কমিউনিস্ট বিডি'র আর সব লেখার জন্য http://communistbd.wordpress.com পর্ব ২
এবারে উনিশ শতকের পূর্ববর্তী সময়কালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাসির দ্বিতীয় পর্যায়ের উপর নজর দেয়া যাক।
এই কালপর্বটা ছিল ১৮৯৪-১৮৯৮ সাল পর্যন্ত। নব্বইয়ের দশকটার মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাশিয়ায় যে শ্রমিক আন্দোলনগুলো চলেছিল সেগুলোর সাথে গন্ডিবন্ধ মার্কসবাদী চক্রগুলোর যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত। এ সময়টাতে পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদীরা কিছুটা এগিয়ে থাকা শ্রমিকদের ছোট ছোট চক্রে মার্কসবাদের প্রচার চালাত। লেনিন প্রস্তাব রাখলেন এই ছোট ছোট গ্রুপগুলোর বাইরে ব্যাপক জনগণের মধ্যে আন্দোলনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।
লেনিন এসময়ে বেশ কিছু প্রচারপত্র লিখলেন। লেনিনের প্রচারপত্র আর পুস্তিকা এ পর্বের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে খুব সহায়ক হল। এই পর্বেই লেনিন খুব উৎসাহ নিয়ে বড় বড় কারখানাগুলোর অগ্রণী শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ করতে লাগলেন। উদ্দেশ্য ছিল অগ্রগামী শ্রমিকদের নিয়ে একটা বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তোলা যেটা বৃহৎ শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
১৮৯৫ সালে বসন্তে গ. ভ. প্লেখানভের ‘শ্রমমুক্তি’ গ্রুপের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং পশ্চিম ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য লেনিন বিদেশে গেলেন।
আর বিদেশ থেকে ফেরার পথে ফিরলেন ভিলনা, মস্কো, অরেখভো-জুয়েভো হয়ে (রাশিয়ার শহর) সেখানকার সোশাল ডেমোক্রাটদের সাথে যোগাযোগ করে। ১৮৯৫-এর সেপ্টেম্বরে লেনিন ফিরলেন পিটার্সবুর্গে। ফিরে এসে ঐ বছরেই পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদী চক্রগুলোকে সম্মিলিত করে গঠন করলেন একটি রাজনীতিক সংগঠন। সংগঠনটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম সংঘ’।
লেনিনের ‘সংগ্রাম সংঘ’ রাজনীতিক গণ-আন্দোলনকে বেগবান করল আর শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে শুরু করল।
বেশকিছু প্রচারপত্রও ‘সংগ্রাম সংঘ’ ছেপে বিলি করেছিল। লেনিনের এই ‘সংগ্রাম সংঘ’ শ্রমিক আন্দোলনকে কতটা বেগবান করেছিল সেটা সহজেই অনুমান করা যায় ১৮৯৬ সালের গ্রীষ্মকালে পিটার্সবুর্গে সুতাকল শ্রমিকদের বিখ্যাত ধর্মঘট থেকে। এই ধর্মঘটের নেতৃত্বে ছিল ‘সংগ্রাম সংঘ’ আর এতে যোগ দিয়েছিল ত্রিশ হাজারের বেশি শ্রমিক।
এই বিরাট আকারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ফলে ‘সংগ্রাম সংঘের’ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পিটার্সবুর্গের বাইরেও। মস্কো, কিয়েভ, ভ্লাদিমির, ইয়ারোস্লাভল, ইভানভো-ভজনেসেনস্ক এবং রাশিয়ার অন্যান্য শহরের শ্রমিক চক্রগুলো সম্মিলিত হয় সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক গ্রুপে।
ফলতো দেশে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি গঠনের কাজ আরো একধাপ এগিয়ে যায়।
কিন্তু লেনিন এই ধর্মঘটে থাকতে পারেন নি। ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বররেই লেনিনসহ ‘সংগ্রাম সংঘর’ বেশ কিছু কর্মী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সে সময়ে ‘সংগ্রাম সংঘের’ কর্মীরা ‘রাবোচেয়ে দেলো’ (শ্রমিক আদর্শ) নামে একটা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার কাজ শেষ করে এনেছিল। পুলিশের হাতে পড়েছিল সেসব এবং সমাপ্তি ঘটেছিল গোপন শ্রমিক পত্রিকার প্রথম প্রচেষ্টার।
এরপর শুরু লেনিনের ১৪ মাসের জেলজীবন এবং তারপর ৩ বছরের সাইবেরিয়া নির্বাসন।
