[নীচে মুখবন্ধ** সংযোজন করা হল। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবার প্রয়াসে প্রথম পোস্টটি লিখলেও এখন সিদ্ধান্ত বদল করে অখণ্ডিত রেখে পুরো লেখাটিই একই পোস্টে প্রকাশ করা হল]
------------------------------------
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তবে তখনও তন্দ্রা পুরোপুরি কাটেনি। ঘুমঘুম ভাবের মধ্যেই বেশ আশ্চর্যবোধ করলাম।
দরজা তো লক্ করে ঘুমিয়েছি, বাইরে থেকে খোলার প্রশ্নই আসে না। হঠাত্ মনে হল, কেউ আমার লেপের ভেতর ঢুকে পড়ল। প্রচন্ড আতংকিত হয়ে পড়লাম। তবু কি আশ্চর্য - ঘুমের রেশ চোখে জড়িয়ে, চোখ খুলতেই পারছি না। কোনমতে চোখ দুটো আধো খুলে দেখলুম, না কেউ নেই।
দরজাটাও লক্ড্ রয়েছে। সাথে সাথে চোখের পাতা ভারি হয়ে গেল।
কিছু মুহুর্ত কাটল চুপচাপ। তারপর আবার দরজার ক্যাঁচক্যাঁচানি। কেউ আমার লেপ ধরে টানছে।
স্পষ্ট তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি - লেপের কুঞ্চন অনুভব করছি শরীরে। আমি তো বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত। হচ্ছে কি এসব!
মাস তিনেক হল অস্ট্রেলিয়াতে এসেছি, মেলবোর্ণে। এখনও কোনকিছুর সঙ্গেই ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারিনি নিজেকে। প্রতিদিনই ঘুম ভেঙ্গে কোথায় রয়েছি বুঝে উঠতে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যায়।
বাবা ইমিগ্রেশান নিয়ে এসেছেন, সাথে মা, শ্যামল আর আমি। শ্যামল আমার সাত বছরের ছোট। বাংলাদেশে এখন ক্লাস সেভেনে পড়বার কথা। এখানে ওর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল কিছুতেই সেভেনে ভর্তি করতে রাজী নয়। তাঁর মতে নাকি "তৃতীয় বিশ্বের" দেশগুলিতে শিক্ষার মান এত পিছিয়ে যে, এখানে এখন ক্লাস সেভেনে পড়াশোনা শ্যামলের জন্য ভয়াবহ এক মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে; এতে করে নাকি শ্যামলের সুকুমার বৃত্তিগুলো সুস্থ স্বচ্ছন্দগতিতে বিকশিত হতে পারবে না।
অতএব, এখন সে ক্লাস সিক্সের ছাত্র। আমি এক ফাঁকে শ্যামলের সিলেবাস ও বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখলুম -- হ্যাঁ, সুকুমার বৃত্তিই বটে, ঐসব ক্লাস ফোরের স্ট্যান্ডার্ডের অংকগুলো কষতে থাকলে শ্যামলের যে সহজাত গণিতপ্রতিভা ছিল, তা' লুপ্ত হতে বেশীদিন লাগবার কথা নয়।
অস্ট্রেলিয়ায় আসবার আগে দেশে শেষের কটি দিন যে কি' ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। প্রতিদিন শপিং-য়ে দৌড়াদৌড়ি। নভেম্বারের পঁচিশ তারিখে ফ্লাইট।
মণিখালা একবার চিঠিতে লিখেছিল, মেলবোর্নে না কি' প্রচন্ড শীত পড়ে। নিউমার্কেট ছুটলাম - প্রায় দু'হাজার টাকার মত খরচ হয়ে গেল শুধু আমার স্যোয়েটারের জন্যই। মা, বাবার জন্য কেনা প্যান্টের কাপড় দিয়ে গাওছিয়া থেকে আমার জন্য মোটা মোটা সব সালোয়ার বানিয়ে নিয়ে এলেন। এখন ভাবতে গেলেই হাসি পেয়ে যায়, 'সাত সমুদ্র তেরো নদী' পাড়ি দেবার চাপা উত্তেজনায় বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম যে, দক্ষিণ গোলার্ধের যে কোন দেশে এখন গ্রীষ্মকাল। আমার ভূগোল টীচার জানতে পারলে কি' বকাটাই না খেতে হত!
