চারতলা বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে হাতের ডানদিকে ছোট্ট একটা রুম।
চিলেকোঠা বলে যাকে। জানালা শুধু ডানদিকে একটা। বাতাস-আসা যাওয়ার মাধ্যম
ওটাই।
রুমটা প্রথমে খুব ছোট মনে হলেও জিনিসপত্র রাখার পর ততোটা ছোট লাগছে
না শফিকের কাছে। একটা সিঙ্গেল বেড, একটা টেবিল আর একটা চেয়ার রাখার পরও
বেশকিছু জায়গা ফাঁকা আছে। সেখানে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সাজিয়ে
রাখে সে। রুমটা পেয়ে সবদিকেই লাভ হয়েছে শফিকের। অফিস এখান থেকে কাছে।
যাতায়াত খরচটা কম হবে। আবার রুমটার ভাড়াও কম। বাসা পাওয়ার জন্য একসপ্তাহ
কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চায় না বাসাওয়ালারা। টু-লেটের
নিচে লিখে রাখে ‘ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া হয় না’।
যেখানে লেখা থাকে না
বাসাওয়ালার সাথে কথা বলে জানা যায় তারা ব্যাচেলর ছেলেদের ভাড়া দেবেন না।
ভাবখানা এমন যে ব্যাচেলররা তাদের মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্য মুখিয়ে আছে।
আর দিতে চাইলেও ভাড়া এতো বেশি যে বাড়িতে কিছু টাকা দেয়া তো দূরের কথা
বাবার কাছ থেকে ভর্তুকি নিতে হবে।
জিনিসপত্র খুব বেশি নয়। তবু অভ্যাস না থাকার কারণে গোছানোর পর কান্ত হয়ে
পড়ে শফিক।
ছোট-খাটো একটা সংসার বটে। নিজের দেখ-ভালের দায়িত্ব এখন নিজের
হাতে। বাড়ির কথা মনে পড়ে তার। মনকে সান্ত¦না দেয় নিজের মঙ্গলের জন্যই তার
নগর জীবনে পদার্পণ।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা বাসাওয়ালাই করবে।
এর জন্য মাসে পনের শত টাকা দিতে
হবে। বাইরে খাওয়ার চেয়ে অনেকটা সাশ্রয়ী। প্রথমদিন খাওয়া-দাওয়া সেড়ে দ্রুত
শুয়ে পড়ে শফিক। সকালে উঠেই আবার অফিসে রওয়ানা হতে হবে। সকালে ঘুম ভাঙ্গে
কাকের ডাকে।
অথচ বাড়িতে ঘুম ভাঙ্গতো মোরগের ডাকে বা পাশের গাছ-গাছালিতে
থাকা পাখির ডাকে। জানালা দিয়ে সূর্যের কড়া রশ্মির ছটা লাগে তার মুখে।
বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পায়ে দিতে গিয়ে দেখে একটা স্যান্ডেল নেই।
বিছানার তলায় উবু হয়ে দেখে ভিতরে আছে কিনা। শফিক অবাক হয় স্যান্ডেলটা
আবার গেলো কোথায়? এপাশ-ওপাশ খুঁজে ঘরের পশ্চিম কোণায় রাখা জুতো জোড়ার
পাশে স্যান্ডেলটা পাওয়া যায়।
ঘরে শফিক একা। যতোদূর খেয়াল পড়ে স্যান্ডেলটা
ঘুমানোর সময় বেডের কাছেই ছিলো। আর হালকা জিনিসও নয় যে বাতাসে উড়ে এতোদূরে
আসবে। তবু নিজের মনকে সান্ত¦না দেয়ার টেষ্টা করে সে। অতিপ্রাকৃতিক কোনো
বিষয়ের কথা ভেবে মনের মধ্যে ভয় সৃষ্টির কোনো মানে হয় না- ভাবে সে।
অফিসে
যাওয়ার পর কাজের মধ্যে থাকায় ঘটনাটার কথা একবারো মনে পড়ে না।
