একটু আগে এক বন্ধুবরের কমেন্টে জানতে পারলাম শাফিন আহমেদ পারমানেন্টলি ইউ.এস.এ-তে শিফট্ করেছেন। তথ্যটি যাচাই করার সুযোগ পাইনি বা যাচাই করিনি। সত্য হতে পারেও আবার মিথ্যেও হতে পারে। যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে ব্যাপারটা আমাদের জন্য দুঃখজনক ও লজ্জার!
কয়েকযুগ ধরে তিলে তিলে গড়া সঙ্গীতাঙ্গনে অনেকেরই হয়ত চাওয়া পাওয়া ফুরিয়ে গিয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার এবং হতাশার।
উনাদের জন্য যে স্থান তৈরী থাকার কথা ছিল তাতো নেই-ই বরং উলটো অনেকেরই স্ট্যাটাস নিয়ে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আমাদের গুণী শিল্পীদের মূল্যায়ন করতে পারিনি।
আমাদের মিডিয়া-ই আমাদের শত্রু। সবচেয়ে বড় কালপ্রিট। তারা পড়শীকে সুপারস্টার বানায়।
আরেফিন রুমী - হৃদয় খানের মত হাবিজাবি শিল্পীকে মিড়িয়ার ভাড়াটে শিল্পী বানিয়ে চারিদিক সয়লাব করে তুলে! উপস্থাপনা করে কিছু গন্ডমূর্খের দল। যাদের মিউজিক সেন্সতো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে কাকে কিভাবে ট্রিট করতে হয়, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা-ই জানেনা।
আর আমাদের গুণী- শিল্পীদের জন্যও ধিক্কার। নিজের মনের বিরুদ্ধে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেনেও বিচারকের আসীনে বসে থেকে ট্যালেন্ট হান্ট করে আমরা কী বের করতে পেরেছি? ভাইকিংস-কে পেয়েছিলাম হারিয়ে গেলো। সপ্তক পেয়েছিলাম, হারিয়ে গেলো।
সাবকনসাস পেয়েছিলাম, হারিয়ে গেলো। পূর্ব পশ্চিমের মত ব্যান্ড পেয়েছিলাম, তাও হারিয়ে গেলো। আতাহার টিটো, সানবীম, আরিফ সবাই হারিয়ে গেলো . . . কেন গেল?
ক্লোজআপ-ওয়ান ---- গাও বাংলাদেশ গাও। নোলক, বিউটির মত ক্ষ্যাত-মেরিটলেস পাবলিকদের ধরে এনে জোড় করে শিল্পী বানালাম। সালমাকে শিল্পী বানালাম।
ইভা রহমান হয়ে উঠেন বিখ্যাত গায়িকা। এবি দ্যা বস --- ইভা রহমানের অ্যালবাম করেন! কী আজব এই দেশ! কী হাস্যকর এদের কান্ডকারখানা!