ফ্লাইটের সাতদিন আগে থেকেই কারো চোখে ঘুম নেই।
বাবা প্রতিদিন অফিস সেরে বিষন্নমুখে ঘরে ফেরেন। কেনাকাটার ব্যস্ততায় মা'র নিঃশ্বাস নেবার অবসরটুকুও মেলে না। শ্যামল প্রতিদিন টি.ভি. খুলে ইংলিশ সিরিয়্যালগুলো চলবার সময়ে টি.ভি.র পাশে কান লাগিয়ে বসে থাকে। ইদানীং সে ইংলিশে ছাড়া কথাই বলে না। তার স্ফূর্তি দেখবার মত।
মণিখালা চিঠিতে লিখেছেন, মেলবোর্ণে প্রচুর খোলা মাঠ আর পার্ক। ইচ্ছেমত সাইকেল চালাতে পারবে শ্যামল। আর হরেক রকমের খাবারের না কি' শেষ নেই। Porridge, cereal, vegemite কি' না নেই – wheat bix, তা'ও আছে! “Aussie kids” দের পরিচয়ই না কি', যে তারা “wheat bix” kids। শ্যামল কবিতার মত অবিকল গড়গড় করে আবৃত্তি করে যাবে মণিখালার চিঠি।
তার দৌলতে আমাদের সকলেরই চিঠিটা মুখস্থ হয়ে গেল। Christmas-এর সময়ে city-এর skyscrapers গুলো না কি অপূর্ব মনোরম হয়ে ওঠে। শ্যামল মেলবোর্নের সুউচ্চ দালানগুলো (ওর ভাষায় "প্রাসাদ") দেখবার জন্য আমাদের প্রায় অতিষ্ট করে তুলল। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আর অয়নের প্রতীক্ষায় দিন গুনি। ও এখন দিল্লীতে, ভার্সিটি খোলা ওর।
হুট করে ফ্লাইটের তারিখ ঠিক করে ফেল্লেন বাবা। মাত্র সাতদিনের মধ্যে। এখন কিভাবে যে খবর পাঠাই! সংকোচে কখনও ওর দিল্লীর ঠিকানা চাইতে পারিনি, সেও কখনও মুখ ফুটে বলেনি। কত আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে আসলেন; আমার সব বান্ধবীরা একযোগে দেখা করতে আসল একদিন, কিন্তু অয়নের দেখা নেই। ও কি কারো কাছ থেকেই কোন খবর পায়নি? বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
বান্ধবীরা সকলে যেদিন এলো, সেদিন একটু শান্তি ও স্বস্তি পেলুম মনে। রাকা, লিপি, নাহিদা, মুনিয়া, তাসনীম, সুবর্ণা সকলেই এসেছে - শুধু সাব্রিনাটা আসতে পারেনি। লিপি ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল, "আমাদের আন্মনার তো ফেভারিট কালার নীল -- নীল সমুদ্রে ঘেরা স্বপ্নময় দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবি, দেখিস্, আবার যেন ডুবে ডুবে নীলনয়নের অবাক জলপান না শুরু করিস্। " সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। দেখলাম সকলেই আমার জন্য স্যুভেনিয়ার নিয়ে এসেছে।
মুনিয়া তার দেওয়া উপহারের প্যাকেট খুলতে লাগল। দেখলুম এক জোড়া রাবার ব্যান্ড - তা'তে প্লাস্টিকের নীল অপরাজিতা আঠা দিয়ে সাঁটা। "নীলনয়নের ভাবীবধূর জন্যে কেনা", আবার হাসির উতরোল। ভালভাবে জমে উঠল আড্ডা। "এই আন্মনা, বিদেশে গিয়ে তুই কি' আমাদের ভুলে যাবি?" রাকা হঠাত্ প্রশ্ন করে উঠল।
"তোদের ভুলে গেলে তো নিজের জীবনের বড় একটা অংশকেই ভুলে যেতে হয় - তা কি সম্ভব বল্!" "নারে, তুই অনেক বদলে যাবি, আমি জানি, সকলেই তো বদলে যায় - আর তুই তো দু'বছরের মধ্যেই সিটিজেনশীপ পেয়ে “Pure Australian”-এ' পরিণত হয়ে যাবি; তা'ছাড়া নীলনয়নের জলপান করলে তো কথাই নেই - কি বলিস্ তোরা?" ওদের সাথে আমিও হাসিতে যোগ দিলাম। তাস্নীম আরও এক কাঠি সরেস, "দু'দশ বছর পরপর কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে একবারটি বেড়িয়ে যাস্ ভাই!" হাসি-কৌতুকের এই উত্সবে যোগ দিলেও মনের কোথায় যেন একটা অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে রইল। অতঃপর পঁচিশ তারিখের কাক-ডাকা ভোরে তল্পিতল্পা ও স্যোয়েটারের বান্ডিলসহ বাবা, মা, শ্যামল আর আমি "উলের-দেশ" অস্ট্রেলিয়ার পথে যাত্রা শুরু করলাম।
। ।
দুই । ।
