ভালোকে আমার ভয়,ভালো বেশীদিন থাকবেনা... মন্দকে আমার ভয়, কেননা আমি দুর্বল, আঘাত সইতে পারবোনা... সাফল্যকে আমার ভয়, ব্যর্থতাকেও ভয়... নিরন্তর ব্যস্ততার মহাকালে আমার করণীয় কিছুই নেই... যোগ্যের পৃথিবীতে আমি অযোগ্য, অধম... আকাশের মন খারাপ। বাতাস বইছিল খুব জোরে। অথচ আজ বাতাস হবার কথা না। আমি বাতাসকে খুব ভয় পাই।
যেসব এড়িয়ে চলতে চাই, সেটাই আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, এটা পরীক্ষিত সত্য।
তবু সব ভয় বাধা ডিঙ্গিয়ে আজ আমি শিমু এখানে। একটা সময় ছিল আমার যখন ৩ তলা থেকে উপরে গেলেই বমি করে দিতাম। এখন মেঘের দেশ ডিঙ্গিয়ে আকাশের কোল ঘেঁষে চলতে পারি।
প্লেনের ইকোনমি ক্লাসে বসে মারটিনির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে এমনটাই মনে হচ্ছিল আমার। জীবনের চরম একটা মুহূর্তের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আর কিছুক্ষণ পরেই।
সময় অনেক ভালো প্লেয়ার। কখন কাকে কিছু না বলে কিসের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তার কিছুই আগে থেকে টের পাওয়া যায়না। আমিও টের পাচ্ছিনা। কিছু একটা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছি, পারছিনা।
যতই ভুলে থাকতে চাইছি, ততই ভাবনারা আরামসে জেঁকে বসছে মগজে।
চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠছে আজ থেকে ৫ বছর আগের অনেক মুহূর্ত।
***
জীবনের টানাপোড়নে আমি দিশেহারা। একদিকে আকাশ ছোঁয়ার সাধ , অন্যদিকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকা দারিদ্র। বুকের পাঁজরে সযতনে লুকিয়ে রাখা স্বপ্ন, আর মগজে চিন্তা কালকের দিনটার, কি করে ভালো ভাবে কাটাতে পারবো।
আমি দুশ্চিন্তা করতে পারিনা, মা টের পেলে কাঁদবে।
আমি হাসতে পারিনা, হাসতে কষ্ট লাগে।
২২ বছর বয়সে একটা মেয়ের আধুনিকা হতে হলে যেমন থাকা উচিত, চলা উচিত বলে মনে করে আধুনিক সমাজ, আমার মাঝে তার ছিটেফোটাও নেই। নিজে নিজের মত করে থাকি, কৃত্রিম ফ্যাশান নিজের শরীরের সাথে জুড়ে দিয়ে সং সাজিনা।
আর কটা সমবয়সি মেয়ের মতো হাতে আইফোন নেই। চুলে গ্লিটার করে পনিটেইল নেই।
মৃদু বাতাস এলেই রিবন্ডইং করা চুল ওড়ে না আমার, আমি তো ওদের মত ছন্দে ছন্দে দুলে পড়া মেয়ে নই। আমি কঠিন, আমি বাস্তব।
আমার নিজের বলতে যা আছে তা হল একটা নোকিয়া ১৬৬১ মডেলের মোবাইল। একটা Acer aspire4720z, খুবই লো কনফিগারেশন এর একটা ল্যাপটপ, আর খুব শখ করে কেনা একটি গিটার।
মোবাইল দিয়ে কথা বলি মায়ের সাথে, গিটারের তারে বোঝাপড়া নিজের সাথে, লো কনফিগারেশন ল্যাপটপ দিয়ে খুঁজি হাই স্পিডি আরনিং সোর্স।
