আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০৩০ সালের একদিন by মুহম্মদ জাফর ইকবাল।। পড়ুন এবং যত বেশি পারেন শেয়ার করুন।

আউলা মাথার বাউলা পোলা। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের নোট: এটি একটি কাল্পনিক গল্প এবং আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, এটি কখনোই সত্যি গল্প হবে না – এটি কাল্পনিকই থেকে যাবে। এ দেশের গ্যাস কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এর মালিক হচ্ছে বাংলাদেশের ১৩ কোটি মানুষ। কিছু বিদেশী তেল কোম্পানির লোভের মূল্য জোগানোর জন্য এই দেশের সরকার নিশ্চয়ই দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেবে না। ভবিষ্যতের টুটুল আর রুনুদের জীবন নিশ্চয়ই আমাদের জীবনের থেকে শতগুণ আনন্দময় হবে, সহস্রগুণ স্বপ্নময় হবে এবং সেটি করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার _________________________________________________ টুটুল অঙ্কগুলো শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

সূর্য এর মাঝে হেলে পড়তে শুরু করেছে। সে তাড়াতাড়ি খাতা বন্ধ করে রুনুকে বলল, ‘রুনু চল। ' - ‘আমার যে এখনো হোমওয়ার্ক শেষ হয় নাই। ' - ‘এত দেরি করলি কেন? এখন কিছু করার নাই। ওঠ, ফিরে আসতে আসতে পরে অন্ধকার হয়ে যাবে।

' অন্ধকার কথাটি শুনেই রুনুর মুখে ভয়ের ছাপ পড়লে, সে তাড়াতাড়ি তার বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘চল। ' দুজন জুতো পরে রান্নাঘর থেকে নানা আকারের প্লাস্টিকের বোতল তাদের ছোট ঠেলাগাড়িতে তুলে নেয়, তারপর দরজা খুলে বের হয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আম্মু দরজা বন্ধ করে দাও। ' আম্মু এসে দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘সাবধানে যাবি কিন্তু। ' ঠেলাগাড়িতে প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে দুজনে ছুটতে থাকে, তাদের বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে - একটি টিউবওয়েল থেকে সবাই পানি নেয়। একটু দেরি হলেই অনেক ভিড় হয়ে যাবে।

রাস্তার মোড়ে সাইবার ক্যাফের সামনে এসে দুজন দাঁড়িয়ে গেল। জানালার পাশে ক্যাফের বুড়ো মতন মানুষটি ঝিমুচ্ছে। টুটুল গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের কোন ই-মেইল এসেছে চাচা?’ বুড়ো মানুষটা চোখ খুলে বলল, ‘কে? টুটুল?’ - ‘জী চাচা। আব্বুর কোন ই-মেইল এসেছে?’ - 'মনে হয় এসেছে। আমি প্রিন্ট আউট নিয়ে রেখেছি।

দাঁড়াও একটু দেখি। ' বুড়ো মানুষটা ডেস্ক ঘেঁটে একটা ছোট কাগজের টুকরো বের করে বলল, ‘এই যে। নাও। ' টুটুলের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ পড়ল, সে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল। বুড়ো মানুষটা নরম গলায় বলল, ‘তোমার মাকে বলো বিলটা দিয়ে দিতে।

দুমাসের বিল বাকি পড়েছে। ' - ‘বলবো চাচা। ' রুনু বলল, ‘আব্বু কি লিখেছে ভাইয়া?’ - ‘জানি না, বাসায় গিয়ে পড়বো। আয় আগে পানি নিয়ে আসি। ' টিউবওয়েলের সামনে এর মাঝেই অনেক বড় লাইন, টুটুল আর রুনু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে পানি ভরার সুযোগ পেল।

টিউবওয়েলটি একা চাপতে কষ্ট হয়। টুটুলের সঙ্গে রুনুও হাত লাগাল। রুনু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মোটর লাগানো থাকলে সুইচ টিপলেই নিজে থেকে পানি উঠতো, তাই না ভাইয়া?’ - ‘হ্যাঁ’। - ‘মোটর লাগায় না কেন?’ - ‘কেমন করে লাগাবে? ইলেক্ট্রিসিটি নাই যে। ' - ‘ইলেক্ট্রিসিটি নাই কেন?’ - ‘কেমন করে থাকবে? জেনারেটর চালাতে গ্যাস লাগে না?’ - ‘ও!’ রুনু চুপ করে গেল।