স্থিরভাবে চিন্তা করবার চেষ্টা করলাম। নাহ্, একটু আগেই তো দেখলাম দরজা লক্ড্ রয়েছে। তাছাড়া এই হোস্টেলে কে আমার লেপ ধরে টানাটানি করবে? কিন্তু আমার খাটের পাশে পায়চারীর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
কোনমতে চোখ দুটো মেলে চাইলাম। না, কেউ নেই। আবারও ঘুমের গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকলাম - সঙ্গে সঙ্গে পায়চারীর খুটখুট শব্দ। দরজার ক্যাঁচক্যাঁচানি। মাথাটা ঝনঝন করে উঠছে।
গোটা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আমার কি হ্যালুসিনেশান হচ্ছে? কিন্তু কেন? কোথায় যেন পড়েছি, মানুষের সমস্ত অনুভূতি ও আবেগ মস্তিষ্কের জটিল তড়িত্-রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রকাশ। তবে কি' কোনপ্রকারে আমার মস্তিষ্কে বিকৃত তড়িত্-রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছে? কেন? কিভাবে? ঘুমুবার সময়ে ইলেক্ট্রিক বেড হীটার চালিয়ে রেখেছিলুম - তবে, তবে কি এই হীটারের ইলেক্ট্রিসিটিই আমার মস্তিষ্কের ম্যাগনেটিক রেজোনেনস পাল্টে দিয়েছে! কি' উল্টোপাল্টা ভাবছি! মৃদু হাসির শব্দ শুনলুম। সঙ্গে সঙ্গে কারো তপ্ত নিঃশ্বাস এসে পড়লো আমার ডান গালে। রিনরিনে সুরে বেজে উঠল ঘড়ির আ্যালার্ম।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম বিছানা থেকে। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর!
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লুম। হুঁ, তাহলে স্বপ্নই - নাহ্, স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম। স্বপ্ন যে এতটা আজগুবি আর বিদ্ঘুটে হতে পারে, তা' না দেখলে বিশ্বাসই করতুম না। আর স্পর্শ ও শব্দই বা বাস্তবের এত কাছাকাছি, এতই সুস্পষ্ট হয়, বাব্বাঃ! যাই হোক্, এখন রুটিন কাজগুলো জলদি সেরে ফেলতে হবে - ঘড়িটার রিনরিনে অ্যালার্মটা বেজে উঠেছে একটু আগে; তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে সোয়া আট্টা বেজে গেছে।
ঘড়িটা হোস্টেলে আসবার আগে আগে মণিখালা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বল্ল, "snooze অ্যালার্ম দেয়া যায়, অ্যালার্মের মিষ্টি রিনরিনে সুর, তোর কাছে রাখ। প্রতিদিন মিষ্টি সুরে ঘুম ভাঙবে। আরে, এদেশের টেকনোলজি, বুঝিস্ই তো কত অ্যাড্ভ্যান্স্ড্। মিষ্টি আমেজে ঘুম ভাঙবে - তার জন্যও কত ব্যবস্থা, দেখ দেখি। " সেদিন থেকে প্রতিদিনই এই ঘড়ির অ্যালার্মে আমার ঘুম ভাঙছে।
রিনরিনে, সাপের মন্ত্র পড়া এই সুর শুনলেই একটা অচেতন ভয় আমায় ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে। মনে পড়ে যায়, এখানে বুয়া নেই নাস্তা তৈরী করে দেবার জন্য, ড্রাইভার ভাইও আমার অপেক্ষায় ক্রীম টয়োটাতে বসে নেই। এখন আমাকে সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, দ্রুত বাস ধরতে হবে। তারপর ইউনি. পৌঁছে লেকচারারদের অবোধ্য ভাষার লেকচার শুনতে হবে বসে বসে। চারদিকে কথার খই ফুটবে, এরই মাঝে নিজেকে মূক আর বধির বলে মনে হবে।
আমি দেশ থেকে আনা সবুজ বদনা (মেলবোর্ন রওয়ানা দেবার আগে আগে নানী অস্ট্রেলিয়া থেকে চিঠি লিখেছিলেন - তাতে বিশেষভাবে বলেছেন একটা বদনা নিয়ে আসার জন্য) হাতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলুম। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে হাত-মুখ ধুয়ে এসে woollen কামিজ ও বাবার প্যান্টের কাপড়ে বানানো মোটা সালোয়ারটা পরে নিলুম। গড়িতে দেখি সাড়ে আটটা বাজে। সর্বনাশ। কোনরকমে নীল কেড্স্জোড়া পায়ে গলিয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আমার রুমটা লক্ করে নিয়ে হোস্টেলের কমন রান্নাঘরে চলে এলাম।