সকালে রুটি খাই, দিনে ২ বার ভাত খাই, ২বার চা খাই, প্রতিবেলা খাবার জন্যে সময় নেই ২-৩ মিনিট। ১ বার মেডিটেশনে যাই, কোন না কোন বই পড়ি, আর গান শুনি। আমি একা। সেই একাকীত্ব কাটাতে একা আমার প্রচেষ্টা। আমি আমার মাঝে ডুবে থেকেই আমার নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করি।
এইতো আমার জীবন, ছন্দহীন বিবর্ণ বেঁচে থাকা।
ফ্রীল্যাঞ্চিং জগতে এসে পরিচিত হয়েছি অনেকের সাথেই। অনেকের সাথে কাজ করেছি, ছোট, বড়, সমবয়সী। সমবয়সীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছে, ফ্রী হতে চেয়েছে আমার সাথে।
পারেনি। কাজের গণ্ডি পেরিয়ে 'তুমি' বলেও কখনও কাওকে বলিনি। বস ইজ আলঅয়েজ বস, নট মোর দ্যান দিস।
কাজের পারফর্মেন্স দেখে অজানা একজন মেসেজ দিল আমাকে। অনেকেই দেই, কাজ করার জন্যে।
তবে এই মানুষটা লিখল ভিন্ন বিষয়।
জানতে চাচ্ছে আমি কি কারো কাছ থেকে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছি কিনা। মেয়েরা নাকি কষ্ট না পেলে সিরিয়াস হতে পারেনা।
কি লিখবো ভাবতে ভাবতেই লিখে দিলাম, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে লাশ ও সক্রিয় হতে পারে।
সবসময়ই কমার্শিয়াল চিন্তা থাকে আমার।
কাজের ভেতর এভাবে মেসেজ আসতে থাকলে কাজের সময় নষ্ট হচ্ছে। আমন্ত্রণ করলাম ফেসবুকে।
কথা বললাম। সে আমাকে জানালো তার একটা সমস্যার কথা। কিছুতেই নিজেকে সিরিয়াস করতে পারেনা সে।
ভাবছি তাকে যদি কোনভাবে মোটিভেট করতে পারি।
বলতে বলতে ওর সব কথাই বলেছে আমাকে। আমিও বলেছি। আমার কথা, পরিবারের কথা, আমার আশা, আমার স্বপ্ন সব। আমার শেয়ার করার মানুষ নেই।
যা বলছি মন দিয়ে শুনছে, সত্যি বলতে কি নিজেকে হাল্কা লাগছে খুব।
প্রতিদিন চ্যাট করছি। ৩দিন দেখা করেছিলাম Skype তে। দেখা বলতে আসলে যা বুঝায়, সেরকম সামনে থেকে কেউ কাউকে দেখিনি।
আমার কথা শুনে অধিকাংশ মানুষ মনে করে আমি লাইফ নিয়ে অনেক ম্যাচিউরড একটা মেয়ে।
আসলে আমি যতটা বেশি দেখাই, আমি তারচেয়ে অনেক বেশি childlike, নিজের মধ্যে। তবে সেটা বেরিয়ে আসে খুব কম মানুষের সামনে। যেমনঃ আমার মা।
বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে আমি বারবার শিশু হয়ে যাচ্ছি আরেকটি নতুন ছায়ার কাছে। সে জাহিদ।
কিভাবে খাই, কিভাবে ঘুমাই, কি পেতে চাই, কি চাইনা, কিসের পিছে ঘুরে বেড়াই, আমার পরিকল্পনা, সাফল্য, ব্যর্থতা , পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ বেদনা সব অবলীলায় বলে যাচ্ছি তার কাছে। সে জাহিদ।
হঠাৎ আজ কি হল জাহিদের। অন্যদিনের মত না। আরও বেশী যত্ন, আরও একটু বেশী আবেগে কথা বলছে।
- ভালো আছো তুমি?
- হুম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ??
- ভালো নেই।
-কেন?
-বলা যাচ্ছেনা এখনি। কি করো?
-গান শুনছি... ''' ডাকবেনা তুমি আমায় জানি কোনদিন, তবু প্রার্থনা তোমার জন্যে হবেনা মলিন... """
-সবসময় তোমার সেই একই ধাঁচের গান শোনা।
আচ্ছা একটা কথা জিগ্যেস করি??
