আল্লাহর নবী পবিত্র নারী মরিয়ম পুত্র যিশুকে (মুসলমানদের ঈসা নবী) নিয়ে কিছু বলতে চাই। তিনি ছিলেন একজন পবিত্র মানুষ। সন্ন্যাসীর মতো অবিবাহিত জীবনযাপন করতেন। তাঁর জন্মটাই হচ্ছে আল্লাহপাকের কুদরত। তিনি পিতা ছাড়াই মায়ের উদরে এসেছেন।
যদিও সে সময়ের সমাজনেতা ও সরকারি লোকেরা নানাভাবে তাঁর জন্ম নিয়ে নানা কুত্সা রচনা ও রটনা করেছে। তাঁর মা পবিত্র নারী বিবি মরিয়মকে নিয়েও গালমন্দ করেছে। মাত্র ৩২/৩৩ বছরে আল্লাহর নবী দুনিয়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। তত্কালীন রোমান শাসক তাঁর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, কেন শাসক ও সমাজপতিরা তাঁকে সহ্য করতে পারেনি।
কারণ তিনি সত্য প্রচার করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। নির্যাতিতের মুক্তির জন্য কথা বলতেন, যা সমাজপতি ও শাসকদের পছন্দ ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি নাকি নিজেকে রাজা ঘোষণা করেছেন। সত্য হচ্ছে তিনি কখনোই নিজেকে রাজা ঘোষণা করেননি।
যিশু বলেছিলেন, ঈশ্বরের রাজ্যে বাস কর, ঈশ্বরের পাওনা ঈশ্বরকে দাও। ফলে শাসক দল তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার চেষ্টা করে। যিশুর ভক্তরা মনে করেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মুসলমানেরা এটা বিশ্বাস করে না। আমার মনে পড়ছে, জগদ্বাসীর গৌরব মহামতি সক্রেটিসের কথা।
আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনো সম্পদ ছিল না। তিনি কোনো রাজ্য দখল করতে চাননি। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনো কটু বাক্যও বলেননি। শুধু একখানা কাপড় পরে নগ্ন পায়ে শহরে চলতেন। যুবকেরা তাঁর কথা শোনার জন্য ভিড় জমাতো।
তিনি যুবকদের যুক্তির কথা বলতেন। সত্যের কথা বলতেন। সরকার মনে করত সক্রেটিস তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তাঁরা সক্রেটিসের জ্ঞানকে ভয় করত। আর এ জন্যই নানা মিথ্যা অভিযোগ এনে শাসক দল সক্রেটিসকে হত্যা করেছিল।
তথাকথিত ভুয়া আদালত তাঁকে বলেছিল, আপনি যদি দেশত্যাগ করেন তাহলে আমরা আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেব না। চলে যেতে সাহায্য করব। তিনি রাজি হননি। তাঁর ভক্তরাও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন দেশত্যাগের জন্য। তিনি রাজি হননি।
জেলখানার জেলারও তাঁকে গোপনে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন, সত্য কেমন করে পালিয়ে যাবে। সত্যের কোনো দেশ থাকে না। তাই সক্রেটিস হাসিমুখে বিষপান করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বিশ্ববাসী আজও সক্রেটিসকে স্মরণ করে, সম্মান করে।
তত্কালীন শাসক বা বিচারকদের কথা কেউই জানে না।
আরেকজন বিপ্লবী বীরপুরুষ হচ্ছেন আর্জেন্টিনার আর্নেস্টো চে’ গুয়েভারা। সচ্ছল শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। মা-বাবা ডাক্তারি পড়িয়েছেন এবং স্বাধীন মতামত নিয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। মার্কসবাদের বিপ্লবের দীক্ষা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার শোষণ থেকে মাতৃভূমির মানুষকে মুক্তি দিতে।
এক সময় নিজ দেশ আর্জেন্টিনা থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর থেকেই শুরু হলো অবিরাম ভ্রমণ। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো চষে বেড়ানো। চোখে-মুখে স্বপ্ন, একদিন এই পৃথিবীর নির্যাতিত ও শোষিত মানুষ মুক্তিলাভ করবে। বিপ্লবের দর্শন ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে দেশে বিপ্লবী বাহিনী গঠন করতে লাগলেন।
