তোমাদের পাগল বন্ধু ভারী চশমা পরতে পরতে নাকের দু’পাশে প্রায় গর্তের মত হয়ে গেছে। বছরে বছরে চশমার পাওয়ার আর লেন্সের ওজন কিভাবে এত বেড়ে গেল ভেবে পাই না। চশমাটা খুলে নাকের দু’পাশের গাঢ় দাগ দুটোয় আঙ্গুল দিয়ে ডললাম আপন মনেই। অনেক্ষণ হল দীঘির সিঁড়িতে এসে বসে আছি। রাহেলা আমাকে বসিয়ে রেখে যে গেছে- আসার আর নাম নেই।
অনেক্ষণ হল একা একা নির্জন পার্কের দীঘিটার পাড়ে বসে আছি। কোনো মানুষের সাড়া শব্দ নেই। বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। আকাশে মেঘ গুড় গুড় করছে। আকাশের দিকে তাকালাম।
মাথার ওপরে ঝুলে আছে বিরাট একটা আম গাছের ঝোপের মত ডাল। সেটা ভেদ করেই হঠাৎ বড় একটা পানির ফোঁটা এসে পড়ল আমার মুখে।
আজ আমার দীর্ঘ পঁচিশ বছরের চাকরী জীবনের শেষ দিনটা গেল। অবসরের স্বাদটা এখনো বুঝতে পারছি না। ঘোরের মধ্যে ছিলাম পুরো ফেয়ার ওয়েল অনুষ্ঠানে।
সারা অনুষ্ঠানে জবুথবু হয়ে বসে ছিলাম, চোখ ছিল রাহেলার দিকে। এত বছরেও খুব একটা বদলায়নি, কেবল চুলে কয়েক গোছা পাঁক ধরেছে। পঁচিশ বছরের সংসারের মত পঁচিশ বছরের সহকর্মী জীবনও কাটিয়েছি রাহেলার সঙ্গে। আজ হঠাৎ অবসরের ডাক আমার আগে চলে আসায় বিচিত্র একটা শূণ্যতা বুকের ভেতর ছোটাছুটি শুরু করেছে! এতটা বছর দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা ওকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম। সকালে অফিসে যেতাম একসাথে, যাওয়ার পথে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসতাম।
একসাথেই দুপুরে অফিস থেকে ফিরতাম। ফেরার পথে হয়ত বাচ্চাদের জন্য আইসক্রীম কিনে নিতাম দুজনে। সপ্তাহের শুক্রবারে একসাথে সকাল বেলা আদালত বসাতাম বাসায় সারা সপ্তাহে আমাদের ছেলে মেয়ের করা করা নানান দুষ্টুমীর শাস্তি দেয়ার জন্য। আমি জজ- সে সরকারী উকিল সেই সংসারের আদালতে! বাচ্চাদের বিচার কার্য ও শাস্তি প্রদানের পর পরটা আর শিক কাবাব নিয়ে বসে পরতাম সবাই। বাচ্চারা চোখের পানি মুছতে মুছতে খাওয়া শুরু করত।
আমরা মিটমিট করে হাসতাম কেবল।
আজ আমার চব্বিশ ঘন্টার সংসার জীবন থেকে আট ঘন্টার অব্যহতি দেয়া হল। এখন আর চাইলেই রাহেলাকে অফিসে বসে আড় চোখে, কিম্বা লুকিয়ে দেখতে পারব না। মনটা কেমন যেন বিষণ্ব হয়ে আছে তাই। ভারী একটা পাথর চেপে বসেছে বুকের ওপর।
চারপাশে তাকালাম। চাকরী যখন করতাম, মাঝে মাঝে দুজনে বাসায় ফেরার সময় হাটতে হাটতে এখানে চলে আসতাম। দূঘির পাড়ে বসে আইসক্রীম খেতে খেতে রাহেলা নানান কথা বলত। রাহেলা আইসক্রীম খেতে ভালবাসে- কিন্তু বাচ্চাদের সামনে কখনো খেত না তেমন। বাচ্চারা আইসক্রীম বেশি খেয়ে ঠান্ডা লাগাবে এই ভয়ে।
এখানে এসে একা একা আমার সঙ্গে খেত। প্রায়ই বৃষ্টি এসে তার আইসক্রীম খাওয়ায় বাঁধ সাধত। কিন্তু মাথায় আঁচল টেনে দিয়ে খেত ও। আমি বসে বসে ওর খাওয়া দেখতাম আর হাসতাম।
রাহেলা বিরক্ত মুখে বলত, “হাসছো কেন?”