এখানে আমাদের কমন ফ্রীজ রয়েছে। ফ্রীজের একেকটা shelf একেকজনের জন্য নির্ধারিত। ফ্রীজ খুলে আমার shelf-এ রাখা অখাদ্য vegemite কোনরকমে গলাধঃকরণ করে চারটে আপেল ব্যাগে পুরে লিফ্টের দিকে দৌড় দিলুম। আমার হলের আটতলাতে থাকি আমি। একতলাতে পৌঁছতে তিরিশ সেকেন্ডমত সময় লাগবে - কারণ লিফ্টা চার ও তিনতলাতে থামবে।
দুটো ছেলে এসে ঢুকবে। ওদের একজন ভিয়েতনামিজ, ওর নাম "ভু লি"। আর অন্যজন কোরিয়ান, ওর নাম "হা"। দুজনেই আমার ইউনি. তে পড়ে। ওদের সঙ্গে এই লিফ্টেই পরিচয়।
পরিচয় বলতে "হাই, হ্যালো" এই পর্যন্তই। হা দেখা হলেই বলবে, "হাওয়াইয়া অ্যানা!" - তারপরই গভীর মনোযোগে ওয়াক্ম্যানে কানে লাগিয়ে সঙ্গীতসাধনায় বুঁদ হয়ে যাবে। আমি উত্তরে বলি, "গুড। থ্যাংকস। হাউ আর ইউ হা?" বলে হাসি চাপবার প্রাণপণ চেষ্টা চালাই।
আজ ওদের দুজনের কারো দেখাই মিলল না। তার মানে আজ নিশ্চিত late হয়ে যাবে ক্লাসে পৌঁছাতে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে দ্রুত পায়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগুতে থাকলাম। এরপর রেলস্টেশনে নেমে ট্রেন ধরতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে দু'মিনিট - তবেই ইউনি. পৌঁছাবো।
অবশ্য কল্ফিল্ড স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছুতেই ট্রেন থেকেই সুউচ্চ Chisholm Tower-টা দৃষ্টি কাড়বে। আমি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতীত রোমন্থনে নিমগ্ন হয়ে রই।
মেলবোর্ণ এয়ারপোর্টে পৌঁছালুম সাতাশ তারিখে। ঢাকা থেকে রওয়ানা দেবার পরেরদিন সিঙ্গাপুরে হোটেল Sea View-তে এক রাত কাটাতে হয়েছিল। মেলবোর্ন পৌঁছালুম সকাল ন'টায়।
এয়ারপোর্টে দেখি হাসি হাসি মুখে মণিখালা, খালু ও নানী এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তাঁদের দেখামাত্র আমাদের এই ক'টিদিনের দুর্ভাবনা, উত্তেজনা, উদ্বেগ নিমেষে মিলিয়ে গেল। মণিখালা তিনবছর হল বিয়ের পর অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছেন - খালু বাঙালী এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তিনি sponsor করে নানীকেও নিয়ে এসেছেন মেলবোর্নে। তাঁরাই অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের একমাত্র আত্মীয় ও পরিচিত।
মণিখালা-খালু দুটো গাড়ী নিয়ে এসেছেন। খালু তাঁর গাড়ীতে আমাদের বাক্স-পেঁটরা আর সোয়েটারের বান্ডিল নিয়ে ইতিমধ্যেই গাড়ী স্টার্ট দিয়েছেন। মণিখালার গাড়ীতে আমরা বাকী পাঁচজন রওয়ানা দিলুম যখন, তখন শ্যামলের আনন্দ আর ধরে না। "মণিখালা city-এর প্রাসাদগুলোতে নিয়ে চলনা, মণিখালা সুন্দর পার্কগুলোতে নিয়ে চলনা" ইত্যাদি ইত্যাদি করেই চলেছে; একদন্ড সুস্থির হয়ে বসবার কোন লক্ষণ নেই। মণিখালা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে আশে-পাশে সবকিছুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলেন।
"এখন আমরা West Gate Bridge-এর ওপর দিয়ে চলেছি। এই bridge-এর মর্মান্তিক এক ইতিহাস আছে, বুঝলি। সিভিল ইঞ্জিনীয়ারদের অসতর্কতার জন্যে এই bridge ভেঙে একবার অজস্র মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। এটা এখন পুনঃ মেরামত করা হয়েছে। " "ঐ দেখ, মেলবোর্ণ city!" আমাদের ঢাকার মতিঝিল এলাকার সমতুল্য মেলবোর্ণ city-টাকে দেখলুম।
City-এর পরিসরও মতিঝিল এলাকার মতই বড় হবে। City পেরিয়ে মণিখালার হলুদ Mitsubishi Colt সাঁ সাঁ করে গ্রামের দিকে এগুতে থাকল। দু'পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ।
Christmas Eve-এ খালা-খালু আমাদের নিয়ে city-তে ঘুরতে বেরুলেন। তখন সন্ধ্যে হয় হয়।