রিক্সা চালক আকবর এখানে শিল্পী হয়ে যায়। পড়শী এখানে বিখ্যাত গায়িকা হয়ে উঠে। ক্ষুদে গানরাজ প্রতিযোগীতার আড়ালে চলে ব্যবসার ধান্ধা। তিন চাকা নাকি দশ চাকার পরিশ্রমী মানুষগুলোকেও আমরা জোর করে শিল্পী বানাই।
গায়িকা কণা কয়েক লক্ষ টাকায় মিউজিক ভিডিও বানায়। কিভাবে যেন একদিন একটা মিউজিক ভিডিও আমার সামনে এসে পড়ে। লক্ষ টাকার ভিডিও বলেই দেখার স্বাদ হলো। হায় হায় . . . শারীরিক কী এক অঙ্গভঙ্গি! কাদের জন্য এই মিউজিক ভিডিও? কোন শ্রেণীর দর্শকদের জন্য বানানো হয়েছে এই ভিডিও আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়।
কিছু দিন আগে 'বাংলাদেশী আইডল'-এর একটা ইপিসোডের একটা অংশ দেখলাম।
অনন্ত জলিল ও বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অনন্ত ভাই গীটার হাতে নিয়ে যা দেখালো, তাতে মনে হলো এমন টাইপের বাংলাদেশী আইডলই খোজা হচ্ছে! বিচারক সারিতে এবি দ্যা বস, ফেরদোসী রহমান, এন্ড্রু কিশোর। আর এদের পাশে শিল্পী মেহরীন(!!!) বিচারকের আসনে সমাসীন! এবি দ্যা বস অনন্ত জলিলের নাচা, গীটার বাদ্য বাজনা ও ফ্রী নাচ দেখতে দেখতে বিরক্ত মুখে বসে আছেন দেখে মায়া লাগলো। কিছুই বলার নেই।
অনন্ত গাইলেন 'হোয়াট এজ লাভ, হোয়াট ইজ লাভ' . . . .! উপস্থাপিকা এসে হাততালি দিলেন।
উপস্থিত বিচারক মণ্ডলীরাও হাত তালি হাত তালি বাউন্ডারি বাউন্ডারি আর ছক্কা ছক্কা বলে বাহবা দিলেন। রুচিবোধ, সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা, মেধা ও মননশীলতা বলে কিছু ব্যাপার আছে। শিল্পের মাঝেই এই শব্দগুলোর গূঢ়ার্থ কিংবা মহাত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। উপলব্ধি করা যায়। এখন আমরা শুধু শিল্পীর তোষামুদি করি - - - আর ঐ দিকে অবহেলায় পড়ে থাকে শিল্পীর প্রাণ বা শিল্প।
কিসের পেছনে ছুটছি আমরা? দীর্ঘ ৪০ বছর পরেও কী আমরা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গীত বাংলাদেশ থেকে সৃষ্টি করতে পারছি? এটা সত্য যে, এখন না পারলেও অতীতে পেরেছি। বিশ্ব সঙ্গীতের ছায়া আমি দেখেছি এই বাংলার ব্যান্ড সঙ্গীতে। সেও এখন এক অতিত। আমাদের জ্বালাময়ী স্মৃতি! স্মৃতির দেয়াল!
এবি, ফোয়াদ নাসের বাবু, মাকসুদুল হক, লাবু রহমান, নকীব খান, লাকী আখন্দ, আশিকুজ্জামান টুলু, লতিফুল ইসলাম শিবলী, পিয়ারু খান, পিলু খান, হামিন আহমেদ, শাফিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, প্রিন্স মাহমুদ, তরুণ মুন্সী, আসিফ ইকবাল, কাওসার আহমেদ চৌধুরী, কমল, টিপু, চন্দন, পার্থ বড়ুয়া, শহিদ মাহমুদ জঙ্গি (সহ নতুন, পুরাতন আরো অনেকেই যাদের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছেনা) ---- উনাদের মত জ্ঞানীগুণী মিউজিশিয়ান থাকতেও আমাদের সঙ্গীতাঙ্গন আজ অস্থিরতায় ভুগছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন?
কেন! এই প্রশ্নের উত্তর আমার মত নাদান মানুষের কাছ থেকে এলে সেটা গ্রহণযোগ্যতা পাবেনা।
শুধু বলি, আপনাদেরকে সংঘবদ্ধ ভাবে নতুন প্রজন্মের জন্য চিন্তা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মাঝেই আপনারা আলোকিত হবেন স্ব-স্ব-মহিমায়! আলোকিত একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়েছিল আরেকটি আলোকিত অধ্যায়ের জন্যই।
আমরা সেই আলোকিত অধ্যায়ের জন্যই অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষায় ছিলাম . . . অপেক্ষায় থাকবো! কিন্তু কথা হলো, আর কতদিন সেই আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে?