সবাই জানে বাংলাদেশে কোন গ্যাস নাই, যেটুকু গ্যাস ছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে পাশের দেশে রপ্তানি করে শেষ করে দিয়েছে। পানির বোতলগুলো তাদের ছোট ঠেলাগাড়িতে করে ঠেলে আনতে আনতে টুটুল তাকিয়ে দেখল আশপাশের সব বাসা থেকে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়ে যাচ্ছে। কাঠ, খড়, কাগজ, প্লাস্টিক জ্বালিয়ে সবাই রান্না করছে, তার কালো ধোয়ায় আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে, তার আগেই সবাই রান্না শেষ করে নিতে চাইছে। ঠেলাগাড়ি টেনে টেনে রান্নাঘরে তুলে এনে টুটুল আর রুনু হাঁপাতে থাকে।

মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন, তার মুখে কালি-ঝুলি মাখা, ধোয়ায় চোখ লাল হয়ে আছে। টুটুল বলল, ‘আব্বুর ই-মেইল এসেছে। ' - ‘কি লিখেছে?’ - ‘এখনো পড়িনি’। পানির বোতলগুলো থেকে ড্রামে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘পড়ব আম্মু?’ - ‘রান্নাঘরে চলে আয়’। টুটুল আর রুনু আম্মুর পেছনে পেছনে রান্নাঘরে এসে ঢুকল।

কংক্রিটের চুলোতে খড়কুটো, প্লাস্টিক আর্বজনা জ্বলছে, গলগল করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, রান্নাঘরের ভেতরে একটি তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। আম্মা চুলোর ভিতরে আরো কিছু আবর্জনা ঠেলে দিলেন। ধোয়ার দমকে তার কাশি উঠে গলে, খক খক করে কাশতে কাশতে হঠাৎ তার ছোটবেলার কথা মনে পরে গেল। তাদের বাসায় তখন গ্যাসের চুলো জ্বলত। কী সুন্দর নীল আগুন, এতোটুকু ধোয়া নেই।

নব ঘুরালেই জ্বলত, আবার নব ঘুরালেই নিবে যেত। আম্মা একটা নি:শ্বাস ফেললেন – মাত্র ২০-২৫ বছর আগের কথা, অথচো সেই দিনগুলোকে এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। টুটুল পকেট থেকে কাগটা বের করে বলল, ‘পড়ব আম্মু?’ - ‘হ্যাঁ পড়। ' টুটুল পড়তে শুরু করে – সোনামণি টুটুল এবং রুনু, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, তোমাদের ৬ মাস হলো দেখিনি। শরৎকালীন ছুটির জন্য বসে আছি, তখন তোমাদের দেখতে আসব।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, তোমাদের না দেখে আমার এক মুহূর্তও কাটে না। তবুও ওই দেশে পশুর মত খাটছি, কারণ বাংলাদেশে এখন কোন কাজ নেই, কোন চাকরি নেই। যখন মনে হয় যে, বাংলাদেশও এরকম একটি দেশ হতে পারত তখন আমার খুব দু:খ হয়। কিন্তু ২০ বছর আগে দেশের সব গ্যাস রপ্তানি করে দিয়ে দেশটাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। এখানে আমি যখন ইলেকট্রিক লাইট জ্বালাই তখন আমার মনে হয় আমাদের দেশেও ইলেক্ট্রিসিটি থাকতে পারত।

যখন রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রান্না করি তখন মন হয় বাংলাদেশের মানুষও তাদের গ্যাস ব্যবহার করতে পারত। আমি রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে যাই, যখন মনে পড়ে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে আমাদের দেশের গ্যাস এই দেশে রপ্তানি করে দিয়েছে, এই দেশের মানুষ সেই গ্যাস জ্বালিয়ে শেষ করেছে। এখন আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার শুধু ঈশপের সেই সোনার ডিম পাড়া হাসের গল্পটির কথা মনে পরে। সোনামণিরা, তোমরা তোমাদের আম্মুকে দেখে রেখ।