ঘন নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘের আনাগোনা, যেন মৌনতার মাঝে সুরের মূর্ছনা --- তায় অস্তগামী সূর্যকিরণের লাল-হলুদ-কমলায় হোলি খেলার এক উন্মত্ত আয়োজন। আকাশটা যেন লজ্জায় রক্তগন্ড এক উর্বশী। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলুম।
রাতের শহর সত্যিই মনোমুগ্ধকর । উঁচু-নীচু পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যখন আমরা চলেছি; দূরে, বহু-দূরে দেখা যায় সারি সারি আলোর সমারোহ --- বিন্দু বিন্দু আলো ক্রমশ উপরে উঠতে উঠতে উর্বশী ঐ আকাশটাকে স্পর্শ করতে চলেছে।
ওখানেই Melbourne City -- ছাপ মারা এক বিশাল শামুকের খোলসের মত দাঁড়িয়ে -- যার অপর নাম সভ্যতা।
প্রচণ্ড ভীড় পথে। Christmas Eve উপলক্ষে Myer কোম্পানী পুতুল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে। জীবন্ত পুতুলগুলি থরে থরে সাজানো বিভিন্ন show room-এ। ‘Snow White and the Seven Dwarfs’ গল্পটির রূপায়নের প্রচেষ্টা।
একের পর এক show room-এ পুতুলগুলি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, তা' গল্পটির একের পর এক দৃশ্যায়নে সহায়তা করে গল্পটাকে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। Show room-গুলির দেওয়ালে প্রতিটি দৃশ্যপটের ঘটনা লিখিতভাবেও বর্ণনা করা আছে। এই ভীড়ে আমি খুব সাবধানে বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরে চলেছি। একসময় লক্ষ্য করলুম, নাতো, কেউ কারো ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে না, বা কেউ আলগোছে আমার শরীরে নিজের ভার দেবারও চেষ্টায় নেই। আমি জীবনে প্রথমবারের মত প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যেও নিশ্চিন্তবোধ করলুম।
মা, বাবা ও শ্যামল মণিখালার বাড়ীতে অস্থায়ীভাবে থাকবার বন্দোবস্ত করলেন। আমি ইন্টারভিউতে বেশ ভালো ফলাফল করে ইউনি.তে 'Creative Literature'-এ চ্যান্স পেয়ে গেলাম। ইউনি. মণিখালার এই গ্রামের বাড়ীটা থেকে বহুদূরে থাকবার কারণেই আমার এই হোস্টেল ভাড়া করে থাকা। তাও বাস ও ট্রেনে করে যেতে আধঘন্টা লেগে যায় ইউনি. পৌঁছাতে।
।
। তিন । ।
পনেরো মিনিট লেইট করে অবশেষে ইউনি. পৌঁছালুম। টিউটোরিয়াল ক্লাস এখন।
এত দেরীতে পৌঁছে ভীষণ লজ্জা করছে। মাথা নত করে ক্লাসে ঢুকে কোনমতে "my apology" শব্দ দুটো উচ্চারণ করলুম। ডঃ স্টিভেন লেদ্যু ক্লাস নিচ্ছেন। আজকের বিষয় লেখক 'Albert Camus"-এর রচনাবলীর স্টাইল সম্পর্কে। আমি Camus-এর গুটিকতক বই পড়েছি -- "দ্য প্লেগ", "দ্য আউটসাইডার", "এ হ্যাপী ডেইথ" -- এই পর্যন্তই।
বেশ নার্ভাস লাগছে, কারণ আগামী পনেরোদিনের মধ্যে এ' বিষয়ে একটা assignment জমা দেবার কথা বলছেন লেদ্যু। তিনি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতেই Camus-এর রচনাবলীতে সমসাময়িক জীবনধারা প্রতিফলিত হওয়া সত্ত্বেও একইসাথে কিভাবে অনন্য ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক মূল্যবোধ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে -- এ' বিষয়ে আলোচনা করে চলেছেন। এমন সময়ে দুটো ছেলে ডঃ লেদ্যুর দিকে এগিয়ে এল। একজন break dance করতে করতে আসল। একজন লেদ্যুর সামনের চেয়ারে এক পা উঠিয়ে লেদ্যুর হাতে কিছু কাগজ গুঁজে দিল।
দূর থেকে তাকে ইংরেজী ছোট হাতের 'এইচ' অক্ষরের মত দেখাচ্ছে। লেদ্যু হাসিমুখে কাগজগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে চলেছেন। পরে বুঝলুম, ছেলেদুটো ইতিমধ্যেই assignment-এর জন্য ছোটখাট একটা draft তৈরী করে ফেলেছে, সেটাই তাদের শিক্ষককে দেখাবার জন্য নিয়ে এসেছে। ইউনি. তে ক্লাস করছি সপ্তাহখানেক হল। এদের কাণ্ডকারখানা দেখে কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠতে হচ্ছে।
