------ ( মানুষ বুড়ো হয়ে গেলেও জীবন স্মৃতির পাতা গুলো রয়ে যায় চির সবুজ। "আমার পাঠাগার" লেখাটি আমার বাবার লেখা স্মৃতিকথা থেকে। -হাসান ইকবাল)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
“আমার পাঠাগার”
-হামিদুর রহমান
“জ্ঞানই পূন্য অজ্ঞানতাই পাপ। ”
-সক্রেটিস।
“জ্ঞান সাধকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।
”
-রাসুলুল্লাহ (সা
হযরত হাছান বসরী (রহ বলেছেন শহীদের রক্তের বিনিময়ে আলেমদের কালি ওজন করা হবে। তখন দেখা যাবে যে, আলেমদের কালির শহীদের রক্তের চেয়েও ভারী। ”
-এইয়া-উল্-উলুম।
-ইবনে আব্বাছ বলেন, রাতের কোন অংশে এলেমের চর্চা করা কালি নামাজের অবস্থান জাগরনের চেয়েও আমার কাছে অধিক প্রিয়।
-ইমাম গাযযালী (রহ)
রাসুল (সাঃ) বলেন , যে ইস্লামকে পুর্নজীবিত করার জন্য বিদ্বান্বেষন করে এবং এভাবে তাঁর বিদ্ধান ব্যক্তি এবং নবী গনের মধ্যে বেহেশত একটি ধাপের মাত্র পার্থক্য থাক্বে -
(দারেমী)
জ্ঞান-সাধনার জন্য এর একটি বানীই যথেষ্ট।
কিন্তু আমাদের জাতি এদিকে মোটেও ভ্রক্ষেপ করছে না। অর্থ বিত্তের পিছনেই শুধু ছুটে চলেছে। কে তাকে ফেরাবে আল্লা রাসূলের দিকে কে করবে এদের ত্রান?
হযরত আলীর (রাঃ) বানী শুনুনbr /> “ধবংসশীল পৃথিবী স্থায়িত্বের নেই অবসর,
নিশ্চয়ই বিশ্ব যেন স্বল্প-আয়ু মাকড়ের ঘর। ”
তবুও মানুষ এই ধবংশের বালুচরে অমরতার ইমারত গড়তে চায়। হায়রে মানুষ!
আমার পাঠাগার।
নাম “অন্বেষা পাঠাগার”। এর জন্মলগ্নের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে ছেলে - বেলায় এক সময় হযরত আলী (রাঃ) কে স্বপ্নে দেখা পেলাম। কেন জানি না, এর পর থেকেই জ্ঞান অন্বেষার প্রতি আমার দারুন আগ্রহ জন্মে। আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে অধ্যয়ন করি, তখন আব্দুস সাত্তার ফকির আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের মৌলভী শিক্ষকের সাথে কথা প্রসঙ্গে বলেন “শেষ বিচারের আগে ” বইটি পড়ে দেখবেন , “এমন বই আর পড়ি নাই” প্রতিটি কথাই হৃদয়ে গেঁথে যায়।
এর পর থেকেই ভবতে থাকি বইটি - কোথায় পাওয়া যায়!