পরদিন সকালের ঘটনার পর শফিক মনটাকে আর শক্ত করতে পারে না। যে ভয়টা সে
মনের মধ্যে ঢুকাতে চায় নি সেটিই দানা বাধতে শুরু করে। সকালবেলা উঠে সে
দেখে আজও একটা স্যান্ডেল বেডের কাছে নেই। আজ জুতোর কাছে নয় স্যান্ডেলটাকে
পাওয়া যায় টেবিলের তলায়।
স্যান্ডেলটা টেবিলের নিচে এমন পজিশনে ছিলো যেনো
কেউ চেয়ারে বসে ছিলো। একসময় নিজের প্রতিই তার ভয় জাগে। ব্রেইনে কোনো
সমস্যা হলো না তো আবার। অ্যামনেসিয়ার কথা সে অনেক বইয়ে পড়েছে। পরক্ষণে
নিজেকে অসুস্থ ভাবার যৌক্তিকতা সে নিজেই খ-ন করে।
কারণ রাতের অন্যান্য
ঘটনাগুলো সব মনে আছে। শুধু যে স্যান্ডেলটা কোথায় রেখেছিলো এটা মনে থাকবে
না এমনটি তো হতে পারে না। ঘটনাটা কারো সাথে শেয়ার করা দরকার। অফিসের
কলিগের সাথে বা বাসাওয়ালার সাথে। তবে এজন্য আরো একদিন অপেক্ষা করবে বলে
সিদ্ধান্ত নেয় সে।
রাতে ঘুমানোর সময় একটা কাজ করে শফিক। একটা কাগজে লিখে রাখে ‘স্যান্ডেল
ঠিক জায়গাতেই রেখেছিলাম’। তারপর কাগজের টুকরাটা বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়।
কিন্তু সকালে উঠে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। নিজের মাথা ঠিক আছে কিন্তু
দ্বিতীয় কোনো সত্তার উপস্থিতি আছে বলে নিশ্চিত হয় সে।
সেটা হতে পারে
ভৌতিক বা অন্য কিছু। অন্য কিছুর কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে পড়ে ইঁদুরের কথা।
একটা ইঁদুরের পক্ষে একটা স্যান্ডেল বহন করা নিশ্চয় কঠিন কিছু নয়। ইঁদুরের
যুক্তিটা সে মনে আনে নিজের মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই। সে জানে ইঁদুরের
যুক্তিটা এখানে খাটে না।
স্যান্ডেলের প্রতি ইঁদুরের কোনো আকর্ষণ থাকার
কথা নয়। শুঁটকি হলে একটা কথা ছিলো। স্যান্ডেলটাও সে একবার শুঁকে দেখে
সেখানে কোনো শুঁটকির গন্ধ নেই বা এমন কোনো গন্ধ নেই যাতে ইঁদুর আকৃষ্ট
হতে পারে। শালার ইঁদুরের মৃগী রোগ আছে নাকি- বলে নিজের মনে হাসতে থাকে
সে।
অফিসে গিয়ে ঘটনাটার কথাই বারবার মনে পড়ে শফিকের।
কাজে আর মন বসে না।
কলিগের সাথে শেয়ার করার কথা ভাবলেও কাজটা বোকামি হবে ভেবে বলে না সে।
পাছে ভাবে মাথায় সমস্যা আছে। তারপর পুরো অফিস জেনে গেলে চাকরিটাও চলে
যাক। তবে একটা পয়েন্ট সে আবিষ্কার করে।
প্রতিদিনের ঘটনায় ডান পায়ের
স্যান্ডেলটা সরানো ছিলো।
রুমে ফিরে সারা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো ইঁদুরের অস্তিত্ব খুঁজে পায়
না শফিক। সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতটা জেগেই কাটাবে। ঘুমানোর ভান করে শুয়ে
থাকবে। তারপর বের করবে ঘটনার হোতাকে।
শফিক বেশ সাহসী বলেই নিজেকে দাবী