আমার পাশে বসে রয়েছে মালিসা। মালিসা Tasmania থেকে পড়তে এসেছে। মফস্বলের মেয়ে বলেই বোধহয় তার আচার আচরণে এখনও শহুরে ছোপ ভালমত গাঢ় হয়ে ওঠেনি। ও আমার ভাল বন্ধু। আমি মালিসার চোখে চোখ রেখে বললুম, "তোমরা শিক্ষাগুরুদের সম্মান করতে জানো না!" সে চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, "সম্মানতো মানুষ হিসেবে আমদের সকলেরই প্রাপ্য।
নয় কি? আর শিক্ষকের কথা বলছ! শিক্ষক আর ছাত্রের সম্পর্ক তো হবে বন্ধুত্বের ও সমঝোতার সম্পর্ক। এখানে অসম্মানের তুমি দেখলে কি? তোমাদের দেশে কি' সম্মান ও ভীতি সমার্থক শব্দ?" আমি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলুম, "আচ্ছা মালিসা, এখানে প্রাইভেট টিউটর কোথায় পাব বলতো? আমার ছোট ভাই শ্যামলের জন্য একটা প্রাইভেট টিউটরের বড় প্রয়োজন। " "এখানে প্রাইভেট টিউটর তেমন নেই বললেই চলে, Student Union-এ খোঁজ করে দেখতে পারো। " বলে চলল মালিসা, "আমরা সাধারণতঃ প্রাইভেট ট্যুশনিতে বিশ্বাসী নই। তোমার পাঠে আগ্রহ, প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ই তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করবে।
এখানে উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখতে হলে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে কখনও কখনও। প্রাইভেট টিউটররাও কখনও কারো assignment লিখে দেবে না, সামান্য ভুল সংশোধন করে দিতে পারে মাত্র। " অজান্তেই আমার ভেতর থেকে এক দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল। আমাদের দেশের অভিভাবকরা সন্তানদের অষুধগেলা করে লেখাপড়া শিখিয়ে দিতে চান। আর সেই সুযোগও নিচ্ছে কিছু শিক্ষা ব্যবসায়ী।
দেশ ভরে গেছে প্রাইভেট টিউটর দিয়ে। আচ্ছা, আমরা এমন অদ্ভুত কেন!! পাশ্চাত্যের কতরকম খেয়ালেরই তো আমরা অন্ধ অনুকরণ করে চলেছি, কিন্তু পশ্চিমা ঐতিহ্যগুলির যে আলোকময় দিকগুলি রয়েছে, সেখানে আমাদের যাত্রা নাস্তি কেন! যে বিচারবুদ্ধি থাকবার জন্যই মানুষ আজ জীবকূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আমাদের সেই বিচারবুদ্ধির তীক্ষ্ণতা আজ কোথায়? আমরা কি' শুধু অন্ধ অনুকরণ করেই চলব?
ক্লাস শেষে আমি ও মালিসা একসঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন ফ্রী পিরিয়ড। একঘন্টা পর 'অষ্টাদশ শতাব্দীর মঞ্চনাটক' বিষয়ে একটা লেক্চার আছে। লেক্চারটা ঠিক কোন hall room-এ হবার কথা আমার মনে পড়ছে না।
আমি notice board-এর দিকে চোখ বুলালাম। রুম নাম্বার D2.11। বেশ কিছু ad দেখলাম বোর্ডে টাঙানো। যেমন:- "বাড়ী শেয়ারে ভাড়া দেয়া হবে। Non-smoker মহিলাদের অগ্রাধিকার রইল।
আগ্রহীগণ নিম্নোক্ত টেলিফোন নাম্বারে যোগাযোগ করুন। " কিংবা "ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী বন্ধুরা যোগাযোগ কর। মহিলা ও পুরুষ সকলেরই আহ্বান রইল। খুব শীঘ্রিই ফ্রেন্ডলি ম্যাচের আয়োজন করা হবে। ফোন নং - ৯৫৬৫ ৭৮০৩।
" হঠাত্ একটা ad-এর উপর এসে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। "তুমি কি সেই বিশেষ নারী ? না কি এখনও অনিশ্চয়তার দোলায় দুলে চলেছ? কখনও কি তুমি অন্য এক নারীর প্রতি দুর্বার আকর্ষণবোধ করনি? বিন্দুমাত্র প্রশ্নও যদি কখনো জাগে তোমার মনে - তার উত্তর দিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মার্চের ২৮ তারিখে আমাদের প্রথম conference। সন্ধ্যে ৭টায় রেজিস্ট্রি। ৭:১৫ তে আলোচনাপর্ব শুরু হবে।
