আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটা নিটোল প্রেমের গল্প: শর্মির বাসা আমাদের বাসার পশ্চিম দিকে

আমরা চার বন্ধু একসাথেই শর্মির প্রেমে পড়েছিলাম। ঘটনা সেটা না। ঘটনা হল আমরা যে চার জন শর্মির প্রেমে পাগলপারা ছিলাম তাদের কেউই কিছুতেই ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। অথচ গোমুর্খ থেকে শুরু করে অতি বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলো কি সহজেই না এমন উদ্ভট একটি ব্যাপারকে সত্য বলে বিশ্বাস করছিল! হুট করে দেশের সবগুলো পত্রপত্রিকায়, রেডিও-টিভিতে খবর প্রচার করল পরদিন থেকে নাকি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে। এবং নিয়মিতভাবে তাই ঘটতে থাকবে।

কি এক নাম না জানা বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট মুগলাই নাকি বিরাট এক যুক্তি দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন ব্যাপারটা। যখন পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদটা দেখলাম তখন আমিও চোখ বুজে বিশ্বাস করেছিলাম কথাটা। কতো আজগুবি ঘটনাই তো পৃথিবীতে ঘটে। একসময় মানুষ জানতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের সেই জানাটাও ভুল প্রমাণিত হল।

সূর্যের পশ্চিমে উঠার ব্যাপারটাও হয়তোবা বিজ্ঞানের সেরকম কোন উন্নয়নের ফল। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনকার অভ্যাস বশত: শর্মিদের বাসার দিকে তাকালাম। আমাদের ব্যালকনি থেকে শর্মিদের বাসার দোতলার ব্যালকনিটা দেখা যায়। কালেভদ্রে ভাগ্য অতিশয় ভাল হলে ব্যালকনিটার সাথে সাথে শর্মিকেও দেখা যায়। আজ আমার ভাগ্যটা যে খারাপ এটা বুঝতে সময় লাগল না।

শর্মি নেই। তবে সূর্যটা ঠিকই তার আগের জায়গাতেই আছে। কি ব্যাপার? সূর্য তো প্রতিদিনকার মতো ওখানে থাকার কথা ছিল না। পত্রিকার কথা যদি ঠিক থাকে তবে শর্মিদের বাসার উপর যেখানটাতে আমি সবসময় সূর্যটাকে দেখতে পাই সেখানে সূর্যটি থাকবে না। সূর্য থাকবে তার ঠিক উল্টোদিকে।

তাহলে তো পত্রিকার কথা ভুল! চুলায় যাক সব পত্রিকা। ব্যালকনি থেকে নিচে নামলাম। দেখি মজিদ চাচা দাঁত ব্রাশ করতে করতে রাস্তায় হাটছেন। মজিদ চাচা রিটায়ার্ড মানুষ। প্রতিদিন সকালবেলা এভাবেই তিনি হাটতে বের হন।

আমাকে দেখে থামলেন। ও ভাতিজা, দেখসো? সূর্য কিনা আজ পশ্চিমে উঠল! বিজ্ঞানের কি কারিশমা, তাই না? দিনে দিনে আরো কত কিছু বের করবে বিজ্ঞান! কী যে বলে চাচা! চাচা কি অন্ধ হয়ে গেল নাকি। বললাম, কই চাচা, সূর্য তো ঠিক আগের মতো পূর্ব দিকেই উঠসে। এটা কী বললে ভাতিজা। তুমি কানা অই গেছনি? সূর্যতো আইজ পশ্চিমে উঠসে।

চাচা রেগে গেলে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তবু সাহস করেই বললাম, চাচা, আমি কানা হইনি। কানা হইছেন আপনে। ঐ দেখেন শর্মিদের বাসা। আর তার ঠিক উপরেই সূর্য।

আগেও সূর্য এভাবেই ঐদিকেই উঠতো! চাচা শর্মিদের বাসার দিকে তাকালেন। সূর্যের দিকে তাকালেন না। বললেন, শর্মি! শর্মির লগে তোমার কিতা বা? সারছে! চাচা দেখি অন্যদিকে কথা ঘুরায়। চটজলদি কেটে পড়তে হবে এখান থেকে। বুড়ো মানুষদের সাথে কথা বলার এই হচ্ছে ঝামেলা।

কথায় কথায় সন্দেহ। কিছু না। যাই চাচা। বলে সালাম দিয়ে সরে পড়লাম ওখান থেকে। স্কুলে গিয়েও একই ঘটনা।