আধুনিক কিংবা বিকল্পধারার ভারতীয় সঙ্গীত আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই খবর বোধকরি আপনারা রাখেন না।
আপনারা বিশ্বাস করেন আর না-ই করেন, বাংলাদেশি নতুন শ্রোতাদের একটি অংশ এখন আপনাদের গান রেখে কলকাতার সুমন, অঞ্জন, নচিকেতার অনুজ ফসিলস্ কিংবা রুপম, মাহীনের ঘোড়াগুলি, অনুপম রায় সহ বেশ কিছু মিউজিশিয়ানদের খোঁজ নিয়মিত রাখেন, যেখানে আপনাদের স্থান থাকার কথা ছিল সেই জায়গাটুকু দখল করে নিচ্ছে কলকাতা। কারণটাও স্পষ্ট, কলকাতার চলচ্চিত্রে কিংবা অ্যালবামে যে ধারার গান হয়, কথা ও সুরে বিষয়ভিত্তিক যে বৈচিত্র্যতা খুঁজে পাওয়া যায় তা বোধকরি সহজেই ভালো লাগার মত।
গত পাচ-ছ' বছরের একটা খসড়া করা যেতে পারে। এল.আর.বি - - - ২০০৫ এর পরে গত আট বছরে এল.আর.বি-র প্রকাশ করেছে স্পর্শ ও যুদ্ধ নামে দুটি অ্যালবাম। অতীতের অ্যালবামগুলোর মত এই অ্যালবামগুলো হৃদয়ে দাগ কেটে যেতে পারেনি খুব একটা।
মাইলস - - - সর্বশেষ অ্যালবাম বের করেছিল ২০০৬ সালে। এরপর প্রতিচ্ছবি নামে একটি অ্যালবাম তৈরী করে রাখলেও তা সিডি আকারে আজও আলোর মুখ দেখেনি। রেনেসা - - - ২০০৪ সালে প্রকাশ করেছিল ব্যান্ডের চতুর্থ অ্যালবাম 'একুশ শতকে রেনেসাঁ'। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ হতে চললো - - - কোন অ্যালবাম নেই ব্যান্ডটির। ফিডব্যাক - - - ০২ এর পরেও এই ব্যান্ডের কোন অ্যালবাম এসেছে কিনা আমার জানা নেই।
মাকসুদ ও ঢাকা - - - ১৯৯৯ প্রকাশ পেয়েছিল এই ব্যান্ডটির লাস্ট অ্যালবাম, ফার্স্ট এভার জ্যাজ-রক-ফিউশন ইন বাংলাদেশ। অনেক প্রত্যাশা ও সম্ভবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল এই অ্যালবামের মধ্য দিয়ে। হায় . . . মাকসুদ ও ঢাকা ১ যুগেরও বেশী সময় ধরে অনুপস্থিত। শুধু সোলস্ আর ওয়ারফেজই - - - নিয়মিতই অ্যালবাম প্রকাশ করে যাচ্ছে।
ওয়ারফেজ --- পথ চলা (সেলেকটেড সং) এর পর মৌলিক অ্যালবাম 'সত্য' নামে অ্যালবাম প্রকাশ করে।
যদিও আমি শুনে দেখিনি অ্যালবামটি আজও। লোকমুখে দুই রকমের কথাই শুনতে পেয়েছি ওয়ারফেইজের ভক্তদের কাছে। কারও ভালো লেগেছে, কারও লাগেনি। যা ওয়ারফেজেই অতীতের অ্যালবাম সম্পর্কে এমন মন্তব্য খুব একটা ছিল না।
চাইম --- নেই! হারিয়ে গেছে! ২০০২ সালের দিকে আশিকুর রহমান সান্টুকে নিয়ে 'জন্ম' নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল।
তারপর প্রথম অ্যালবামের কিছু গান সাথে আরও কিছু মৌলিক গান নিয়ে বের করে কীর্তনখোলা, তাও প্রায় এক যুগের কাছাকাছি। অবস্কিওর --- নিয়মিতই অ্যালবাম করছে। তবে 'ফেরা' অ্যালবামের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থেই ফিরেছেন। এর আগের অ্যালবাম 'অপেক্ষায় থেকো' --- অবস্কিওর নামের সাথে যায় নি খুব একটা। উইনিং ---- আমরা যে এই ব্যান্ডের নাম আজও ভুলে যাইনি এ-ই আমাদের সৌভাগ্য।