বন্ধু ফিদেলের আহ্বানে কিউবার গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশটিকে মুক্ত করে কিছুদিন সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু মন পড়ে থাকে গণমানুষের যুদ্ধের ময়দানে। তাই এক জায়গায় থিতু থাকতে পারেননি। আবার নতুন কোনো দেশে বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে ছুটে যাওয়া।
নিজেদের মানে বিপ্লবী সম্পর্কে বলতে গিয়ে চে বলেছেন, আমাদের সম্পর্কে যদি বলা হয়, আমরা একটু বেশি রোমান্টিক, আমরা গোঁড়া আদর্শবাদী, আমরা অসম্ভবের ভাবনা ভাবি, তাহলে এক হাজার একবার স্বীকার করবো, হ্যাঁ, আমরা তাই।
মহান বিপ্লবী সাম্রাজ্যবাদের এক নম্বর শত্রু চে সম্পর্কে এই ছোট্ট পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। এমন একজন বিপ্লবী এ জগতে আর জন্ম নিবে কিনা বলতে পারি না। কিন্তু হৃদয় বলে, হে বিপ্লবের সন্তানেরা, বার বার এ পৃথিবীর বুকে নেমে আস। মজলুমদের জালেমের হাত থেকে রক্ষা কর। মজলুমের তখত-তাউসকে জ্বালিয়ে ছারখার কর।
জগতের সব জালেমই মানবতার শত্রু, শান্তির শত্রু। আমাদের এই গ্রহের ৭শ’ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষই খেতে পায় না। তাদের থাকার জায়গা নেই। তাদের সন্তানেরা শিক্ষা পায় না। একদিকে চরম দারিদ্র্য ও অশিক্ষা, অন্যদিকে ভয়াবহ যুদ্ধ, অস্ত্রের ঝনঝনানি।
কথায় কথায় পরদেশ আক্রমণ করা। এমনি এক সময়ে আমি চে’ সক্রেটিস যিশু আর ওসামা বিন লাদেনের কথা স্মরণ করছি। এই চারজনকে রাষ্ট্র বা জালেম শাসকরা হত্যা করেছে। এরা সবাই মানব জাতির মুক্তির জন্য নিজেদের জীবন দান করেছেন। বলিভিয়ার গণমানুষের মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবকালে সিআইয়ের ঘাতকরা চে-কে গ্রেফতার এবং গুলি করে হত্যা করে।
২০১১ সালের মে মাসের ২ তারিখে আমেরিকার সিআইএ ও নৌসেনারা ইসলামী বিপ্লবের গেরিলা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়ি থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় আটক ও হত্যা করে। আমেরিকার তাঁবেদার ও সমর্থক রাষ্ট্র আর সরকারগুলো ওসামাকে একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে। আমেরিকা ওসামার লাশ কাউকে দেখায়নি। লাশ দাফনও করেনি। এমন কি তারা ছবি দেখাতেও রাজি হয়নি।
বরং ওসামাকে হত্যা করে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, ন্যায় বিচার সম্পন্ন হয়েছে। শুরুতেই তো বলেছি, তথাকথিত ন্যায় বিচারের কথা বলেই সক্রেটিস, ঈসা নবী, চে গুয়েভারাকে হত্যা করে আনন্দ প্রকাশ করেছে তত্কালীন শাসকরা। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে মানুষেরই প্রতিনিধিরা। চে এবং ওসামা ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক। সে আদর্শ সবার পছন্দ হবে এমনটি কেউ দাবি করে না।
চে এবং ওসামা উভয়ই ছিলেন বিপ্লবী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শত্রু। দু’জনকেই হত্যা করেছে মার্কিনিরা। দু’জনেরই অপরাধ, তারা গণমানুষের পক্ষে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। দু’জনই উচ্চশিক্ষিত। একজন ডাক্তার, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার।
একজন ধনীর ছেলে, আরেকজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিশীলিত পরিবারের ছেলে। একজন ছিলেন মার্কসবাদী, আরেকজন ইসলামিস্ট।
চে আজীবনই মার্কিনিদের শত্রু ছিলেন। ওসামা কিছুদিন আমেরিকানদের বন্ধু ছিলেন। ধনীর ছেলে হিসেবে আমেরিকান ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ওসামার বন্ধুত্ব ছিল।
ওসামা এবং মার্কিনিরা আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। আমি বলব, কৌশলগত দিক থেকে এটা ছিল ওসামার ভুল। আমেরিকান বা পশ্চিমা শাসকরা কখনোই ইসলামের বন্ধু ছিল না। তারা কখনোই নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিল না। তারা উলঙ্গ পুঁজিবাদের পূজারি।
