আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাল্টিন্যাশনাল, সরকারী, বাপ-বেটার চাকুরী---- কোনটা করবেন?

চাকুরীর কথা যদি লিখতে চাই, তবে আগে বাংলাদেশের চাকুরীকে কয়েকটি ক্যাটাগরীতে ভাগ করতে হবে। আমি মোটামোটি ৩টা ভাগে ভাগ করে তাদের সম্পর্কে একটু বিশদভাবে বলার চেষ্টা করবো। ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি) এর মালিকানা থাকে মূলত বিদেশীদের হাতে, দেশের কিছু মানুষের সামান্য পরিমানে শেয়ার থাকতে পারে ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত মালিকানা সরকারের কিংবা কোনো মন্ত্রনালয় কিংবা অধিদপ্তর. ৩।

ব্যক্তি মালিকানাধীন বাপ বেটার কোম্পানী। মালিকই সব। বাপ হবে চেয়ারম্যান/ এমডি। ছেলেরা/মেয়ে/মেয়ের জামাই হলো ডিরেক্টর। এইবার আসুন এই তিন রকমের চাকুরীর নানাবিধ ব্যাপার সেপার নিয়ে একটু আলোচনা করি।

চাকুরীর বিজ্ঞাপন ও নিয়োগ ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি)/ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এরা অনেক সময় খুবই রঙচঙ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। পুরো পত্রিকা জুড়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। অনেকে বলে, এটাও কোম্পানীর একটা পাবলিসিটি। আবার অনেক কোম্পানী নানাবিধ তদবির থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য পোস্ট বক্স ব্যাবহার করে, এবং নিজের নাম পরিচয় উল্লেখ না করেই বিজ্ঞাপন দেয়।

অনেক কোম্পানী অনলাইনে/ওয়েবসাইটে আবেদন গ্রহণ করে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ২-৩ মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। আপনাকে হয়ত একবার রিটেন, ২-৩ বার ভাইভা দিতে হতে পারে। তারপর শারিরীক পরীক্ষায় পাশ করলে নিয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে স্মার্টনেস এবং চটপটে ছেলে এবং রূপসী মেয়েদের এরা বেশি পছন্দ করে।

২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুবই সাদামাটা। আপনি সব দলিল দস্তাবেজ ২ নম্বুরী সিল দিয়ে সত্যায়িত করবেন, সাথে লাগবে পে অর্ডার। তারপর সরকারী ডাকযোগে দরখাস্ত পাঠাতে হবে। তারপর আল্লাহ আল্লাহ করতে হবে রিটেন পরীক্ষার চিঠি আসার জন্য।

এই চিঠি আসতে কখনো কখনো ১ বছরেরও বেশি সময় লাগে। রিটেনে পাশ করলে ভাইভা, রাজনৈতিক পরিচয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন এই সব শেষ করে তারপর চাকুরী পাবেন। ৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন নামেরই বাপবেটার অফিস, এরা খুব ছোট করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। আমি এপ্লাই করার অল্প কয়কদিনের মধ্যেই ফোন করবে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য।

ইন্টারভিউতে বাপ কিংবা তার অতি চালাক ছেলে যদি আপনাকে গাধার সমকক্ষ মনে করে, তবে আপনার চাকুরী কনফার্ম। পরের দিনেই জয়েন করতে পারবেন। অফিসের পরিবেশ ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি) / গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ খুবই সুন্দর, একটু পর পর ফুলেট টব লাগানো থাকে, সব রুমে এসি লাগানো থাকে। চাকুরিজীবিরা সবাই টাই টুই পরে ফিটফাট হয়ে এসির হাওয়া খেতে খেতে অফিস করে।

টয়লেটও খুব সুন্দর। সকাল ৯-টা থেকে বিকাল ৫টা-৬টা পর্যন্ত অফিস, সেটা ও ফ্রেক্সিবল। প্রায় সব অফিস নিজেদের গাড়ি দিয়ে আনা নেওয়া করে। চা, কপি আনলিমিটেড, দুপুরে লাঞ্চও পাবেন। সপ্তাহে ২ দিন ছুটি পাবেন।