- করো।
-তুমি কি কখনো কাওকে ভালবেসেছ??
আমি জবাব দিলাম
- হুম বেসেছি।
- কাকে? আমাকে বলবে?
-Mr. Rowan Atkinson.
-সেটা কে??
- চেন না? মিস্টার বিন। দ্যা স্টার।
হাসল জাহিদ।
বলল
-তুমি সত্যিই একটা পাগলী। তুমি কি জানো আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি??
-মানে??
-I Need A Life With You. I Love You....
- আমি বুঝিনি।
- সহজ কথা বললাম। I really love you.
আমার মনের মধ্যে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে বুঝাতে পারছিনা। আমি জানি আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, তবু নিজেকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।
মনে হয় পারছিনা। খুব কান্না পাচ্ছে। নিজের চারপাশে তুলে রাখা দুর্ভেদ্য দেয়াল একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে, তাও নিজের আঘাতেই...!!
... পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছেনা। খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। যেতেই শুনি আড্ডার মধ্যে থেকে কেউ একজন গান করছে।
- Jab se tere naina mere naino se lage re.. Tab se dewana hua.. Sab se begana hua.....
ছেলেপেলে গুলো এতো বদ হয়েছে। পরীক্ষা তো দেয়ই না ঠিকমতো। আবার বেরিয়ে গান ধরেছে। অবশ্য আমিও আর ওদের চেয়ে ভালো হলাম কই? কিছুদূর হাঁটতেই মনে হল, এটা কি শুনলাম? এই গান তো আমাকে ও শুনিয়েছিল। ফিরে যেতেই দেখি সেখানে জাহিদ।
কি করে এখানে এলো? কখন এলো? কেন এলো? আমাকে তো বলেনি।
জিগ্যেস করতেই বলল ঃ তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল, তাই চলে এলাম... রাগ করলে নাকি???
আমি আনন্দে কেঁদে ফেলছি। এতো ভালবাসে কেউ আমাকে...!!!! মনে মনে লুকিয়ে যেমন করে কাওকে চাইতাম, তেমন করে ভালবাসে... !!!...
কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম ভাঙল। ভালোই বুঝা যাচ্ছে, জাহিদ হৃদয়ের সাথে সাথে মগজেও বসত গড়েছে। নইলে এই সপ্ন দেখতে যাবো কেন? না পারছি ঝেড়ে ফেলতে, না পারছি ধরে রাখতে।
ওকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন...
'''জাহিদ, তোমাকে আমি আমার সব কথা বলেছি। এই মুহূর্তে আমি নতুন কোন দায়িত্ব নিতে পারবোনা। আমি নিজের মনটাকেই এখনো সামাল দিতে শিখিনি এখনো। আমি কি পারবো তোমার মতো করে তোমাকে ভালবাসতে? পারবোনা। সংকটে থেকে থেকে এখন আর কোন কিছুকেই স্বাভাবিকভাবে মানতে পারিনা।
আমাকে বাঁচতে হবে ঠিক আমি যেমন করে বাঁচতে চাই। ভালবাসার আবেগ অনুভূতি কিছুই নেই এখন আমার কাছে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতে হলে তোমাকে হাঁটতে হবে অনেক পথ, আমাকে পাশে রেখে, আমার পাশে থেকে। সেই পথে তুমি আমার কাছ থেকে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাবেনা। যদি পারো, তবে এসো।
নাহলে যা আছি তা ই থাকবো...'''
কথাগুলো আরও একবার পড়ে দেখলাম। নিজেকে প্রথম শ্রেণীর মিথ্যুক মনে হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় অথচ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মিথ্যে কথা বলে ফেললাম।
জাহিদ শুধু বলেছিলঃ এটা কি সম্ভব??????