পাশের রুমে মনে হয় ছোটদের ক্লাস চলছিল। শুনতে পেলাম, ম্যাডাম কাউকে জিজ্ঞেস করছেন, বলতো দেখি, সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয় বাক্যটার ইংরেজী কি হবে। আশ্চর্য! আমাদের শিক্ষকরাও যদি ভুল করে তাহলে এ দেশের তো বারোটা বেজে যাবে। না এ কিছুতেই মানা যায় না। আমাদের ক্লাসে তখন টিচার ছিলেন না।

তাই পাশের রুমে গিয়ে ম্যাডামকে ডেকে ঘটনাটা যে পত্রপত্রিকায় মিথ্যা লিখেছে সেটা বুঝানোর চেষ্টা করলাম। ওমা! ‘সব ফাঁকিবাজের দল এ স্কুলে পড়তে এসেছে। যাও। নিজের ক্লাসে যাও। নয়তো হেড স্যারের কাছে নালিশ দেব।

’ ম্যাডামের ধমক বা আল্টিমেটাম শুনে আমাকে তড়িঘড়ি ক্লাস টেইনের রুমটাতে ফিরে আসতে হল। দুপুরে আকাশ মেঘে ঢাকা, বৃষ্টি হবে হবে ভাব। মসজিদে নামাযে গিয়ে দেখি ধুন্দুমার অবস্থা! নামায শুরু হবে। হঠাৎ একজন প্রস্তাব করল, আজ থেকে পশ্চিম দিক পাল্টে গেছে। নামাযের দিকটাও পাল্টানো উচিত।

সবাই তার কথায় সায় দিয়ে উল্টোমুখি হচ্ছে। আমি প্রতিবাদ করলাম। বললাম, পত্রিকায় ভুল লিখেছে, আজ আমি নিজ চোখে দেখেছি সূর্য একই দিকে উঠেছে। আমাদের আগের মতো করেই নামায পড়া উচিত। সবাই সাথে সাথে হেই হেই করে উঠল।

এক মুরুববী বলে উঠলেন, সবগুলা পত্রিকায় খবরটা লিখেছে। আজ টিভিতেও বলল, সূর্য তার দিক পরিবর্তন করেছে, আর তুমি কিনা উল্টা কথা বলছ? তাদের উত্তেজিত কথা শুনে আমি বাইরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। উদ্দেশ্য আমার কথার সপক্ষে হাতেনাতে প্রমান দেব। নাহ! মেঘে ঢাকা আকাশে সূর্য না পেয়ে হতাশ হলাম কিছুটা। তবু বলে উঠলাম, মানলাম সূর্য তার দিক পরিবর্তন করেছে কিন্তু কাবা শরীফ তো তার ঠিক জায়গাতেই আছে।

আর আমাদের তো নামায কাবার দিকে মুখ করে পড়ার কথা। মুরুববী বললেন, তার মানে তুমি বলছ, পূর্ব দিকে মুখ করে নামায পড়ব আমরা? মুরুববীর কথা শুনে সবাই একসাথে নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ বলে উঠল। আমি হা করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, এ বিষয়ে আলেম সমাজ থেকে নতুন কোন সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা পশ্চিম দিকে মুখ করেই নামায পড়ব। বুঝলাম এখানে কথা বলে কোন ফায়দা হবে না, মিডিয়া সবার মাথা অলরেডী খেয়ে ফেলেছে।

নামায না পড়েই বের হয়ে আসলাম। গোটা দেশের সব মানুষ এভাবে একসাথে অন্ধ হয়ে যাবে, এ আমি কিছুতেই মানতে পারলাম না। বিকালে শর্মির বাকি তিন প্রেমিকের সাথে দেখা হল যখন, তখন তাদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলাম। দেখলাম তারাও আমার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সারাদিন। আসলে আমরা যারা যারা শর্মি প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তারা শর্মির বাসার অবস্থান যতোটা ভাল করে জানি, সূর্যের অবস্থানও জানি ঠিক ততোটা।

সকালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শর্মির বাসার দিকে তাকালেই সূর্যমামাটাকে আগে দেখতে পাই, আবার সন্ধ্যায় শর্মির বাসার সামনে থেকে ফেরার সময় অস্তগামী সূর্যটা থাকে আমাদের চোখের ঠিক সামনে। তাই পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়া আমাদের বিশ্বাস করাতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিদঘুটে বৈজ্ঞানিক মতামত। এবারে আসি আমাদের চার বন্ধুর প্রেমের কাহিনীতে। শর্মি আমাদের পাশের স্কুলেই ক্লাস নাইনের ছাত্রী। তাই ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছি।