পুঁজিবাদই তাদের ঈশ্বর। ইসলাম কখনোই পুঁজিবাদকে সমর্থন করে না। ইসলাম দারিদ্র্যকে ঘৃণা করে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, দারিদ্র্য মানুষের ঈমান নষ্ট করে। ক্ষুধার্ত মানুষের এবাদত হয় না।
রাসুলের ইসলাম জগতে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই একদিকে অ্যাটম বোমার মিছিল, অন্যদিকে নিরক্ষর ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। এমন একটি পৃথিবী আল্লাহর রাসুল কখনোই চাননি। চলমান বিশ্বে যিশু, মুহাম্মদ (সা.) ও ভগবান বুদ্ধের সমর্থকের সংখ্যা প্রায় পাঁচশ’ কোটির মতো। যদি তারা সবাই তাদের পথপ্রদর্শকদের সত্যিকারে ভালোবাসেন বা মান্য করেন তাহলে জগতের মানুষ এত নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হতো না। এর মানে হচ্ছে, তারা কেউই খাঁটি ঈমানদার নয়, নিজ নিজ আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত নয়।
আস্থাহীন অবিশ্বাসী মানুষ জালেমের দোসর। তাই জালেমরা জগতকে দখল করে নিয়েছে। ইসলামবিরোধী রাজতন্ত্র ও বাদশাহীর বিরুদ্ধে বলেই ওসামা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। ভিনদেশের গোপন আস্তানায় থেকে তিনি শত্রুর হাতে নিহত হয়েছেন অপর এক মুসলমান দেশে। চে’ও নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
তিনিও নিহত হয়েছেন ভিনদেশে। যদিও চে কিউবাকে মুক্ত করে সে দেশের নেতা ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। তারপর আবার বিপ্লবের তাগিদে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ওসামাও তাঁর বিপ্লবের বাণী জগদ্ব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন ইসলাম, মানবতা ও জগদ্ব্যাপী নির্যাতিত মানুষের প্রধান শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালরা।
সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়ার কারণে ওসামা পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে বহুল প্রচারিত। পশ্চিমা শাসকরা মনে করেন, ওসামা বিভ্রান্ত ছিলেন এবং ইসলামকে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বহু যুবককে বিভ্রান্ত করেছেন। আমেরিকার শাসকগোষ্ঠী ওসামার বিরুদ্ধে টুইন টাওয়ার ধ্বংসসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ করেছে। কিন্তু এই অভিযোগটি এখনও প্রমাণিত হয়নি।
খোদ আমেরিকাতেই এ ব্যাপারে নানা মত রয়েছে।
ওসামা নিজেই বলেছেন, তিনি এক ধনী পরিবারের ছেলে। ইচ্ছা করলে পশ্চিমা যে কোনো দেশে বসবাস করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন একটি অনিশ্চিত জীবন।
গুহায় গুহায় পালিয়ে থেকে শত্রুর হাত থেকে জীবন রক্ষা করা। প্রশ্ন হলো কেন এমন একটি জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এটা কি কোনো পাগলামো? না রোমান্টিসিজম? এ নিয়ে সারা বিশ্বের লেখকরা লিখবেন। ওসামাকে নিয়ে এখনও লেখালেখি চলছে। ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ওসামার মৃত্যু আমেরিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি।
ক্যাস্ট্রো আরও বলেছেন, আমেরিকা কিউবান দ্বীপ গুয়ান্তানামো দখল করে সেখানে গোপন কারাগার তৈরি করেছে। পৃথিবীর বহু দেশে আমেরিকার গোপন কারাগার রয়েছে। কোনো বিচার ছাড়াই তারা কমিউনিস্ট বা জঙ্গি নাম দিয়ে মানুষ হত্যা করে। বিগত ৬০ বছরে বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম আর ইসলামকে প্রতিহত করার নামে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।