আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবীন্দ্রনাথের কোন বিকল্প নাই -২৪

রবীন্দ্রনাথের সাথে হাসান রাজার ব্যক্তিগত পরিচয় কখনও হয়নি বোধহয়। সেরকম কোনও তথ্য নেই। যদিও পরিচয় হতে পারত। হাসান রাজা রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র সাত বছরের বড়, তিনি বেঁচে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। অবশ্য তার পরিচয় তখনও সীমাবদ্ধ ছিল সিলেটের একটি ছোট গন্ডির মধ্যে।

তার গানের সংগ্রহ হাসান উদাস ছাপা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। সে বই যে রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি, তার প্রমাণ আছে। যতদূর জানা যায়, প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত নামে সিলেটের মুরাদি চাঁদ কলেজের একটি ছাত্র তার কলেজ ম্যাগাজিনে হাসান রাজার গান সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখে। হাসান-ভক্ত এই ছেলেটির সাধ হয়েছিল হাসানের গান রবীন্দ্রনাথের গোচরে আনার। সে উদ্দেশ্যে সে চলে এসেছিল শান্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্রনাথ তার সাথে দেখা করেন এবং তার কথা শুনে হাসানের আটটি গান পড়ে দেখেন। তিনি বলেছিলেন, মাত্র এই ক'টি গানে ঠিক সিলেটের কবিটির পরিচয় বোঝা যাচ্ছে না, আরও কিছু লেখা চাই। সিলেটে ফিরে এসে প্রভাতচন্দ্র তার সংগ্রহ থেকে ৭৮টি গান পাঠিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। সেসব পড়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন হাসান রাজার জীবন-ভাষ্য। এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি যে ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত হিউবার্ট লেকচারে হাসানের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, "It is a village poet of East Bengal who preaches in a song the philosphical doctrine that universe has its reality in its relation to the person." তারপর থেকেই হাসান রাজা সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজের আগ্রহ জন্মায়।

হাসান রাজার এই গান টি রবীন্দ্রনাথকে খুব প্রভাবিত করেছিল। (হাসান রাজা কে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। ) " আমিই মূল নাগর রে আসিয়াছি খেউড় খেলিতে ভব সাগরে রে। আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিব শংকরী অধর চাঁদ হই আমি, আমি গৌর হরি। আমি মূল, আমি কূল, আমি সর্ব ঠাঁই আমি বিনে এ সংসারে অন্য কিছু নাই... দীর্ঘজীবি সার্বক্ষনিক লেখক রবীন্দ্রনাথের রচনা এতো বিচিত্র, বহুমূখী এবং বিপুল কলেবর যে কোন একজনের পক্ষে ধৈর্য ধরে তার রচনাবলী পড়ে শেষ করাও দুঃসাধ্য,মনে রাখা অসাধ্য; কোন অংশ প্রয়োজনে খুঁজে নেয়া কষ্টসাধ্য, আর তার রচনাবলী ঘরে রাখার পূর্বশর্ত হচ্ছে আর্থিক সাচ্ছল্য।

তার যে কোন রকমের রচনার দেশ-কাল, পরিবেষ্টনী সাপেক্ষ মূল্যায়নের জন্যে প্রয়োজনে উঁচু মানের মনীষা ও তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পন্ন বিদ্বান ব্যক্তির সশ্রম, সর্তক ও সচেতন প্রয়াস। গত ষাট-সত্তর বছর ধরে স্কুল-ম্যাগাজিনে ছাত্র-শিক্ষকরা রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখছেন, যেমন লিখছেন পত্র-পত্রিকায় অন্য অসংখ্য লেখকেরা। রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি সময়ের প্রতীচ্য প্রতিভাবানদের- গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২), টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০), বানার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০),রাসেল (১৮৭২-১৯৭০), রোমা-রঁলা (১৮৬৬-১৯৪৪), প্রমুখের- তার মতো এমন বহুমূখী দক্ষতা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও একজন গৃহী ও বিষয়-সচেতন ব্যক্তি। আর এও মানতে হবে যে তিনি মুখ্যত ঊনিশ শতকের মানুষ ও কবি, কেননা তার মন-মানস পাকাপোক্ত হয়েছে ঊনিশ শতকী প্রতিবেশে।

তার জন্ম সামন্ত প্রতিবেশে বুর্জোয়া পরিবারে। কৈশোরে তার পদ্ধতিগত শিক্ষা হলো না বটে, তবে নানা বিদ্যায় ছিল তার কৌতুহল, ফলে রবীন্দ্রনাথ যথসময়ে বিদ্বান হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় সর্বদিক দিয়ে শিথিল চরিত্রের লোক ছিলেন বলে দ্বারকানাথের প্রতি তেমন শ্রদ্ধা ছি না রবীন্দ্রনাথের। হিন্দু-পুরাণের দেব-দেবী তার চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন করেছিল, অধিকার করেছিল তার আবেগের জগৎ। ভূতে এবং ভগবানে ছিল তার সমান বিশ্বাস।

আমৃত্যু ভৌতিক প্লানশেটে ছিল তার গভীর আস্থা। আবার রক্তমাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথ কামে প্রেমেও উদাসীন ছিলেন না কখনো। জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড রবীন্দ্রনাথকে 'নাইটহুড' ত্যাগের মতো বিচলিত করেনি, ভিতরকার চাপে সিদ্ধান্ত নিতে তার ছেচল্লিশ দিন লেগেছিল। বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যেমন ভারতীয়দের শিক্ষিত ও সংকৃতিবান মানুষ করার মহান দায়িত্ব গ্রহনের ও পালনের গৌরব সগর্বে ঘোষনা করত, রবীন্দ্রনাথও তেমনি মহুয়া কাব্যের সাগরিকা কবিতায় স্বজাতির সে-ঐতিহ্য স্মরন করে আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছেন। উপনিবেশবাদে (Colonialism) তার ঘৃনা ছিল!রবীন্দ্রনাথ স্থির বুদ্ধির ও ধীর বিশ্বাসের মানুষ ছিলেন।

তিনি বিরুপ সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না,প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া না গেলে বেনামে লিখে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতেন। তিনি জীবনে বহুবার এক নাটক ভেঙ্গে দু'তিন নাটক করেছেন, উপন্যাসকে, কবিতাকে নাটক কিংবা নৃত্যনাট্য বানিয়েছেন, কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ নাটক ও কবিতাই লিখেছেন সযত্নে, ফাঁকে ফাঁকে লিখেছেন গান, উপন্যাস, ভ্রমনবৃত্তান্ত ও প্রবন্ধাবলী। তিনি মূলত কবি-নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথ জন স্টুয়ার্ট মিলের (১৮০৬-৭৩) পঞ্চান্ন বছর এবং কার্ল-মার্কসের (১৮১৮-৮৩) তেতাল্লিশ বছর পরে জন্মেছিলেন, কৌতুহল থাকলে কৈশোরে লন্ডনে তাকে দেখতেও পেতেন।

তবু এদের কোনও প্রভাব পড়েনি তার উপর। এমনকি রবীন্দ্রনাথ জমিদারী প্রথা উচ্ছেদেরও ছিলেন ঘোর বিরোধী, বলেছেন জমিদারী উঠে গেলে গাঁয়ে লোকেরা জমি নিয়ে লাঠালাঠি কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে। (চলবে....) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।