এটাই ওর শেষ এবং আমার শুরু।
*****
রানওয়েতে প্লেনের চাকা ঘষার মৃদু শব্দ হল।
সবাই তাড়াহুড়োতে নামছে। আমি বসে থাকলাম। আরও কিছুক্ষণ সময় নিজেকে দ্বিধায় রাখতে চাই। পূর্বপ্রস্তুতি। ভালো অথবা মন্দকে সাদরে নিরলিপ্তভাবে গ্রহণ করার।
চোখগুলোকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। কঠিন প্রস্তরের অবয়বের পেছনের মানুষটার যে একাকীত্ব উদ্বিগ্নতা, সেটা যেন কেউ টের না পেয়ে যায়। লন্ডন থেকে ফ্লাইট এর কিছুক্ষণ আগেই জাহিদকে জানিয়েছিলাম, দেশে আসছি, তারিখ এবং সময়। ও বলেছিল প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন আমি যেন গোলাপি জামা পরি, চুল খোলা থাকে। হাস্যকর লাগছে, আমি ওভাবেই তৈরি হয়ে এসেছি।
জানি কাজটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুইনা। গোটা ৫ টা বছর যার খবর নেইনি তাকে এভাবে জানানোটা খেয়ালিপনা ছাড়া আর বেশি কিছু না। আর যেভাবে বলেছি, সেটা শুধুই জানানো, আহবান নয়।
এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবো , কিভাবে যেতে হবে সেটা আগেই ব্যবস্থা করা আছে। গাড়ি অপেক্ষা করছে।
সবার উষ্ণ অভ্যর্থনাকে ছাপিয়ে চোখ চলে যাচ্ছে ৫বছর পেছনে ফেলে আসা অদেখা অজানা কোন মুখচ্ছবিতে।
নাহ... কেউ নেই... সে আসেনি... আসার কথাই-বা ছিল কখন... নিজের জেদকেই তো সবসময় উপরে রেখেছি... আসতে তো বলিনি তাকে... কেন তাহলে খুঁজে বেড়াচ্ছি???
নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। একসময় যে পূজারী আমার হয়েছিল, সময়ের আবর্তনে আমাকেই সে পায়ে ঠেলে দিলো। আসলে এসবের জন্যেই ভালবাসাকে ভালবাসতে পারিনি। বড় স্বার্থপর এই জিনিসটা।
যতক্ষণ সাড়া পাবে, ততক্ষণই সাথে থাকবে। তারপরেই শেষ।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাড়িতে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। ড্রাইভারকে ছুটি দিলাম।
পিচঢালা কালো পথ, কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, গালে বৃষ্টির পুরনো স্পর্শ আর ভীষণ খারাপ মন নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, একা। হিসেব মিলছেনা কি মানে ছিল এই ফিরে আসার। কোন পিছুটানে সব ফেলে এলাম...? আমি কি ভুল করে ফেলেছি???
আমার অসহায় দৃষ্টি স্থির হল একটা কিছুর দিকে। একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পাঞ্জাবী, জিন্স আর স্যান্ডেল, চোখে রিমলেস।
আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে হাসছে, এই ভঙ্গি আমি চিনি তবে খুব দেখেছি খুব অল্প সংখ্যকবার। মিথ্যে বলবো না, যতবার নিজের পাগলামিতে নিজে অতিষ্ঠ হই, এমনি এক ভঙ্গিমা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি তাকিয়ে আছি, পরিচিত থেকে আরও পরিচিত লাগছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল সুখের স্রোত বয়ে গেল... জাহিদ...!!!!
(কষ্ট ছাড়া গল্প লিখতে পারিনা। লেখা শেষে মনে হল জাহিদের আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়িয়ে দিয়ে শেষে না এলেই ভালো হতো।
শিমু একাই থাকতো। আবার মনে হল, শিমু তো ভুল করেনি। সেও তো আর কারো সাথে জড়ায়নি। অপেক্ষায় থেকেছে। তাই বদলালাম না।
নিয়তি সাধ্যের অতীত। তবে শিমু আর জাহিদের ভাগ্য আমার হাতে। তাই ভাবলাম , বিধাতার মতো নির্দয় না হয়ে মিলিয়ে দেই। সব শিমু আর জাহিদ ভালো থাকুক...) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।