আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবীন্দ্রনাথের কোন বিকল্প নাই -২৫

বাঙালি ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয়। তাই বাঙালি যখন কাঁদে, তখন কেঁদে ভাসায়। আর যখন হাসে তখন সে দাঁত বের করেই হাসে। যখন উত্তেজিত হয়, তখন আগুন জ্বালায়। তার সব কিছুই মাত্রাতিরিক্ত।

কিন্তু কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। কালো পিঁপড়ের মতো বাঙালি অতি চালাক। আমাদের দেশে চিরকাল নতুন চিন্তা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু লালন পেয়েছে সামান্য। আমরা মহৎ পুরুষেদের মহা অবদানের ফলভোগে ধন্য হতে পারিনি।

তবু যখন আমরা স্মরণ করি- রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, তীতুমীর, দুদু মিয়া, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এদেশেরই সন্তান, তখন নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। নোবেল পুরস্কারের মান রক্ষার খাতিরেই রবীন্দ্রনাথকে বৈশ্বিক ও বিশ্বমানবিক চিন্তা-চেতনা অনুশীলন করতে হয়েছে। তার দীর্ঘ আয়ু তাকে এ সুযোগ-সৌভাগ্য দিয়েছে। বলতে গেলে পুরস্কার পূর্বকালের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উনিশ শতকী কবি আর পূর্বকালের রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ শতকের মনীষী মানূষ। কবি ও গল্প লেখা হিসেবেই তিনি পাঠক প্রিয় হলেও, তার গানের প্রভাবও শ্রোতাচিত্তে গভীর, আর তার নাটক, উপন্যাস এবং প্রবন্ধও করেছে জনচিত্র প্রভাবিত।

শেষাবধি তার মনীষাদীপ্ত লেখাই তাকে বিশ্বের অন্যতম কবি-মনীষীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ব্যক্ত-অব্যক্ত, সত্য-মিথ্যা, লঘু-গুরু অনেক অনুযোগ অভিযোগ রয়েছে। খোঁজও মিলেছে তার রচনার অনেক অপূর্নতার ও ক্রুটির। পাওয়া ও রাখা অসম্ভব জেনে রবীন্দ্রনাথ কখনো ভারতের স্বাধীনতা চাননি এবং তিনি কেমল হিন্দু চেতনায় ছিলেন অভিভূত। শিলাইদহ জমিদারীতে রবীন্দ্রনাথের আমলেও কিছু অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।

পুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরীক্ষামূলক শখের কৃষি-খামারের প্রয়োজনে গরীব মুসলমান চাষীর ভিটেমাটি দখল করে তার পরিবর্তে তাকে চরের জমি বরাদ্দের মহানুভবতাও রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শন করেছিলেন। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে গেলে অনেকেই হয়তো সাম্প্রদায়িক বা রবীন্দ্র-বিদ্ধেষী ধিক্কার ও তিরস্কার...। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষোৎসব উপলক্ষে বিদেশে বুদ্ধদেব বসু তার ভাষনে রবীন্দ্র সাহিত্য ইউরোপের প্রভাবের কথা বলে বাঙালীর তীব্র নিন্দা পেয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেন, "জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি না।

কিছু ইঁদুর খাবে, তবু বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না, যুগ বদলায়, তার সাথে তো সবকিছুই বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালীরা, শোকে দুঃখে সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। ১৮৭২ সালে ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে পাবনায় কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়।

১৮৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন। [শচীন্দ্র অধিকারী, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮,১১৭]করবৃদ্ধির ও বলপ্রয়োগে কর আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তাও তিনি সাফল্যের সাথে দমন করেন। বিশ শতকের বিশের দশকে প্রজাপীড়ন শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু'শ ঘর প্রজার বিদ্রোহ ও সূত্রে উল্লেখ্য। [অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ 'শারদীয়া, ১৩৮২]একজন কারখানা মালিক যেমন তার শ্রমিকদের দাবী আদায়ের মিছিলে শামিল হতে পারে না, সামন্ত-বেণে-বুর্জোয়া-জমিদার রবীন্দ্রনাথও রেমনি পারেন নি দুস্থ-দুঃখী-চাষী-মজুরের শোষন-পীড়ন জর্জরিত জীবনের আলেখ্য আঁকতে। শোষক তিনি যত বড়ো মহাপুরুষই হোন, শোষিতের পক্ষে লড়াই দূরে থাক তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও অনীহ।

রবীন্দ্রনাথের আগে যারা ইংরেজী আদলে গীতিকবিতা রচনা করেছিলেন তাদের কারো রচনায় গীতি কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়নি। ওই সব কবিতায় অনুকৃতি ছিল কিন্তু কাম্য আমেজটি ছিল না। মধুসূদন, হেমচন্দ্র কিংবা নবীন সেন অনেক কবিতাই লিখেছেন, কিন্তু মেজাজে তারা যেন গীতিকবি ছিলেন না। অথচ তারা সবাই ছিলেন প্রতীচ্য বিদ্যায় উচ্চশিক্ষিত। মধুসূদন কিংবা হেম-নবীনের কাব্যে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না।

বিহারীলালের মধ্যে কিশোর রবীন্দ্রনাথ তার আত্মার আহার ও আনন্দ খুঁজে পান। কবি রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক বিকাশে বিহারীলালের প্রভাব তুচ্ছ নয়। বিহারীলালের রুপলক্ষ্মী সারদা আর রবীন্দ্রনাথের 'জীবন দেবতা' মূলত অভিন্ন। বিহারীলাল তার ঘুমন্ত স্ত্রীর সুন্দর মুখের পানে তাকিয়ে উল্লসিত হয়ে লিখেছেনঃ - আহা এই মুখখানি/ প্রেম-ভরা মুখখানি/ ত্রিলোক সৌন্দর্য আমায় কে দিল আনিয়া! বাংলা সাহিত্যে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কোনও আলোচনা হতে পারে না। কেননা তিনি ছিলেন বিশ্বের অমিত প্রতিভাবান কবি শিল্পী-সাহিত্যিক।

রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তির দরুন তার প্রতি আমাদের ক্ষোভ-ক্রোধ-অনুযোগ প্রশমিত হতে পারে। কিন্তু ভক্তিতে গদগদ হওয়ার কোন কারণ ঘটে না। (চলবে...) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।