মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এনামুল বলেন, তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন।
শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর সময় এবং বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি নিয়ে বক্তব্য রাখায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন তার বাবা।
বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকতা করেন এনামুল। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি।
এনামুল বলেন, অপহরণকারী ওই দলের নেতৃত্বে থাকা দুই ব্যক্তিকে [আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন] তখন চিনতেন না।
পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে অন্যান্য শহীদ পরিবারের সঙ্গে আলাপের সময় শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি ও তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় মাসুদা বানু রত্নার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তারা ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফ।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ২৪ জুন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন হয়।
এরই মধ্যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায়ও এই দুই জনের জড়িত থাকার কথা আদালতকে জানিয়েছেন তাদের সন্তানরা।
আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।
এনামুল হক বলেন, স্বাধীনতার পরে এক এনএসআই কর্মকর্তার সহায়তায় তার বাবাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া মিনিবাসের চালক মফিজউদ্দিনের কাছ থেকে জানতে পারেন, মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের জায়গাটিতে (যা তখন নিচুভূমি ছিলো) নিয়ে আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে ব্রাশফায়ার করে আরো অনেকের সঙ্গে বাবাকে হত্যা করে।
পরে একটি গর্তে লাশগুলো চাপা দেয়া হয়।
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি (আনুমানিক) মফিজউদ্দিনের দেখিয়ে দেয়া জায়গা থেকে আট বুদ্ধিজীবীর গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করেন এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদার, মিরপুর থানার ওসি এবং একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা।
আটটি লাশের মধ্যে তার অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের লাশও ছিল।
বাকি সাতটি লাশ ছিল অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহি, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক কামাল পাশা, অধ্যাপক রাশেদুল হাসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার মর্তুজার।
এনামুল জানান, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারিতে দৈনিক পূর্বদেশে আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের ছবি এবং নিচে তাদের নাম ও ‘এই ঘাতকদের ধরিয়ে দিন’ ক্যাপশন লেখা দেখে তাদের পরিচয় সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হন।
১৪ ডিসেম্বরের পুরো ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাদের বাসার সামনে ইপিআরটিসি’র কাদামাখা বাসটি থেকে পাঁচ-সাতজন লোক নামতে দেখেন।
এর কিছুক্ষণ পরে চার তলায় তাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেলের শব্দ শুনে তার ছোটচাচা সামসুল হক খান দরজা খুলে দেন। এ সময় চাচার পেছন পেছন তিনি নিজেও এসেছিলেন।
দরজা খুলে তিনি দেখতে পান তাদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র ছিল, পরনে ছিল খাকি রংয়ের পোশাক। গায়ে পুলওভার, পায়ে ছিল বাদামী রংয়ের কেডস।
“তাদের মধ্যে দুইজন দুই ফ্ল্যাটের মাঝখানের জায়জায় এসে দাঁড়ালেও বাকিরা সিঁড়িতেই ছিল। যে দুজন উপরে উঠে এসেছিলেন তারা বেশ ‘স্মার্ট’ ছিলেন। ”
“বাসা নিশ্চিত হওয়ার তারা বাবা জানতে চাইলে আমার চাচা অপ্রস্তুত অবস্থায় তাদের জানিয়ে দেন- বাবা নিচে ইসমাইল সাহেবের বাসা গিয়েছেন। তখন তারা চলে যায়। ”
“পরে আমি ও ছোটচাচা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, একদম নিচতলায় ইসমাইল সাহেবের বাসা থেকে বাবাকে বের করে একটি রুমাল দিয়ে তার চোখ বেঁধে ইপিআরটিসি’র সেই মিনিবাসে উঠিয়ে নিয়ে গেল।
কারফিউ থাকায় আবাসিক এলাকার সীমানার মধ্যেই খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন আরো বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ছিলেন।
এনামুল জানান, ১৬ ডিসেম্বর বিকালবেলায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিভিন্ন বধ্যভূমিতে বাবার লাশ খুঁজে ফিরেছেন তিনি।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, “ওইসময় বাবাকে খুঁজতে গিয়ে আমি অগলিত-গলিত-বিকৃত প্রতিটি লাশ নেড়ে দেখেছি। আমার হাতে লাশের গন্ধ লেগে থাকত সবসময়।
কিন্তু আমার সবসময় মনে হতো এটা আমার বাবার লাশের গন্ধ।
“১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদার আমাদের বাসায় ইপিআরটিসি’র ওই কাদামাখা মিনিবাসের চালক মফিজউদ্দিনকে বাসায় নিয়ে আসেন। মফিজের কাছ থেকেই জানতে পরি বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। ”
লাশ উদ্ধার করার পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে অন্য শহীদদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সময় গিয়াসউদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি রত্নার কাছ থেকে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের নাম জানতে পারেন তিনি।
মাসুদা বানু রত্না এ মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী হিসেবে গত ১৫ জুলাই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ওই দুইজনকে আগে থেকেই চিনতেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।
এনামুল হক খানের সাক্ষ্য দেয়া শেষ হলে তাকে জেরা করেন আসামি আশরাফুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী সালমা হাই টুনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।