লেনিন যখন সাইবেরিয়ার নির্বাসনে সে সময় ১৮৯৮ সালের মার্চ মাসে মিনস্কে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির প্রতিষ্ঠা-কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস যে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে তাতে খোলাখুলি পার্টির লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্যের সাথে লেনিন একমত পোষণ করলেন। কিন্তু এই কংগ্রেস বিচ্ছিন্ন মার্কসবাদী চক্র ও গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয় নি।
পার্টির কোনো কর্মসূচি ও নিয়মাবলীও এ কংগ্রেসে গৃহীত হয় নি। আর যে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়েছিল খুব দ্রুত সেটা গ্রেফতার হয়ে গেল। ফলে সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক সংগঠনগুলোর মধ্যে মতানৈক্য তো কমলোনা বরং বাড়তেই থাকল। পূর্বের মতোই কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রইল স্থানীয় গন্ডির ভেতর। কাজেই সংগঠনের এই গ্রুপমানসিকতা দূর করার জন্য একটা সারা রুশ মজবুত সংগঠন গড়ার প্রয়োজনীয়তা দেখাদিল।
এখানেই শেষ দ্বিতীয় কালপর্যায়ের। এই দ্বিতীয় কালপর্যায় সম্পর্কে লেনিনের মন্তব্যগুলো একটু দেখে নেয়া যাক।
লেনিনের মতে এটা ছিল রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাসির শৈশব আর কৈশোর কাল। এ কালপর্যায়ে দুটি ব্যাপার খুব চোখে পড়ছিল একটা হল- নারদবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আর শ্রমিকদের মধ্যে যাবার জন্য প্রবল আগ্রহে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় এবং দ্বিতীয়টা হল শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মঘটের জন্য ব্যাপক উৎসাহ দেখা যাচ্ছিল।
এই কালপর্বে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে এসেছিল যৌবনের প্রারম্ভে তারা প্রায় সবাই ছিল সন্ত্রাসবাদী বীরপুরুষদের (নারদবাদী) ভক্ত।
আর যারা শেষ পর্যন্ত নারদনায়া ভোলিয়ার প্রতি অনুরক্ত থেকে গিয়েছিল তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা চলছিল এই সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে তরুণ নেতারা বাধ্য হয়েছিল শিক্ষাদীক্ষা লাভ করতে, প্রত্যেকটা মতধারার বেআইনী সাহিত্য পড়তে এবং বৈধ নারদবাদ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে।
খুব দ্রুতপদে এগিয়ে গিয়েছিল আন্দোলনটা। আবার যেহেতু নেতাদের বেশিরভাগই ছিল নওজোয়ান তাদের মাঝে তারুণ্যের প্রভাব ছিল অধিক মাত্রায় যতটা না তারা উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল বাস্তবের কাজকর্মের জন্য। এরা খুব দ্রুতই ছিটকে পড়েছিল আন্দোলন থেকে।
কিন্তু তুবও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কাজকর্মের পরিধি ছিল খুবই বিস্তীর্ণ। আর এই সংগ্রামে যারা তালিম নিয়েছিল সেই সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা প্রবেশ করেছিল শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে। তাদের পথটা হয়ে উঠেছিল আলোকিত। মার্কসবাদের কথা অথবা স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদে করণীয় কাজের কথা তারা স্মরণে রেখেছিল সদা-সর্বক্ষণ।
আদতে দ্বিতীয় কালপর্যায়ে যা ঘটেছিল আমরা তার সারাংশে দেখাতে পারি- এ পর্বে একটা মার্কসবাদী পার্টি গঠিত হয়েছিল বটে তবে তার অবয়বটা তখনো ভালভাবে নির্দিষ্ট হয়নি আর একটা বিপ্লবী পার্টির বৈশিষ্ট্যগুলোও তার মধ্যে ফুঁটে ওঠেনি যতটা ফুলে উঠেছিল তার অনৈক্যের চেহারাটা।
লেনিনের ভাষায় খান-খান অবস্থা।
সত্যিবলতে, একটা কাজ বাস্তবে শুরু করার পরপরই ঐ কাজ বাস্তবায়নের প্রকৃত সমস্যাগুলো যেমন ফুটে ওঠে তেমনই পার্টি গঠনের এই কালপর্বে একটা বিপ্লবী পার্টি গড়েতুলবার পথের প্রকৃত সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।