সমাজ পচনস্তরের বিপ্রতীপ মেরুর এই বাসিন্দার পেট চলে শব্দ শ্রমিকের কাজ করে ভোগ :
ভোগ বিষয়টি এই লেখার হার্ট হিসেবে বিবেচিত। পূর্বের বিরবরণকৃত পুরো ব্যবস্থাকে ভোগই নিয়ন্ত্রন করে। মন্দ ভালোর উপাখ্যান এই ভোগের কারনেই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী- মার্কিন অর্থনীতি হয়েছে ৯/১১ এর শিকার। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতি কেমন বেসামাল হয়ে পরে সে তো আমরা দিখেছি। বিশ্ব অর্থনীতির তাবৎ রথী-মহারথীরা সেই অস্থির সময় যে ঢেউ উতরে যেতে খাবি খাচ্ছিলো এতবছর পরও সে মন্দার বলয় থেকে বেরোতে পারেনি অনেক দেশ।
গ্রীস, ইতালীর বাজারে সেই সুনামীর রেখা আজও দেখা যায়। এ তো আজকের অবস্থা। কিন্তু সেসময় এমন পরিস্থিতির জন্য অপ্রস্তুত মার্কিনীরা মুখোমুখি হয় অন্তহীন সমস্যার। সঙ্গত কারনেই চিন্তিত ছিলেন প্রেসিডেন্টও জর্জ ডব্লিউ বুশও। তাই প্রেসিডেন্ট ঠিক করলেন এসময় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়া উচিত।
অতঃপর প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ এড্রেসড টু পিপলস অব ইউনাইটেড স্টেট (বিশ্ব)।
আশ্চর্যের বিষয়, বুশ তার ভাষণে মৃতদের জন্য দোয়া, দোষীদের বিচারের আশা বা জনগণকে ধৈর্য্য ধরতে না বলে সবাইকে অবাক করে তিনি জোর দিলেন একটি শব্দের উপর-“শপ”। কেনাকাটা করো। বলা দরকার প্রয়োজনে যা কেনা হয় তা “বাই”। আর কাজ নেই, ঘুরতে বেরিয়ে ভালো লাগলো কিনে ফেললাম তা “শপ”।
(শপ এবং বাই এর মধ্যে পার্থক্য)। প্রেসিডেন্ট এই শপের আহ্বান জানালেন মার্কিন জাতি বা বিশ্ববাসীর প্রতি। ফলে মার্কিনীদের নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও এসময় ঘরের বাইরে কাটাতে হলো অনেকটা সময়। বলা চলে, কাজে লাগলো বুশ পলিসি। বুশ গভর্ণমেন্টের চাপিয়ে দেয়অ ক্রয়নীতি গ্রহণ করলো পুরো দেশ ও ইউরোপীয় দেশগুলো।
কেনা মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকও জড়িত। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে মার্কিনিরা হয়ে গেল পুরোপুরি ভোগের জাতি। সে সময় মার্কিনিদের প্রাথমিক পরিচয় হয়ে উঠলো -ভোক্তা। মা,বাবা,শিক্ষক,কৃষক সব পরিচয়কে ছাপিয়ে ভোক্তা পরিচয়টি প্রধান হয়ে দেখা দিলো যুক্তরাষ্ট্রে। সেসময় মার্কিনীদের সামাজিক মর্যাদা (ষ্ট্যাটাস) মাপা হতো কে কতটুকু ভোগ করতে পারছে তার উপর।
এক সপ্তাহের মাথায় ৯/১১ এর জায়গায় প্রতিবেশীদের আলাপে জায়গা করে নিলো পণ্য ভোগের আলোচনা।
এ্যানির মতে, আমরা একের পর এক কিনতে থাকলাম,আর ভোগ করলাম। পক্ষান্তরে মার্কিন অর্থনীতির গতি সচল রাখলাম আমরা, মার্কিনীরা। মার্কিনীদের সব টাকা চলে গেল বাজারের হাত ঘুরে কোম্পানিগুলোর একাউন্টে। বেশ ভালো।
এবার ধারণা করুন,ক্রয়কৃত সেসব পণ্যের কতটুকু সেসময় ভোগ করতে পেরেছিল মার্কিনীরা ?