তোমাদের আব্বু টুটুল চিঠি পড়া শেষ করতেই রুন জিজ্ঞেস করল, ‘ঈশপের গল্পটি কী আম্মু?’ টুটুল বলল, ‘তুই জানিস না?’ - 'না’। টুটুল চোখ বড় বড় করে বলল, 'গল্পটা হচ্ছে এরকম – একজনের একটা রাজহাঁস ছিল। সেটি প্রত্যেক দিন একটা করে সোনার ডিম পাড়ত। সেই মানুষটা ভাবল, প্রত্যেক দিন একটা করে সোনার ডিম দিয়ে কী লাভ? তার থেকে হাসের পেট কেটে একবারে সবগুলো সোনার ডিম বের করে নিই! লোভে পরে সে হাসের পেট কেটে দেখে সেখানে কোন ডিম নেই। তার তখন মাথায় হাত।

' রুনু অবাক হয়ে বলল, ‘একেবারে বাংলাদেশের মতো? একটু একটু করে অনেক দিন গ্যাস ব্যবহার না করে একবারে সব গ্যাস বিক্রি করে দেওয়া!’ - ‘হ্যাঁ’। আম্মা ম্লান মুখে হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘শুধু একটা পার্থক্য। ' - ‘কী পার্থক্য?' - ‘হাসটা যে কেটেছিল সেই ছিল হাসটার মালিক। বাংলাদেশের গ্যাসের মালিক ছিল দেশের মানুষ, তারা কিন্তু কখনোই গ্যাস রপ্তানি করতে চায়নি। বিদেশী গ্যাসের কোম্পানি আর দেশের কিছু মন্ত্রী মিলে গ্যাস রপ্তানি করেছে।

' আম্মা একটা নি:শ্বাস ফেলে বললেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগের কথা, আমি তখন খুব ছোট। শুনেছি যে নির্বাচনের আগে তারা গ্যাস রপ্তানি নিয়ে একটা কথাও বলেনি, কিন্তু নির্বাচনে জেতার পরের দিন থেকেই তারা গ্যাস বিক্রি করার কাজে লেগে গিয়েছিল’। - কেন আম্মু?’ - ‘প্রায় ৩০ বছর আগের কথা – আমি ভালো করে জানি না। যতটুকু শুনেছি দেশের মানুষ, এক্সপার্ট, ছাত্র-শিক্ষক সবাই বলেছিল দেশের জন্য ৫০ বছরের গ্যাস মজুত রেখে তার থেকে যেটুকু বেশি সেটা রপ্তানি করতে। সব মিলিয়ে খুব বেশি হলে ১০-১২ বছরের মতো গ্যাস মজুত ছিল।

নতুন গ্যাস খুঁজে পাওয়ার আগেই বিদেশী কোম্পানিগুলো কী বোঝাল কে জানে, গ্যাস রপ্তানি শুরু করে দিলো’। - ‘গ্যাস আর পাওয়া যায়নি?’ - ‘অল্প কিছু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের নিজের গ্যাস কোম্পানীকেও সুযোগ দেয়নি – তারাও কিছু করতে পারেনি। ' - ‘গ্যাস বিক্রি করে টাকা আসেনি?’ - 'নিশ্চয়ই এসেছে। সেই টাকা লুটেপুটে খেয়েছে।

সেজন্যই তো গ্যাস বিক্রি করতে এত উৎসাহ ছিল। এর আগেও দেশের গরিব মানুষের জন্য রিলিফ এসেছে, সাহায্য এসেছে কিন্তু কখনোই জায়গা মতো পৌঁছায়নি। আগেই অন্যরা লুটেপুটে খেয়ে ফেলেছে’। টুটুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাদের দেশে ভালো মানুষ নাই আম্মু?’ - ‘আছে। কিন্তু তারা তো রাজনীতি করে না।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ভালো মানুষরা যখনই রাজনীতি করতে গিয়েছে, হয় তাদের মেরে ফেলেছে, না হয় রাজনীতি করতে দেয়নি’। রুনু এবারে একটা লম্বা নি:শ্বাস ফেলল। আম্মা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি খেতে আয়, একটু পরেই তো অন্ধকার হয়ে যাবে। ' সূর্য ঢলে পড়ছে, একটু পরেই যখন সূর্য ডুবে যাবে তখন সারা দেশ অন্ধকারে ডুবে যাবে। দেশের প্রায় পুরো ইলেক্ট্রিসিটিটাই আসত গ্যাস জেনারেটর দিয়ে।