সকাল বিকাল ২-১টা ফুরিনার দেখবেন। ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত এসির বাতাশ তখনই পাবেন, যখন আপনার অফিসের সবচেয়ে বড় সাহেব আপনাকে সালাম দেয়, মানে বড় সাহেবের অফিসে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়া পাবেন। কাপড়চোপড় মোটামোটি পড়লেই হলো। টাই পড়ার দরকার পড়ে না।

সরকারী কর্মকর্তা হলে মাইক্রোবাস, কর্মচারী হলে লক্কর যক্কর মার্কা মুড়ির টিন দিয়ে আসা যাওয়া করতে পারেন। বড় কর্মকর্তা না হলে গরম পানিও পাবেন না, লাঞ্চ তো দুরের কথা। সপ্তাহে ২ দিন ছুটি পাবেন। তবে বৃহস্পতিবার বিকালের আগে বের হয়ে যেতে পারবেন, রবিবার দেরীতে অফিসে আসতে পারবেন। ৩।

ব্যক্তি মালিকানাধীন বসের মর্জি বুঝে কাপড় পড়তে হবে। নিজের খরচে বাসে ঝুলে ঝুলে আসা যাওয়া করতে হবে। বাসা থেকে খাওয়া নিয়ে যেতে হবে। বস যদি চায়, তবে শুক্রবার একদিন ছুটি পাবেন, আর ঈদের সময় ছুটিতো আছেই। বেতন, বোনাস ও ইনক্রিমেন্ট ১।

মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি)/ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ মোটামোটি ভালো অংকের (৩০,০০০-৬০,০০০) টাকা পাবেন প্রত্যেক মাসে। মাস শেষ হয়ে যাওয়ার ৩-৪ দিন আগেই কোনো একটা বিদেশী ব্যাংকের একাউন্টে (আপনার সেলারী একাউন্ট) আপনার বেতন জমা হয়ে যাবে। অফিস একটা মেইল দিয়ে জানিয়ে দিবে। অফিস থেকে ভালো ব্যালেন্স সহ মোবাইল পাবেন। ২-১ মাস পর পরই আপনি বোনাস পাবেন, কেন পাচ্ছেন, নিজেও বুঝতে পারবেন না।

বছরে বেতন বাড়ে ৫০০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫,০০০-৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত। ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত বেতনটা ঠিকমতো পাবেন (১২,০০০-১৮,০০০)। সোনালী কিংবা জনতা ব্যাংকে আপনার বেতন জমা হবে। বেতন পাবো কিনা, এই চিন্তা করতে হয় না।

২ ঈদে খালি ২টা বোনাস, বছরে ইনক্রিমেন্ট ২৩০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। ৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন বেতনের রেঞ্জ ৮,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত, ব্যতিক্রমও আছে। বসের মর্জির উপর বেতন নির্ভরশীল, কখনো মাসের ২ তারিখ, কখনো ৭ তারিখে, কখনো ১০-১৫ তারিখে পাবেন পূর্ববর্তী মাসের বেতন। বেতন নিতে হবে অফিসের ক্যাশিয়ার থেকে, ক্যাশ।

ইনক্রিমেটের কথা চিন্তা করা মহা পাপ। বস দয়ার সাগর, তাই হয়ত ঈদের বোনাস পেতেও পারেন। কলিগদের আলোচনার রকমফের ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি)/ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রায়ই নানা উপলক্ষে বিভিন্ন হোটেলে পার্টি হয়, সেটা নিয়ে পরের এক সপ্তাহ আলোচনা চলে। নেক্সট পার্টি কবে হবে, কার গেটআপ কেমন ছিলো, নেক্সট ফরেন ট্রিপে কে কে যাচ্ছে, কোন মহিলা কলিগ দেমাগী বেশি, কোন বসের বউ সুন্দর এই জাতীয় আলোচনা।

এছাড়াও আছে গ্রুপিং। ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত কোন জিএম কি বলেছে, প্রমোশনটা কার মামলার কারনে আটকে গেলো, কে উপরী ইনকাম করছে, শেয়ার বাজারে কত টাকা লস হলো এইসব। ৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যক্তিগত আলোচনার সুযোগই নাই, তারপরও যদি ছিটেফোটা সময় পাওয়া যায়, তখন জালিম বসের ১৪ গুষ্ঠিকে জামাত সহকারে সবাই গালি দেয়।