বিশ্বাস করুন বা নাই করুন উত্তরটা বেশ হতাশাজনক। মার্কিন কনস্যুমার এসোসিয়েশন এন্ড কনসালল্টেশনের মতে, তা মাত্র ১ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়,বিশাল ক্রয়যজ্ঞের ৯৯ শতাংশই ছয় মাস পর বাতিল হয়ে গিয়েছিলো তাদের কাছে।
এ পরিমান পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারের অসামঞ্জস্যতা দ্বারা উন্নত বিশ্বের একটি দেশ কীভাবে পৃথিবীর মঙ্গল কামনা করে? প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন কয়েকজন বর্ষীয়ান মার্কিন নাগরিক। তাদের দেয়া তথ্য মতে,ভোগের এ চিত্র অর্ধশতক আগেও এমনটা ছিল না।
পণ্যের অভিহীত মূল্যের তুলনায় ভোগ্যমূল্য বৃদ্ধির এ ঘটনা এমনি এমনি ঘটেনি,একে ঘটানো হয়েছে। আসুন সেই অজানা রহস্যই জানি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডলারের অসম্ভব মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। মার্কিন অর্থনীতি তখন ফুলে ফেঁপে একাকার। সেই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক কর্পোরেশনগুলো। সেসময় রিটেইলার এনালিস্টিক ভিক্টর লোবো মার্কিন অর্থনীতির জন্য কিছু প্রস্তাবনা দাড় করান যার উপর ভিত্তি করে মার্কিন অর্থনীতিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়।
লোবোর সেই সংস্কার প্রস্তাবের মূল কথা ছিলো :
Our enormously productive economy demands that we make consumption our way of life, that we convert we buying and use of goods into rituals. That we seek our spiritual satisfaction, our ego satisfaction, In consumption... we need things consumed, burned up, replace and discarded as an ever-accelerating rate.
ওই বিশাল অর্থনীতি ভোগের মানসীকতা গড়ে তুলতে লোবো মার্কিনীদের মধ্যে সার্থকভাবে ভোগ বিলাসীতার বীজ বপন করলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিল এর সাথে আরও ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতিকে বিশ্ব চালকের আসনে বসাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা,শিক্ষা,নিরাপদ চলাচল,স্থীতিশীলতা বা ন্যায়বিচারের মত বিষয়কে প্রধান্য দিলো না। মার্কিন নীতিতে প্রাধ্যান্য পেল নতুন একটি বিষয়- ভোগ্যপণ্য। তারা উৎপাদন করলো।
আর ভোগ করতে উদ্দীপ্ত করলো। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে দু’টি নীতি মেনে চলল তারা। যা এত বছর পর আজও অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে চলেছে। যার রেশ রয়েছে ভিক্টর লোবোর প্যারায়।
প্ল্যান অবসোলেসেন্স : ডিজাইন ফর ডাম্প (দ্রুত বাতিলের তালিকায় চলে যাবে এমন) যেমন - ডিসপো গ্ল্যাস,প্ল্যাস্টিক ব্যাগ,ডিভিডি,বারবিকিউ স্ট্যান্ড,ক্যামেরা ইত্যাদি ধরনের পণ্য বেশি উৎপাদন।