২০ বছর আগে যখন দেশের গ্যাস ফুরিয়ে গেল, তখন একটি একটি করে সবগুলো জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেল। এখন এই দেশে আর কোন ইলেক্ট্রিসিটি নেই, অল্প যেটুকু তৈরি হয় দেশের বড়লোকেরা, মন্ত্রীরা, গডফাদাররা, বিদেশী কূটনীতিকরা ব্যাবহার করে। টুটুল আর রুনু খেতে বসল। অল্প কিছু ভাত, কিছু আলু সেদ্ধ, একটি ডিম দুই ভাগ করে দুই জন। সঙ্গে কিছু মটরশুঁটি।

টুটুল জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু তুমি খাবে না?’ - ‘তোরা খা, আমার খিদে নেই। ' - ‘তুমি তো কালকেও ঠিক করে খাওনি, আম্মু। ' - 'আমরা তো বড় হয়ে গেছি, তাই আমাদের এত খিদে পায় না। তোরা তো বাড়ন্ত তাই তোদের ভালো করে খাওয়া দরকার। ' রুনু বলল, ‘ও’।

ছোট বলে সে বুঝতে পারল না যে, আসলে খাবার নেই বলে আম্মু খাচ্ছেন না। টুটুল তার খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা যখন ছোট ছিলে তখন কী বাংলাদেশে খাবার ছিল?’ অতীতের কথা স্মরণ করে আম্মার চোখ হঠাৎ একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটু হেসে বললেন, ‘এক সময় বাংলাদেশ খাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ইলেক্ট্রিসিটি দিয়ে পানির পাম্প আর সার কারখানা চলত। সেই পানি আর সার দিয়ে চাষাবাদ হতো।

এখন গ্যাস নেই তাই ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই পানি নেই। পানি নেই তাই চাষাবাদ নেই। চাষাবাদ নেই তাই খাবার নেই। প্রথম যখন দুর্ভিক্ষ হলো...’ আম্মা হঠাৎ করে থেকে গেলেন।

টুটুল জিজ্ঞেস করল, ‘তখন কি হয়েছিলো আম্মু?’ আম্মা হাত নেড়ে বললেন, ‘থাক সেসব কথা শুনে লাভে নেই। ' - ‘কেন আম্মু? বলোনা শুনি। ' আম্মা একটা নি:শ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেশের গ্যাস যখন ফুরিয়ে গেল তখন হঠাৎ করে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেল, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, খাবার নেই, চাকরি নেই, গায়ে কাপড় নেই, থাকার জায়গা নেই – হঠাৎ করে পুরো দেশ যেন থুবড়ে পড়ে গেল। দেশের মনে হয় অর্ধেক লোক না খেয়ে মরে গেল। পথে-ঘাটে মানুষ মরে থাকত – কী ভয়ঙ্কর অবস্থা।

' রুনু খাওয়া বন্ধ করে তার মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তারপর কী হলো আম্মু?’ - 'দেশে তখন বড় বড় দাঙ্গা হলো। সরকার অচল হয়ে পড়ল। ১৫ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ নিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব একটা ব্যাপার। একের পর এক সরকার আসে আর যায়, কেউ দেশকে টেনে নিতে পারে না। চাষাবাদ নেই, কর-কারখানা নেই, স্কুল-কলেজ নেই – কেমন করে দেশ চলবে? তখন মিলিটারিরা এলো শাসন করতে।

তারা এসে দেশের কিছু মন্ত্রী, কিছু বড়লোক, কিছু বিদেশীদের প্রটেকশন দিয়ে পুরো দেশের কথা ভুলে গল। এখন পুরো দেশ চলছে নিজের মত। কোন নিয়মকানুন নেই, কোন আইন নেই। এক একটা এলাকা চালায় এক একটা মাস্তান। এক একটা গডফাদার।

' টুটুল জিজ্ঞেস করল, 'আমরা যখন বড় হব তখন কী হবে আম্মু?’ আম্মার খুব ইচ্ছে করল একটা আশার কথা বলবেন, একটা সাহসের কথা বলবেন, কিন্তু কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। প্রায় ৩০ বছর আগে যখন নতুন সহস্রাব্দ শুরু হলো তখন সারা পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তির একটি জোয়ার এসেছিল। সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও কত আশা আর স্বপ্ন নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে শুরু করল। যখন দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডটা পুরোপুরি ভেঙে গেল, তখন পড়াশুনার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে উঠে গেল। যারা বড়লোক শুধু তারা পড়াশুনা করতে পারে, যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের পড়াশুনার সুযোগও আস্তে আস্তে পুরোপুরি উঠে গেল।