ফরেন ট্রিপ ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি)/ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ বছরে অন্তত একবার ট্রিপ পাবেনই , নিদেন পক্ষে ২ বছরে একবার। বেশিরভাগ ট্রিপ হয় ব্যংকক, সিঙাপুর, দুবাই, ভারত, চায়না এই সব জায়গাতে। ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত ট্রিপ আশা করাটা বোকামী, তারপরও কোনো প্রজেক্টে কাজ করলে এবং যদি বসকে প্রচুর তেল দিয়ে বসের সুনজরে থাকতে পারেন, তবে ট্রিপ পেতে পারেন।

৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন অফিসের কাজে ট্রিপ পেতেই পারেন, তবে সেটা সিঙাপুর নয়, শেরপুরে, বরিশালে। নানা সময়ে ঢাকার বাইরে যেতে হতে পারে। চাকুরীর নিশ্চয়তা ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি) / গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ তিন মাস, মানে যদি চাকুরী চলে যায়, আপনাকে তিনমাসের বেতনের সমপরিমাণ (কমবেশিও হতে পারে) বেতন দিয়ে গুডবাই বলে দিতে পারে।

পেনশনের ব্যপার সেপার নাই। অফিস চাইলে যে কোনো মূহুর্তে ছাটাই হতে পারেন। ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত গুরুতর কোনো অপরাধা ফেসে না গেলে সহজে চাকুরী যায় না। পেনশন পাবেন।

৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রত্যেকদিন সকালে অফিসে গিয়ে খোজ নিতে হয়, চাকুরীটা আছে কিনা? পেনশনের কথা মুখে আনাও পাপ। সামাজিক অবস্হান ১। মাল্টিন্যাশনাল/ জয়েন্ট ভেনচার (এমএনসি/জেভি) / গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ বিয়ের বাজারে আপনার কাটতি ভালো হবে। সকালে চাকুরীতে জয়েন করলে বিকালেই বিবাহের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।

ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারবেন। চাকুরীতে ঢুকার ২ বছরের মাথায় গাড়ি কিনতে পারবেন অনায়াসে, ৫ বছরের মাথায় ফ্ল্যাটে উঠতে পারবেন। সবাই আপনাকে টাকাওয়ালা হিসাবেই চিনবে। সপ্তাহান্তে বউ , শালিকাদের নিয়ে শপিং আর পিজ্জা খেতে গায়ে লাগবে না। বউকে তিন মাস পর পর গয়না কিনে দিতে পারবেন।

বউ খুশিত ডগমগ হয়ে থাকবে সবসময় । ২। সরকারী/ আধাসরকারী / স্বায়ত্বশাসিত যদি ঘুষ না খান, তবে নিদেন পক্ষে এখটা প্রমোশন না পেলে বিয়ের চিন্তা মাথায় আনা যাবে না। সাদামাটা ধরনের একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারবেন। ভাড়া বাসায় আজীবন কাটাতে হবে।

৩। ব্যক্তি মালিকানাধীন যদি কোনো মেয়ের বাবা সেচ্ছায় তার কন্যাকে আপনার সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়, তবেই আপনার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব। আপনি কোন অফিসে কাজ করেন? আরো লিখার ইচ্ছে ছিলো, মনে আসলে পরে যোগ করে দিবো। ধন্যবাদ। ব্লগার এস বাসারের মতামত থেকে সংশোধনী: এর বাইরে আরো একটা ক্যাটাগরী আছে, যেটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি, সেটা হলো, অমুক গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ, তমুক কনসোর্টিয়াম এই রকম অফিস গুলো।

যারা মোটামোটি ভালো স্যালারী দেয় এবং মাল্টিন্যাশনালের মতো আবহ তৈরীর চেষ্টা করে। তারপরও তাদেরকে আমার বাপ বেটার অফিসই মনে হয়। মালিকের ইচ্ছাতেই অফিস চলে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.