এককথায় যেসব পণ্যের মেয়াদকাল দীর্ঘ তা ক্রেতার আগ্রহ ও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাও। প্রয়োজনে দেশের বাইরে রপ্তানী করো। প্রথমে চাহিদা তৈরি করো পরে বাজার থেকে গায়েব করে দাও। ফলে ভোক্তা বাধ্য হবে একটু বেশি দামে লেটেস্ট পণ্য কিনতে। এক্ষেত্রে যন্ত্রাংশের তুলনায় পুরো পণ্যটির দাম যেন কাছাকাছি হয় এবং মডেল যেন অবশ্যই অনেকগুলো হয়।
চোখ ধাধাঁনো রূপ থাকতে হবে সবার- সে পণ্য হোক বা হোক পণ্য বিক্রেতা।
প্ল্যান অবসোলেন্স নীতির বড় উদাহরণ “কম্পিউটার”। আপনার কেনা কম্পিউটারকে আপনি এখন কয়ঘন্টা/কয়দিন আপডেট পিসি বলতে পারছেন। এর প্রধান কারণ প্রযুক্তির বদলের তুলনায় পিসির আদল বেশি বদলানো। আজ যে পিসিটি কিনলেন তার হার্ডওয়্যার এক বছর পর আপনি বাজারে পাচ্ছেন না।
সুতরাং দ্রুত পণ্যের বাজার বদলের লক্ষ্যে তারা হার্ডওয়্যারের আদল বদলে বাজারে ছাড়ছে। ফলে আপনি বাধ্য হচ্ছেন কিছুকাল পর নতুন আর একটি সিস্টেম কিনতে।
পঞ্চাশের দশকে প্ল্যানড অবসোলেশন নিয়ে অনেক খোলামেলা আলোচনা হলেও বর্তমান যুগে তা ক্রেতাকে না জানানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান লক্ষ্য দ্রুত,স্বস্তা,হালকা পণ্য ভোক্তাদের হাতে তুলে দেওয়া,যার দীর্ঘস্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা থাকবে না। ওয়ারেন্টি দেয়া হবে লাইফটাইমের।
সেখানে শর্ত থাকবে পণ্যটি যতদিন বাজারে থাকবে ততদিন নষ্ট পণ্যটি বদলে আরেকটি নতুন দিয়ে দেয়ার। ফলে একই একটু বেশী টাকা দিয়ে যেখানে আগে দশ বছরের জন্য নিশ্চিত হওয়া যেত এখন সেখানে এক বছর পার করাই মুশকিল। উপরন্তু পণ্যের মেয়াদকাল দাড়াচ্ছে সর্বোচ্চ ৩ বছর। যার ফলে দশ বছর সেবা পেতে আমাকে খরচ করতে হবে তিন গুন অর্থ। সমিকরনটা এমনই।
পুরো প্রক্রিয়াটি ইচ্ছাকৃত সংকট ও সংকীর্ণ মানসীকতার প্রকাশ।
এ নিয়মে পণ্যের গতি হবে দ্রুততর। আর সেজন্য দরকার মানুষকে পণ্য কিনতে বাধ্য করা। তার পকেটের পয়সা পকেট থেকে বাজারে নিয়ে আসা। তাই আবিস্কার করা হলো নতুন থিওরী।
প্রিসিভড অবসোলেসন্স : এ ব্যবস্থায় পণ্য নিজেই তার ভাষায় কথা বলবে এবং অন্যকে উৎসাহ যোগাবে তাকে কিনতে। যেমন- আপনার ঘরে আপনি যখন সিআরটি মনিটর ব্যবহার করছেন,তখন আপনার পাশে আরেকজন নিয়ে এলো ঝাঁ চকচকে স্লিম এলসিডি। স্বভাবতই আপনাকে নতুন এলসিডি তার রূপে গুনে আকৃষ্ট করবে। এ প্রক্রিয়ায় আপনি উদ্বুদ্ধ হবেন সচল একটি মনিটর থাকতেও সেটা বদলে ফেলার। এক্ষেত্রে ফ্যাশনও একটি বড় উদাহরণ।
ধরুন আপনি যে জুতো ব্যবহার করছেন তার হিল ফ্ল্যাট। অথচ চারপাশে অনেকেই পেনসিল হিলের জুতা পরছে। আপনি তাদের দেখাদেখি দিব্যি চলতে থাকা জুতাডেজাড়া বদলে কিনলেন পেনসিল হিল। একইভাবে ইলেকট্রনিক্স ও ফ্যাশনেবল সব ধরনের পণ্যের জন্য প্রযোজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তখন ভোক্তার কাছে প্রয়োজনের তুলনায় উপলক্ষ্যকে প্রধানরূপে উপস্থাপন করা হয়।