সরকার দেশের মানুষকে খেতে দিতে পারেনা, কেমন করে পড়াশুনা করাবে? শুধু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে লাখ লাখ টাকা দিয়ে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে, পড়াশুনা শেষ করে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। এখন বাংলাদেশে হচ্ছে আশাহীন, ভরসাহীন, স্বপ্নহীন মানুষের দেশ। টুটুল আবার জিজ্ঞেস করল, কী হবে আমাদের আম্মু?’ - ‘ভালো করে পড়াশুনা কর বাবা, হয়তো কোন ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পাবি। হয়তো পড়াশুনা শেষ করে তোমার বাবার মত অন্য কোন দেশে কাজ খুঁজি পাবি। ' টুটুল স্থির চোখে তার আম্মার দিকে তাকিয়ে রইল।

সূর্য ডুবে-যাওয়ার পর সবাই মিলে তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে শুরু করল। জানালা বন্ধ করার আগে আম্মা একবার বাইরে তাকালেন। মানুষজন দ্রুত ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যতদূর দেখা যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। কোথাও একটি গাছ নেই।

সব গাছ কেটে জ্বালিয়ে ফেলা হয়েছে। আম্মা অনেকদিন ঘর থেকে বের হন না, সেদিন শহরের মাঝে গিয়েছিলেন। রাস্তার মোড়ে একটা খবরের কাগজ লাগিয়ে রেখেছে। অনেক মানুষের সঙ্গে আম্মাও সেটি খানিকক্ষণ পড়লেন। সারা বাংলাদেশে নাকি কোথাও কোন গাছ নেই।

সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পুরো দেশ নাকি একটা মরুভূমির মত। আম্মার মনে পড়ল মাত্র ৩০ বছর আগেও এই দেশে কত গাছ ছিল, বর্ষার শুরুতে যখন সব গাছের পাতা ধুয়ে মুছে ঘন সবুজ হয়ে উঠত, তখন দেখতে কী সুন্দর না লাগত! আম্মা একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে জানালা বন্ধ করে দিলেন। একটু পরেই সারা দেশ গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে। অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টুটুল আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কী একটা মনে পরায় উঠে বসল।

সে বলল, 'আম্মু তুমি ঘুমিয়ে গেছো?’ - 'না, বাবা। কী হয়েছে?’ - ‘যে মন্ত্রীরা আমাদের দেশের গ্যাস বিক্রি করে দিয়ে দেশের এরকম অবস্থা করেছে, তাদের ছেলে-মেয়ে ছিল না?’ - 'ছিল। ' - 'তারা এখন কেমন আছে?' আম্মা আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হাসলেন, হেসে বললেন, 'তারা কী এই দেশে আছে নাকি বোকা ছেলে? গ্যাস বিক্রির টাকা নিয়ে তখনই তারা সবাই আমেরিকা চলে গেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা খুব ভালো আছে সেই দেশে। ' এক ধরণের অসহায় আক্রোশ নিয়ে ১২ বছরের একটি কিশোর অন্ধকার ঘরে নিদ্রাহীন চোখে বসে থাকে।

ভোরবেলা সূর্য ওঠার পর এই অন্ধকার কেটে যাবে, কিন্তু তার জীবনের অন্ধকার কী কাটবে কখনো? _________________________________________________ আমার নোট: মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের এই লেখাটি ২৬ ডিসেম্বর ২০০১ সালে 'প্রথম আলো'তে প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্যাস রপ্তানির ভয়াবহ সিধ্যান্তে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করবে তার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছেন তিনি এই লেখায়। ২০০১ সালের মত ১০ বছর পর আবারো বাংলাদেশ একই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি কনকোফিলিপসে সাথে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি ২০১১ অনুযায়ী গ্যাসের মালিকানা ও রপ্তানির সুযোগ প্রদানের কারণে। সবাইকে অনুরোধ করছি, এই নোটের লেখাটি শেয়ার করার জন্য। গ্যাস রপ্তানির এই ভয়াবহতার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখাটি লেখাকের "২০৩০ সালের একদিন ও অন্যান্য" এই শিরোনামে ২০০২ সালে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে শেয়ার করলাম। _____________________________________ Click This Link পোস্ট টি এখান থেকে নেয়া হয়েছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.