করে এবার তার একটা প্রমাণ হবে। রুমের বাইরের দিকে জানালার পাশের লাইটটা
জ্বালিয়ে রাখে। হাল্কা আলো হলেও ঘরটা দেখতে কোনো অসুবিধা হয় না। রাত
তিনটার দিকে শফিকের দু’চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। জোর করে চোখ দু’টো
খোলা রাখে সে।
ঠিক তখনই সে দেখতে পায় আশ্চর্য ঘটনাটা। তার ডান পায়ের
স্যান্ডেলটা একটু নড়েচড়ে উঠে। শফিক ঘুমানোর ভান করে শুয়েই ছিলো। কিন্তু
উত্তেজনায় সে বিছানা থেকে উঠে বসে। আশে পাশে কেউ নেই, কিছু নেই।
অথচ
স্যান্ডেলটা হাঁটতে শুরু করে মানুষের মতো। পা ফেলার স্টেপ নিয়ে ছন্দে
ছন্দে স্যান্ডেলটা একবার বাম দিকে যায় একবার ডানদিকে যায়। একবার শব্দ
করে করে উপরে উঠে আবার নিচে নামে। মনে হয় প্যারেড করছে। সাহসী শফিকের
বুকের ভিতরে কম্পন শুরু হয়।
অবচেতন মনে এতোক্ষণ চেয়ে থাকার কারণে তার মনে
ভয় ছিলো না। মন কনসাস হতেই এপিনেফ্রিন-নরএপিনেফ্রিনের কাজ শুরু হয়ে যায়।
হার্ট রেট বেড়ে যায় কয়েকগুন। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। বিছানাতেই ধপাস
করে পড়ে যায়।
সকালবেলা উঠেই গতরাতের কথা মনে পড়ে তার। স্যান্ডেলটা ঘরের ডানদিকের
এককোণে পড়ে আছে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয় ভাবে সে। বাসাওয়ালাকে জানানো
দরকার ঘটনাটা। কিন্তু বাসাওয়ালার সাথে চুক্তি হয়েছে তিনমাসের মধ্যে সে
বাসা ছাড়তে পারবে না।
দুই মাসের টাকা অগ্রিম নিয়েছে। বাসাওয়ালাকে ঘটনাটা
জানাতেই বলে- পাগল নাকি আপনি? কী বলেন এসব? কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না
বাসাওয়ালা শরফুদ্দিন। শফিকের অবস্থা কাঁদো কাঁদো। সে শরফুদ্দিনকে অনুরোধ
করে কোনো রহস্য তার জানা আছে কিনা। শরফুদ্দিন অস্বীকার করলেও তার মুখ
দেখে মনে হয় কিছু একটা লুকাচ্ছে।
শফিককে জানিয়ে দেয় তিন মাসের আগে বাসা
ছাড়া যাবে না। আর ছাড়লে বাকি একমাসের টাকা দিয়ে যেতে হবে। এটাই তার সাফ
কথা। গত্যন্তর না দেখে শফিক শরণাপন্ন হয় বাড়ির দাড়োয়ানের। দাড়োয়ানকে
একপাশে ডেকে নিয়ে ঘটনাটা বলে সে।
শফিকের ধারণা বাড়ি নিয়ে কোনো রহস্য
থাকলে তা দাড়োয়ানের অজানা থাকার কথা নয়। দাড়োয়ানের ভঙ্গি দেখে শফিকের মনে
হয় শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না। পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে
হাতে গুঁজে দিতেই বলে- করেন কি শফিক ভাই করেন কি? এই বলে টাকাটা শার্টের
পকেটে রেখে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে কেউ দেখে ফেললো কিনা। ঘুষ খাওয়া যেনো
হালাল, যদি না পড়ে ধরা। তারপর গদগদ করে সব কথাই বলে শফিককে।
আরো