“নাহ, এমনি।
তোমার আইসক্রীমের প্রতি ভালবাসা দেখে হাসছি। ”
“ধুর! আইসক্রীম না, বলো বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রীম খাওয়ার লোভেই এখানে আসা। খেয়াল করনি এখানে আইসক্রীম খেতে বসলেই বৃষ্টি নামে?”
“তাই নাকি? খেয়াল করিনি তো। ” অবাক হতাম।
“তুমি তো আমার দিকেই তাকিয়ে থাকো সব সময়। খেয়াল করবে কখন? মানুষ বিয়ের আগে বৌকে এভাবে দেখে। আর তুমি বিয়ের পর ছ্য বাচ্চার মা হয়ে যাওয়ার পরও এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো!” হেসে ফেলত রাহেলা। আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকতাম।
বৃষ্টি আসছে।
বেশ জোড়ে সোড়েই। আমি মাথা গোজার জন্য এদিক সেদিক চাইলাম। ভিজে যাচ্ছি। এ বয়সে ভিজলে জ্বর আসতে সময় নেবে না! রাহেলাটা যে কোথায় গেল আমাকে একা বসিয়ে!
হঠাৎ অনূভব করলাম আমার মাথার ওপর কেউ কাপড় জাতীয় কিছু একটা দিল! অবাক হয়ে তাকাতেই দেখলাম রাহেলা এসে পাশে বসেছে। ওর শাড়ির আঁচলটা দুজনের মাথায় ভাগাভাগি করে চাপিয়েছে।
মুখে মৃদু হাসি। হাতে দুটো কোন আইসক্রীম। আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিল, হাসতে হাসতে বলল, “চিন্তা করছিলে?”
“একটু” আইসক্রীম খুললাম। “ভিজে যাচ্ছ তো!”
“এজন্যই তো এলাম। দুজনে মিলে ভিজতে ভিজতে আইসক্রীম খাবো।
”
“আঁচল সরাও। লোকে কি ভাববে দেখলে?” অস্বস্তি মেশানো গলায় বললাম।
“যা ভাবে ভাবুক। এই ষাটের ঘরে এসেও যদি লোকের ভয় করো! তোমার নতুন ইয়াং লাইফ শুরু আজ থেকে- আমার হিংসা হচ্ছে! আরো এক বছর আমাকে চাকরী করতে হবে! প্রতিদিন আট ঘন্টা!” মন খারাপ করা গলায় বলল ও।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবতা।
দুজনেই চুপচাপ।
হঠাৎ হাসলাম আমি।
“হাসছো যে?” আইসক্রীম চশমা আর নাকে লাগিয়ে ফেলল রাহেলা এই বুড়ো বয়সেও। আমি হেসে সেটা মুছে দিতে দিতে বললাম, “প্রতি দিন এখন সান গ্লাস লাগিয়ে মোটর বাইকে চেপে তোমাকে তো আর অফিস পৌছে দিতে পারব না। তাই ভাবছি একটা রিক্সা কিনে ফেলব পেনসনের টাকা দিয়ে।
একটা ড্রাইভারও রাখব। চোখে সান গ্লাস দিয়ে তোমাকে আমার পাশে বসিয়ে রিক্সায় করে অফিসে নিয়ে যাব, নিয়ে আসব। সবটা আবার নতুন করে শুরু করব। আবার তোমার হীরো হব। এ দফায় মোটর বাইক না, রিক্সা হীরো! হা হা হা!” শুনে রাহেলা হেসে ফেলল।
বৃষ্টি বাড়ছে। ভিজছি দুজনে। বৃষ্টিতে অদ্ভূত একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি...... মিষ্টি একটা ঘ্রাণ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।