আর্ক - - - হাসান আর পঞ্চম ছেড়ে চলে যাবার পর ২০০২/২০০৩ সালের দিকে মুন নামের এক শিল্পীকে নিয়ে আশিকুজ্জামান টুলু বের করেন 'হারানো মাঝি'। সত্যি বলতে কী এটা দারুণ একটা অ্যালবাম। তবে কোনো মানদন্ডেই আর্কের সাথে যায় না। কোন ভাবেই নয়। ফিলিংস হারিয়ে গেছে ১৯৯৯-এ।
রয়ে গেল নগর বাউল আর জেমস! বলার মত কিছুই নেই নগর বাউলের! দুষ্টু ছেলের দল! নাম মাত্র একটা অ্যালবাম। আর জেমস্ --- দেশে এখন পোষায় না!!!
নোভা - - - রাজাকারের তালিকা চাই, আহ্বান, স্কুল পলাতক মেয়ে, ভাইসো অ্যালবামগুলো যাদের হাতে তৈরী তারাও নেই। প্রমিথিউস --- দুর্দান্ত এই ব্যান্ডটি দুষ্টু রাখালের মতই দুষ্টুমি করে সঙ্গীতাঙ্গনকে কুলষিত করেছে। মেইনস্ট্রীম ব্যান্ডের অনেকের কথাই আর তুলে আনলাম না আলাদা করে। দীর্ঘ ১ যুগের চিত্র এটি! কী ভয়ানক একটি ব্যাপার।
আর ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম - - - সেতো এন্ডেমিক শব্দের মতই লাগে।
লাকী আখন্দ নেই, কাওসার আহমেদ চৌধুরী নেই, . . . না! উনারা হারিয়ে যাননি। আপনার আমার শহরেই নিভৃতে পড়ে আছেন। খোঁজ নেবার কেউ নেই।
একটা মিউজিক ইসস্টিটিউট হতে পারতো সরকারী কিংবা বেসরকারী অর্থায়নে।
এবি, ফোয়াদ নাসের বাবু, মাকসুদুল হক, লাবু রহমান, নকীব খান, লাকী আখন্দ, আশিকুজ্জামান টুলু, লতিফুল ইসলাম শিবলী, পিয়ারু খান, পিলু খান, হামিন আহমেদ, শাফিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, প্রিন্স মাহমুদ, তরুণ মুন্সী, আসিফ ইকবাল, কাওসার আহমেদ চৌধুরী, কমল, টিপু, চন্দন, পার্থ বড়ুয়া, শহিদ মাহমুদ জঙ্গি - সহ আরও অনেক জ্ঞানী গুণী শিল্পীদের দিয়ে মিউজিকে প্রাতিষ্ঠানিক তালিম দেবার ব্যবস্থা হতে পারতো। সঙ্গীতের একটা আর্কাইভ হতে পারতো। বাংলা সঙ্গীতের একটা রিসার্চ সেন্টার হতে পারতো।
কিছুই হয়নি। দেশটা চোর বাটপারে ছেয়ে গেছে।
এটাই আমাদের প্রাপ্তি!
বি.দ্রঃ বেশ কয়েকমাস আগে লিখেছিলাম। ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে শেয়ার করেছিলাম চারপাশের মানুষগুলোর সাথে। সচলায়তন আমার প্রিয়ব্লগ। ভাবলাম প্রিয় মানুষগুলোর সাথে আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করি। সচলায়ত কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন লেখাটি প্রকাশ হতে পারে তবে কৃতজ্ঞতা জানবেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।