কেন্দুয়া থানার অন্তর্গত কৈলাটি গ্রামের মকবুল হোসেন , আমার মামা ( সম্পর্কীয় আতœীয়) তিনি “ বিষাদ-সিন্ধু” বইটি আমাকে পড়তে দেন। বই পড়ার জন্য সর্ব প্রথম তিনি উৎসাহিত করেন। তাঁর কাছে যেকটি বই ছিল সব গুলো পড়তে দেন। তখন কি আর বুঝি। তবু আমার মানসলোকে এক অদম্য জ্ঞান পিপাসা জাগে।
১৯৬০ সনের প্রথম দিকে আমি বারহাট্টা সি,কে,পি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নের সময় মৌলবী আব্দুস সোবহানের “নবী-কাহিনী ” বইটি স্কুল লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করি। এর সাথে আর একটি বইও পেয়ে যাই , বরকতুল্লাহর “কারবালা”। বই দু’টি আমার কৈশোর মনে বিপুল আলোড়ন জাগায়। এর আবেদন মানব-লোকে বসে যায়। “নবী-কাহিনী” ও “শেষ বিচারের আগে ” বই দু’টি কিনে বই সংগ্রহ আরম্ভ করি।
এর পরে মৌলবী আলী হাসান ও মৌলবী আব্দুল হাকিমের কোরান শরীফের অনুবাদ ও তাফ্সীর সংগ্রহ করি। এর পরে “বোখারী শরীফ” ও মেশ্কাত শরীফ কেরামত আলী জৌনপুরীর “মেফ্তাহুল - জান্নাত” আমার হাতে এসে যায়।
বারহাট্টা হাই স্কুল থেকে সরে এসে , এক বছর পরে আটপাড়া সি.টি, উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্ত্তি হই। এখানে অধ্যয়নকালে প্রধান শিক্ষক মোসলেম উদ্দীন খাঁ তাঁর একটা কবিতার খাতা আমাকে দেন এবং আমাকে সাহিত্য বিষয়ে উৎসাহিত করেন। তিনি নিজে উদ্দ্যোগ নিয়ে “নজরুল ও রবীন্দ্র জয়ন্তীর আয়োজন করেন এবং বিভন্ন বিষয়-ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন।
এই সব প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে প্রায়ই আমি প্রথম স্থান অধিকার করতাম, এভাবে অনেক বই আমি উপহার হিসাবে পেতাম। এভাবে অনেক বই আমার সংগ্রহে এসে যায়। শিশুতোষ অনেক রচনাবলীও রয়েছে আমার সংগ্রহে। আমার মেয়ে একজন নিয়মিত পাঠক।
স্কুল জীবনের এ-পর্বেই নজরুল-জসীম, রবীন্দ্রনাথ সহ অনেক স্বনাম-ধন্য কবি ও কথা সাহিত্যিকের রচনার সাথে আমার পরিচয় ঘটে।
নিজে লিখার জন্য সাধনা চালাই। এই সময়ে আমি জনাব খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদিত “ উত্তর-আকাশে” নিয়মিত লেখা পাঠাতাম।
“মুকুল” -“কচি ও কাঁচা -” “সবুজ-পাতা” “সৃজনীতেত্ত” আমার লেখা ছাপা হতে থাকে।
একদিন জনাব চৌধুরী সাহেব “ উত্তর-আকাশের” কার্যালয়ে কবি নির্মলেন্দু গুনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন।
এর অনেক আগে থেকেই আমি পুস্কক সংগ্রহের দিকে ঝুকে পড়ি।
স্কুল-জীবনে সংগ্রহের মধ্যে জসীম উদ্দীনের কাব্য - উপন্যাস,ভ্রমনকাহিনী, জীবন-কথা মিলিয়ে ২৭ টির ও উপরে বই আমার সংগ্রহে আছে। নজরুল ইসলামের কাজ উপন্যাস, ছোট গল্প” কথা-সাহিত্য নজরুল -বিষয়ক আলোচনা সব মিলিয়ে ৩৫টির অধিক গ্রন্থ আমার সংগ্রহে আছে।
ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও ডাঃ লুৎফর রহমানের সব কটি বই আমার সংগ্রহে আছে।
গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ ইস্মাঈল হোসেন সিরাজী, বেগম রোকেয়া অধ্যক্ষ্য ইব্রাহীম খাঁ, বন্দে আলী মিয়া, ফররুক আহম্মদ, আবুল মনসুর আহমেদ, খালেকদাদ চৌধুরী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ, আবু ইস্হাক, লিও টলষ্টয়, পাল,এস,বাক, যাযাবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বকিম চন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মোশাররফ হোসেন, মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কবি রওশন ইয়াজদানী প্রমূখ অনেক সাহিত্য - মনীষীদের মূল্যবান রচনা সম্ভারে রক্ষিত এ পাঠাগার।
ইসলামী সাহিত্যের মধ্যে মহাত্মা ইমাম আলী গাযযালী (রহঃ)- র এহ্ইয়াউল উলুম সহ বিশটির ও অধিক গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে।
বোখারী শরীফ, মেশকাত শরীফ’ “রিয়াজুন সালেহীন” আব্দুল কাদের জ্বিলানীর রচনা সহ, শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভীর “হুজ্জাতুল্লাহ্ হিল বালিগ” হজরত আলীর (রাঃ) “নাহজুল বালেগা , সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভীর অনেক রচনা, মাওলানা মুহিউদ্দীন, মাওলানা আমিনুল ইসলাম ও আল্লামা শিবলী নোমানীর “সিরাতুন্নবী” মাওলানা আবুল কালাম আজাদের “ভারত স্বাধীন হল” ও তাঁর রচনাবলী , বিচার-পতি আব্দুল মওদুদের “মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাল ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর” ও আয্হাবে রাসূলদের জীবন কথা সহ আওলাদে রাসূলের উপর লিখিত প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে।
গহীণ অরণ্যে প্রস্ফুটিত পুষ্পের খবর কে রাখে ? দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অজ-পাড়া গায়ে - পুস্তক সংগ্রহ শালা?