তবে আমাদের কার মনে কখন শর্মিপ্রেম ঢুকে যায় তার কোন হদিস আমরা আসলেই জানি না। এটুকু কেবল বলতে পারি, ক্লাস টেনে উঠার পর যখন আমরা আবিষ্কার করি আমাদের চারজনের ব্যাক্তিগত আড্ডার টপিক হিসেবে শর্মি প্রায়ই জায়গা করে নিচ্ছে, যখন দেখি প্রতিদিন নিয়ম করে এক বেলা তার বাসার সমনে দিয়ে ঘুরে না আসলে আমাদের কারো পেটের ভাত হজম হয় না, তখন আমরা চারজনই টের পাই আমরা প্রত্যেকেই সমানভাবে শর্মিকে ভালবেসে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা এতোটাই প্রগাড় ছিল যে এ ঘটনা জানার পরও আমরা কেউ কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবিনি। আমরা এক সাথে বসে শর্মির সৌন্দর্যের ব্যবচ্ছেদ করি, তাকে দূর থেকে দেখতে পেলে একসাথে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই, তার সামনে দিয়ে একসাথে ঘুরাঘুরি করি তার সাথে একটুখানি কথা বলার লোভে। এভাবেই চলছে আমাদের।

আমরা এই শর্ত একবাক্যে মেনে নিয়েছি যে, আমাদের মধ্য থেকে যাকে পছন্দ করবে, শর্মি তারই হবে। সেই থেকে আমরা প্রত্যেকেই আশায় আছি। তো, সূর্যমামাকে নিয়ে এই চরম আপত্তিকর ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে বলতে একসময় পৌছে গেলাম শর্মিদের বাসার সামনে। কী ভাগ্য, কী ভাগ্য! শর্মি তার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে! এরকম সুযোগ খুব কমই আসে আমাদের জীবনে। তাই এ ঘটনাকে স্মরনীয় করে রাখতে আমরা একসাথে চেঁচানো শুরু করলাম।

হাই শর্মি। হাই গাইজ। কি করো? জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিছু না। সূর্য দেখি।

বলতো সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে? আমি সবার আগে বলে উঠলাম, আমি জানি শর্মি। আমি ব্যাপারটা জানি। আমি পত্রিকাওলাদের সব ধান্দাবাজি ধরে ফেলেছি। তারা আমাদের ঘোল খাওয়াতে চাচ্ছে। সূর্য় আগের মতোই পূর্ব দিকে উঠেছে।

সত্যি কথাটা সবার আগে বলে শর্মির বাহবা নিতে চাইলাম। ছাই উঠেছে! ছাই উঠেছে! শর্মির কথাটা শুনে আমরা চার জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। সে আবার বলল, ঐ দেখ, সূর্য পূর্ব দিকে অস্ত যাচ্ছে! গাধার দলেরা! পত্রিকা অবিশ্বাস করে! বলেই শর্মি ভেতরে ঢুকে গেল। এই রে! শর্মি তো ভেতরে চলে গেল! রাকিব আমাকে ধাক্কা দিয়ে কথাটা বলল। কী দরকার ছিল এটা বলার? তুই না খুব বেশি বেশি পন্ডিতি করিস।

কথাটি বলে সায়েম হেটে হেটে চলে গেল আমদের ফেলে। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সফিক বলল, তোর সাথে আমাদের কারো কোন কথা নাই। কথা থাকতে পারে না। আমরা আর তোর কথা বিশ্বাস করি না।

সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে। চিৎকার দিয়ে তিনবার কথাটা বলল সফিক। সায়েম ততোক্ষণ অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, তবু কথাটা শুনতে পেল।

সেও দেখি চেঁচিয়ে বলে উঠল, সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে..ঠে..ছে..। তুই শালা গাধা। আমাকে গালি দিয় সফিক আর রাকিবও চলে গেল। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আজ কতোদিন পর শর্মির সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম।

আমার জন্যই সুযোগটা মিস হয়ে গেল। শর্মিকে আমাদের সাথে ভালভাবে কথা বলতে এর আগে কখনো দেখিনি আমরা। মন খারাপ করে বাসায় পৌছালাম। রাতে পড়তে বসে আমার গল্প লেখার খাতাটা হাতে নিলাম। শর্মিকে নিয়ে একটা গল্প লিখব ভেবেছিলাম।

গল্পের নামটা লিখে রেখেছিলাম। ‘শর্মির বাসা আমাদের বাসার পূর্ব দিকে। ’ নামটি কেটে দিয়ে নতুন করে লিখলাম, ‘শর্মির বাসা আমাদের বাসার পশ্চিম দিকে। ’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.