বিস্তারিত জানার জন্য পাশের কাবটা দেখিয়ে দেয়। কাবের ছেলেরা নাকি আরো
ভালো জানে।
শফিক যা জানতে পারে তার মূল কথা হলো- ঐ রুমে মিলন নামের এক ছেলে থাকতো।
একটা অফিসে কেরাণীর চাকরি করতো। ছেলেটার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব
খারাপ ছিলো।
ছেলেটার ইনকামের টাকায় চলতো পুরো পরিবার। একদিন মধ্যরাতে
দেশের একটি বিশেষ বাহিনী এলো। তারা নাকি খবর পেয়েছে এ বাসার চিলেকোঠায়
একজন সন্ত্রাসী থাকে। রুমে ঢুকেই তারা ঘুমন্ত ছেলেটির ডানপায়ে গুলি করলো।
কিন্তু ছেলেটি ছিলো সম্পূর্ণ নিরপরাধ।
তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো।
ডাক্তার জানালো তার ডান পা-টা কেটে ফেলতে হবে। তারপর কেটে ফেলা হলো তার
পা। দেশের বিশেষ বাহিনীটি এরপর তৎপর হলো ছেলেটিকে কীভাবে সন্ত্রাসী
বানানো যায়।
শফিকের মুখে স্যান্ডেলের কাহিনী শুনে দাড়োয়ান খুব ভীত হয়ে পড়লো।
সিদ্ধান্ত নিলো এখানে আর চাকরি করবে না। এবাড়িতে ভূত আছে। শফিক তাকে
আশ্বস্ত করলো মানুষটাতে মারা যায় নি। একটা পা তার কী ক্ষতি করবে? আর
ছেলেটা তো নির্দোষ ছিলো। তার পাও তেমনি নির্দোষ।
কারো ক্ষতি করবে না।
দাড়োয়ান যেনো বুকে বল পেলো। অকথ্য ভাষায় গালিও ছুঁড়লো বিশেষ বাহিনীটিকে
উদ্দেশ্য করে।
পেপারে নাকি এসব ঘটনা নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। কিছুদিন থেকে বাসা খোঁজার
ব্যস্ততায় পেপার পড়ার সময়ই পায় নি শফিক।
আর এ কয়েকদিনে স্যান্ডেল রহস্য
নিয়েই ছিলো তার যতো চিন্তা-ভাবনা। পাশের যুব সংগঠনে শফিক নিজের পরিচয়
দিয়ে আরো বিস্তারিত শুনলো। শফিক বললো, আমি হাসপাতালে গিয়ে মিলনের সাথে
দেখা করবো। একটা ছেলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, সাংবাদিকদের যাইতে
দিতেছে না আর আপনারে দেবে? শফিক এবার আরো আশ্চার্যান্বিত হয়। ছেলেটাকে
দেখতেও যাওয়া যাবে না? শফিকের মনে হয় ছেলেটার কাছে মাফ চাইলে হয়তো
ছেলেটার পায়ের আত্মা তাকে মুক্তি দেবে।
কিন্তু সে পথটাও খোলা থাকলো না।
শফিক অফিসে ফোন করে জানালো সে একটা বিপদে পড়েছে তাই আজ যেতে পারবে না।
একটা পেপার কিনে সে খুঁজতে থাকলো কাঙ্ক্ষিত খবরটি। প্রথম পৃষ্ঠায় এই ঘটনা
সংক্রান্ত একটা খবর ছাপানো হয়েছে। পেপারে লিখেছে- মিলনের সাথে এ অঞ্চলের
কুখ্যাত সন্ত্রাসী খোঁড়া হালিমের যোগসাজোশ আছে বলে জানিয়েছে বিশেষ
বাহিনী।
অথচ এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে মিলন সম্পূর্ণ
নিরপরাধ। শফিকের বাম পা-টা শির শির করে ওঠে। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে
দু’টো স্যান্ডেলের হাওয়ায় হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।