সঙ্গে জোর দেয়া হয় স্থানীয় সংস্কৃতির উপর। ব্যাস দাও ঘুটা। হয়ে গেল চাহিদা তৈরি। আর চাহিদা যখন আছে তখন ভোগ তো বাধ্য। প্রিসিভড অবসোলেন্স পদ্ধতির পেছনে বড় অবদান রাখছে পণ্য নিজেই।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পেটেন্ট, ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোপার্টির মতো কিছু মোক্ষম অস্ত্র। তবে প্ল্যানড এবং প্রিসিভড দুটো ব্যবস্থায়ই বড় ভূমিকা পালন করে বিজ্ঞাপন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার বিজ্ঞাপন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হয়ে থাকে। আজ আমরা একবছরে যত বিজ্ঞাপন দেখছি পঞ্চাশ বছর আগে মানুষ তা সারা জীবনে দেখতো কিনা সন্দেহ। লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন আজ আমাদের মূল্যবোধ শেখাচ্ছে।
সে বলছে চুল, চামড় বা শার্ট নয় আজ গোটা মানুষটাই ভুল, আনস্মার্ট। তাই শোধরাতে চাইলে ‘গো শপিং’।
কোম্পানির সাথে সাথে গণমাধ্যমের ভূমিকাও এ পুরো ব্যবস্থা সঞ্চালনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সুতরাং বস্তু অর্থনীতির এ পর্বে দেখা যাচ্ছে চালিকা শক্তির উৎস শপিং। Extraction>Production>Disposal সূত্রে আমরা না চাইলেও অনেকটা বাধা পড়েছি।
এখন আমাদের ঘরের তুলনায় শপিং মল বেশি চাই। ওজনে হালকা, স্বস্তা, সাময়িক প্রয়োজন মেটায় এমন পণ্য চাই। হোক না সে দেয়াশালাই থেকে ভিডিও গেম কিংবা দান বাক্স বা কপাটবদ্ধ প্রেম। সবই চাই তবে দ্রুত। এদিক থেকে মার্কিনীদের সঙ্গে বাঙালিদের পার্থক্য খুব একটা নেই বললেই চলে, কী বলেন।
আজ আমরা যে প্রচুর ভোগ করছি তারপরও কী আমরা যথেষ্ট সুখী? দেখা যাচ্ছে ১৯৫০ সালের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে সুখী মানুষের সংখ্যা ও পরিবার কমছে,অথচ এ সময় থেকেই তাদের ভোগ বেড়েছে কয়েকগুন। এর প্রধান কারন-আজ তাদের প্রচুর ভোগ্য পণ্য আছে,কিন্তু যথেষ্ট সময় নেই। পরিবার,বন্ধু বা অলস সময়ের জন্য আজ মার্কিনীদের সময় বের করা মুশকিল। তারা প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছে। তারপর দিন শেষে সম্পর্কের সেই জায়গা ও বন্ধনগুলো একটু একটু করে ঢিল দিচ্ছে।
আজ মার্কিন মুল্লুকে অলস সময় কাটানোর প্রধানত দুটি উপায় ১.টেলিভিশন দেখ ২.শপিং করো। একজন মার্কিনী তার জীবনচক্রে একজন ইউরোপীয়ানের তুলনায় ৩ থেকে চারগুন বেশি শপিং করে। তাদের দৈনন্দিন জীবনচক্র লক্ষ্য করলে বিষয়টা পরিস্কার হয়। একজন মার্কিনি কাজে যায়,কাজ করে। কেউ কেউ একাধিক চাকরীও করে।
কাজ শেষে বাসায় এসে টেলিভিশন সেটের সামনে বসে পরে,অনুষ্ঠান ভালো না লাগলে বিরক্ত হয়ে ছোটে কাছাকাছি শপিং মলে। শপিং করে ঘরে ফেরে। ঘুমায়। সকালে’ আবার কাজে বের হয়। আর ছুটির দিনে একটু দূরের পানশালার খোঁজে ছোটা।
এই তো তাদের জীবন।
অতএব, সবশেষে তাদের পরিনতি কী?
কিস্তি ১
কিস্তি ২
:: আপনাদের আগ্রহ থাকলে চলবে :: ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।