স্থান ...........। " আমি নির্বাক হয়ে শুধু চেয়ে রইলুম।
মালিসার ঝাঁকুনি খেয়ে ধ্যান ভাঙল। সে বল্লে, "কি পড়ছ এত গভীর মনোযোগে? আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপতে চাপতে না সুচক মাথা নাড়লাম, "কিছু না"। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমার classmate-রা প্রায় সকলেই জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে - বেষ্টনীবদ্ধ হয়ে যুগলমূর্তিগুলো free period উপভোগ করছে।
আমার কাছে মনে হল যেন ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে তাদের বেশ কষ্টই হচ্ছে। "মালিসা, তোমার কি মনে হয়না যে, ঘন্টাখানেক ওভাবে বেষ্টনীবদ্ধ হয়ে থাকা তাদের জন্য খুব একটা আরামদায়ক ও উপভোগ্য হবে না?" "তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, কিন্তু ওভাবে না দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে বুঝবে কি করে যে ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। এখানে তো প্রতি মাসে যুগল বদলে যায়," মালিসার উত্তর। আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। "আচ্ছা মালিসা, তোমরা বিয়ে না করেই বন্ধুদের সাথে রাত্রিযাপন কর; তোমাদের লজ্জা করে না?" মলিসা যেন আকাশ থেকে পড়ল, "এসব তুমি কি' বলছ, Anna! যে মানুষটিকে ভাল লাগল, তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক হবে না তো কার সাথে হবে? কেন তোমরা কি' তোমাদের প্রমিকদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখ না?" "বিয়ের আগে কখনো নয়।
আমাদের দেশে অনেক মহিলার স্বামীর সাথে বিয়ের আগে চেনা-পরিচয়ই থাকে না!" আমার কন্ঠস্বরে গর্ব উপচে পড়ছে। ভুত দেখার মত চমকে উঠল মালিসা। "বল কি! চেনা নেই, পরিচয় নেই, সম্পূর্ণ অপরিচিত, অদেখা মানুষের সঙ্গে ঘুমুতে তোমাদের লজ্জা করে না!" আমার গলায় কথা আটকে গেল। সেই মুহূর্তে বলবার মত কোন কথা খুঁজে পেলাম না।
ইউনি. শেষে হোস্টেলের পথে রওয়ানা দিচ্ছি।
ট্রেন ও বাসে চড়ে এসেছি, এখন পয়ে হাঁটা পথ দু'মিনিটের। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আকাশে রূপোলী থালার মত মায়াবী চাঁদ। বাংলাদেশের চাঁদের চাইতে এখানে চাঁদকে দেখতে অনেক বড় দেখায়। ভৌগোলিক কারণে হয়তো।
পথের দু'পাশে পাইন গাছের সারি। আসন্ন শরতের মৃদুল বাতাস শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুরে সরে যাচ্ছে। প্রাণভরে এই নৈসর্গিক সুধা পান করছি আমি। হঠাত্ Dickson-এর সাথে দেখা। Dickson আমার সহপাঠী।
আমাকে দেখেই Dickson চেঁচিয়ে "হ্যাল্লো Anna" বলেই যত জোরে সম্ভব jogging করতে করতে ছুটল। প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও এরা কিভাবে এমন আবেগশূন্য গলায় কথা বলতে পারে - আমি তাই ভাবতে থাকলুম।
নাওয়া-খাওয়া সেরে হোস্টেলে আমার রুমে গিয়ে বসেছি। জানালা গলে পূর্ণেন্দুর তরল জ্যোত্স্না এসে আমার ছোট্ট ঘরটাকে আলোকিত করে দিচ্ছে। আমি ঘর অন্ধকার করে জ্যোত্স্নার আলোয় বসে রয়েছি জানালার পাশে।
দূ--রে 'West Gate Bridge' আর Melbourne City-এর বিন্দু বিন্দু আলোর ঝরণা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। পাশের রুমে Hi-Fi stereo-তে full volume-এ গান বেজে চলেছে -- "Let’s talk about sex, baby! Let’s talk about you and me! "
আমার বহু, বহুদূরের ফেলে আসা ছোট্ট একটা মোহময় দেশের কোমল মানুষগুলির কথা মনে পড়ছে। অয়ন আমায় মাঝে মাঝে বলত, "আন্মনা, তুমি শ্রী যতীন্দ্র মোহন বাগচীর লেখা এই পংক্তিদু'টো পড়েছ কখনও? আমার খুব প্রিয় লাইনদু'টো ---
