঁর গবেষণায় মনোযোগ আরও বেড়ে যায়।

তিনি মফ-২৩৫ নামের একটি ম্যাটেরিয়াল তৈরি করেন, যা মাত্র ২০ মিনিটে পানির সব ক্ষতিকারক রং দূরীভূত করতে পারে। তাঁর এই গবেষণাপত্র ছাপা হয় নেদারল্যান্ডের জার্নাল অব হেয়ারডাস ম্যাটেরিয়ালস-এ। একে একে তিনি আরও আবিষ্কার করেন: ১. কীভাবে পানির ভেতরের ক্ষতিকারক জৈবযৌগ দূরীভূত করা যায় তেমন একটি যৌগ এমসিএন-১। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় লন্ডনের জার্নাল অব ম্যাটেরিয়াল কেমিস্ট্রিতে। ২. আলট্রাসনিক রশ্মির মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে কীভাবে ন্যানো ম্যাটেরিয়াল তৈরি করতে হয়।

যেমন: এমআইএল-৫৩, যা ক্ষতিকারক হাইড্রোজেন সালফাইড দূরীভূত করে এবং লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরিতে কাজে লাগে। এটি প্রকাশিত হয় জার্মানির কেমিস্ট্রি অব ইউরোপিয়ান জার্নাল-এ। ৩. মাইক্রোওয়েভ ও আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ন্যানো ম্যাটেরিয়াল ‘কিউপ্রাস অক্সাইড’ তৈরিতে কাজে লাগে, যা কিনা সেন্সর তৈরিতে ও সোলার সেল তৈরিতে কাজে লাগে। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয় লন্ডনের জার্নাল ক্রিস্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং কমিউনিকেশন-এ। এ ছাড়া তাঁর আরও কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব জার্নালে।

কোরিয়ায় তাঁর একাডেমিক ফলাফলও ছিল ঈর্ষণীয়। এনামুল কিয়ানপুক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৬ দশমিক ৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এই ফলাফল কোরিয়ায় যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম সেরা ফলাফল হিসেবে বিবেচিত। এ জন্য কোরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার বিকে অ্যাওয়ার্ড (ব্রেইন অব কোরিয়া) লাভ করেন এনামুল। প্রতিবছর এই পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতি বিভাগের একজন সেরা শিক্ষার্থীকে।

এ পর্যন্ত পুরস্কারটি পিএইচডি গবেষকেরাই পেয়ে আসছিলেন। এনামুল ব্যতিক্রম। পিএইচডি গবেষকদের পেছনে ফেলে তাঁর গবেষণাপত্রটিই সেরা মনোনীত হয়। এনামুলের মোট গবেষণাপত্র এখন ১০টি। মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের এতগুলো গবেষণাপত্র খুব একটা দেখা যায় না।

এনামুলের ১০টি গবেষণাপত্রের মোট ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর এখন ৪৩ দশমিক ৩৮। জার্মানির বিখ্যাত বিজ্ঞান সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় জার্মান সরকার। ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটে তিনি তাঁর গবেষণাপত্র তুলে ধরেন। এখানকার শিক্ষকেরা তাঁকে তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে অভিহিত করেন ও সম্মাননা দেন। এরই ধারাবাকিতায় এনামুলের সামনে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ আসতে থাকে একের পর এক।

পিএইচডির জন্য বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসে সুযোগ হয় তাঁর। সার্বিক সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে এনামুল বেছে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব সিডনিতে পিএইচডি করার সুযোগ। শতভাগ বৃত্তি নিয়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তিনি সিডনিতে যাচ্ছেন কেমিক্যাল বায়োমোলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করতে। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি তাঁর গবেষণাকে আরও উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চান। বাংলাদেশকে পৌঁছে দিতে চান বিশ্বের দরবারে নতুন ঠিকানায়।

তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.