কবি জসীম উদ্দিন দুঃখ করে বলে পেছেন, “আমি আজীবন চাষাভুষা, দুঃখী মানুষের জন্য সাহিত্য রচনা করে গেলাম কিন্তু তারা আমার এ লেখা পড়ে দেখলো না। ” এমনি ভাবে আমার সংগৃহীত পুস্তকও কেউ পড়ে দেখার মত পাঠক পাওয়া যাবে না। তবু সান্তনা এইযে, “দয়াময় আল্লাহ যদি আমার এ জ্ঞান-সাধনাকে গ্রহণ করে একটি মানুষও যদি এর দ্বারা উপকৃত হয় তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। ,
আমার এই অখ্যাত - অবজ্ঞাত সংগ্রহশালায় যে সমস্ত মুক্তমনা মানুষ পুস্তক দান করেছেন তাদের কথা না বললে তাদেরকে খাটো করা হবে।
তাই তাদের একটা তালিকা করে রেখেছি।
চরিত্র গঠনের একমাত্র পথ হলো মহৎ লোকদের জীবনী-বানী অধ্যয়ন করা, তাঁদের অনুসরণ করা। মহৎ লোকদের জীবন ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকাই জীবন্ত জাতির লক্ষণ।
মনীষী টমাস কারলাইলের মতে “আজকের দিনের সত্যিকারের বিশ^বিদ্যালয় হল বইকে সমষ্টিগত বা একত্রীভূত করা। ” গ্রন্থ শুধু পথ-নির্দেশের আলোক সংকেতই নয়, সময়ে উহা বারুদের চেয়েও বিস্ফোরক এবং সম্রাট বা সেনাপতির কীর্ত্তির চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী ।
”
অনেক জীবনী গ্রন্থ, অনেক ইতিকথা, অনেক সাহিত্য কীর্তি বহু ভগ্ন-হৃদয়ের করুন কান্না স্তব্ধ হয়ে আছে কত আশা আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়ে আছে প্রতিটি বইয়ের পাতায় পাতায়, বিদগ্ধ পাঠক ছাড়া এর খবর কেউ জানে না।
আমার বড় ছেলে হাসান ইকবাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় অনেক বই-সংগ্রহ করে ; এগুলোই এ সংগ্রহ শালায় রক্ষিত আছে। আমার পিতারও অনেক পুঁথি ছিল। এর কিছু চিহ্ন এখনও আছে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে বই সংগ্রহ করছি, বিগত মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় শেলফ্ না থাকার কারনে কিছু বই হারিয়ে গেছে।
তবুও আজ এ বৃদ্ধ বয়সে যক্ষের ধনের মত এই বইগুলো আলগে রেখেছি। বর্তমান পুস্তক সংখ্যা পাঁচ শতেরও অধিক রক্ষিত আছে। মাসিক পত্রিকা, “মাহে নও” সওগাত, “পূবালী” “মদীনা” অগ্রপথিক অনেক সংখ্যা রক্ষিত আছে। বর্তমানে যে সব বই আমার কাছে আছে তা পড়ে শেষ করার মত নয়।
তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।
প্রজ্ঞার আলোতে যেন আমার কবরকে আলোকিত করে দেন।
“আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়াছি পৃথিবীর শ্রেষ্টতম সম্পদ অন্বেষন, জ্ঞান-অর্জনের জন্য। ”
জ্ঞান সাধনা যদি পূন্যের কাজ হয়, তবে মহান আল্লাহর কাছে এর সুফল কামনা করি।
রচনাকালঃ
জানুয়ারী ২০১১ ইং
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।