"অমা যামিনীর গহীন আঁধারে চুপিচুপি এলে প্রিয়া,
দ্বিগুণ আঁধার খর্জুর বীথি, তাহার আড়াল দিয়া। "
সংকোচে কখনও আমায় ভালবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি অয়ন। বলবার অবশ্য প্রয়োজন ছিলনা কোন।
যেখানে ভাব আছে, সেখানে ভাষার বাহুল্য না থাকলেও চলে। আমি আন্মনা হয়ে রূপসী তন্বী চাঁদের পানে চেয়ে রই। আমি এখানে আন্মনা নই, আমি অ্যানা।
বাদুড়ের গল্পটা আপনাদের জানা আছে নিশ্চয়ই। সেই যে একবার পৃথিবীর সব পশু আর পাখিদের মধ্যে লড়াই চলল।
কে পৃথিবীতে শাসন চালাবে এই নিয়ে লড়াই। তিনদিন ধরে চলল তাদের লড়াই। প্রথম দিনে পশুরা জয়ী হয়ে গেল। বাদুড় সঙ্গে সঙ্গে পশুদের দলে যোগ দিল। বাদুড় পশুদের ডেকে বলল যে, আমি তো আমার ছানাদের স্তন্যদান করি।
আমি তাই পশু -- আমি তোমাদের দলে। পশুরা তাকে খুশীমনে দলে টেনে নিল। দ্বিতীয় দিনে দ্বিপ্রহরে পাখিরা জয়ী হয় হয়। বাদুড় উড়ে চলে এল পাখিদের ডেরায়। "শোন পাখি বন্ধুগণ," ফূর্তির গলায় চেঁচিয়ে উঠল বাদুড়, "আমি চমত্কার উড়তে জানি।
আমি তাই পাখি। আমি এখন থেকে তোমাদের দলে। পাখিরাও খুশীমনে তাকে দলে টেনে নিল। তৃতীয় দিনে বিকেলে পশুর দল জয়ী হয় হয়। বাদুড় ছুটে এল পশুর আড্ডায়।
"আমি তোমাদের দলে!" সেদিন রাতেই পশু আর পখিদের সন্ধি হয়ে গেল। পাখিদের রাজ্য আকাশে, আর পশুদের রাজ্য মাটিতে। তারপরই সকলে হতভাগা বাদুড়ের পানে তাকালো। "যাও তুমি পাখিদের রাজ্যে তোমার চমত্কার পাখা নিয়ে" -- হুংকার দিল বনরাজ সিংহ। বাদুড় পাখিদের দলের কাছাকাছি পৌঁছুতেই ধেয়ে এল গরুড় পাখি।
"তুমি বলেছিলে যে, তুমি ছানাদের স্তন্যদান কর -- তুমি তাই পশু; তুমিতো পশুদের আড্ডায় আশ্রয় নিয়েছিলে। বেরিয়ে যাও এখন পাখিদের রাজ্য থেকে!" বাচারা বাদুড় তাই এখন অন্ধকার রাত্রি ছাড়া ঘর থেকে বেরোয় না। দিনের আলোতে লুকিয়ে থাকতে হয় ওদের -- পৃথিবীতে আলোর বন্যার কণামাত্রও তাদের ভাগ্যে কোনদিন আর জুটবে না।
আমি জানি, বহুদিন পর যখন দেশে যাব, আর সেদেশের মানুষগুলোর সাথে, সেদেশের পরিবেশের সাথে কিছুতেই মিলেমিশে একাকার হতে পারব না, খাপ খাওয়াতেও পারব না হয়তো নিজেকে। সেদেশে সবকিছুই আগের মতই, কেবল বদলে যাব আমি।
এই বিশাল ভুবনে আমার কোন ঠিকানা থাকবে না। রহস্যময়ী চাঁদ কি' সে কথা বুঝে ফেলেছে! কি' স্নিগ্ধ মায়ায় সে আমার পানে চেয়ে রয়েছে।
**মুখবন্ধ: 'বাদুড়' লিখি যখন আমি ছিলাম একজন teenager।
'বাদুড়' ১৯৯২ তে লেখা হয়েছিল এবং মেলবোর্ণের স্থানীয় একটা বাংলা পত্রিকায় (নাম মনে না থাকায় আন্তরিক ভাবে লজ্জিত) একই সালে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে কখন যে ইয়ারা (Yarra River) নদীতে জল গড়িয়ে গেছে প্রায় কুড়ি বছর, টেরই পাইনি একদম।
কুড়িটা বছর! এর মধ্যে পৃথিবী তার অক্ষপথে ঘুরেছে সাত সহস্র বার। পৃথিবী ঘুরেছে, পৃথিবী বদলেছে। বদলেছি আমি নিজে। কুড়ি বছরের পথ পরিক্রমায় অসংখ্যবার জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আবর্তিত হয়েছি 'আমি'। তাই, ১৯৯২ -এর 'আমি'-র সম্মানার্থে হুবুহু একইভাবে লেখাটাকে upload করলাম সামুতে, যদিও ২০১১ এর 'আমি' চাইছিল লেখাটার কিছু কিছু অংশে কাঁচি চালনা করতে।
এই যেমন:- "করলুম", "খেলুম" শব্দগুলো (এখন হাস্যকর শোনাচ্ছে), কিংবা টাকার হিসেবগুলো। কিন্তু প্রত্যেকটা লেখকেরই বাক্-স্বাধীনতা আছে। তাই, ২০১১ -এর 'আমি'-র কোন অধিকার নেই ১৯৯২ -এর 'আমি'র লেখায় কাঁচি চালাবার। সম্মানিত পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম মন্তব্যের ভারটুকু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।