মাঝে মাঝে...জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতে চাই... মানুষের চরিত্রে যে কয়টি দোষ থাকা সম্ভব, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপটি মনে হয় হিংসা—তার কারণ এটাকে নিজের ভেতর থেকে সহজে দূর করা যায় না। আজ (৩ জুন) সকালে এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটি অব টেকনোলজি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি) সব পিএইচডি শিক্ষার্থীর হুড পরানোর উৎসবে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রায় সাড়ে ৪০০ শিক্ষার্থী এই বছর এমআইটি থেকে ডক্টরেট পেয়েছে, আগামীকাল (৪ জুন) তাদের সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আর নির্দিষ্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পিএইচডি পাওয়া প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নিজ হাতে তাদের হুড পরিয়ে দিয়েছেন, আগামীকাল তারা সেটি পরে সমাবর্তনে যাবে। এমআইটির ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১০ হাজার, তাদের ভেতর থেকে বছরে সাড়ে ৪০০ ডক্টরেট বের হয়।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার, আমরা বছরে নিয়মিতভাবে একজন ডক্টরেটও বের করতে পারি না। কাজেই এমআইটির আনন্দোচ্ছল অনুষ্ঠানে বসে বসে আমি যদি হিংসায় জর্জরিত হই, কেউ নিশ্চয়ই আমাকে দোষ দিতে পারবে না!
আমি জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করা নেহাতই গাধামো (বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগে আমি এই দেশে ১৮ বছর কাটিয়ে গেছি। কাজেই এই বিষয়টা আমার থেকে ভালো করে আর কে জানে?)। যে জিমনেসিয়ামে বসে আমি অনুষ্ঠানটি দেখেছি, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে রকম একটি জিমনেসিয়াম পর্যন্ত নেই—কাজেই গবেষণার সঙ্গে তুলনা করি কেমন করে? কিন্তু কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝে—আমি নির্বোধ নই—এমআইটির সঙ্গে তুলনা করে আমি হিংসায় জর্জরিত হয়েছি সত্যি কিন্তু আমি যন্ত্রণায় কাতর হয়েছি অন্য কারণে! কারণটি ব্যাখ্যা করলে সবাই বিষয়টি বুঝতে পারবে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) সিলেটে এবং মাত্র কিছুদিন আগে আমরা আবিষ্কার করেছি, আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি আসলে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়—সেটি পড়েছে ভারতবর্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম আসাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং আরও বেশ কয়েকজন অধ্যাপক কর্মকর্তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। আমাদের সঙ্গে শিক্ষা গবেষণা বিনিময়ের একটা চুক্তিও স্বাক্ষর করে গেছেন। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম, তাঁরা সবাই বাঙালি—কাজেই দীর্ঘ সময় আমরা খুব সহজভাবে কথা বলতে পেরেছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি যে ভারতবর্ষের এই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের পরে যাত্রা শুরু করেছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পিএইচডি শিক্ষার্থী একজনও নেই (বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি বিভাগে মাত্র কাজ শুরু হয়েছে) অথচ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০০। হ্যাঁ, আমি লিখতে গিয়ে ভুলে একটা শূন্য বেশি দিয়ে দিইনি—আসলেই এক হাজার ২০০।
প্রায় একই সঙ্গে তৈরি হওয়া দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে নিয়মিত পিএইচডি একজনও নেই, অন্যটিতে পিএইচডির সংখ্যা এক হাজার ২০০। তার পেছনের কারণটি কেউ কি বলতে পারবে? আমি জানি, এই দেশের খবরের কাগজ, মিডিয়া এবং আমলারা আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুই চোখে দেখতে পারে না। তাঁরা নিশ্চয়ই ভুরু নাচিয়ে বলছেন, ‘কারণ খুবই সহজ! ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লেখাপড়া করেন, গবেষণা করেন! আমাদের শিক্ষকেরা দলাদলি করেন, লাল-নীল রাজনীতি করেন! সেই জন্য এই অবস্থা!
যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি, তাই আমি সব সময়ই আমাদের সমালোচনাটি মাথা নিচু করে মেনে নিই, কিন্তু এবারে সবিনয় প্রকৃত তথ্যটি দিতে চাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পিএইচডি একজনও নেই, কারণ সরকার থেকে এ জন্য একটি কানাকড়িও দেওয়া হয় না। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ২০০, কারণ তাদের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে মাসে ১২ হাজার রুপি করে বৃত্তি দেওয়া হয়। যদি আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের এ রকম বৃত্তি দিতে পারতাম, তাহলে আমরাও এ রকম পিএইচডি শিক্ষার্থী পেতে পারতাম। (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রজেক্ট চালু হয়েছে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রজেক্টের আওতায় কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছে, তারা দু-একজন পিএইচডি ছাত্রছাত্রী নিতে পেরেছে—কিন্তু আমি আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এটা নিয়মিত কিছু নয়। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
)
২.
আমি সুযোগ পেলেই সবাইকে মনে করিয়ে দিই, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব দুটি, এক: জ্ঞান বিতরণ করা, দুই: জ্ঞান সৃষ্টি করা। এই দুটি মূল দায়িত্বের একটি আমরা হয়তো জোড়াতালি দিয়ে পালন করছি, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছি না। জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে গবেষণা করতে হয় আর সত্যিকার অর্থে গবেষণা করার জন্য দরকার মাস্টার্স এবং বিশেষ করে, পিএইচডি ছাত্রছাত্রী।
কাজেই কোন বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু জ্ঞান সৃষ্টি করছে, তার সবচেয়ে সহজ হিসাব হচ্ছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রী নেই, বুঝে নিতে হবে সেখানে গবেষণাও নেই! (তার পরও আমাদের দেশে প্রায় নিয়মিতভাবে কিছু কনফারেন্স হয়, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা এবং শিক্ষকেরা গবেষণা পেপার প্রকাশ করেন—দেশের তুলনায় তার পরিমাণ খুবই কম। কিন্তু তার পরও যাঁরা এই ধারাটি কষ্ট করে ধরে রেখেছেন, তাঁদের অভিনন্দন জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। )
৩.
কেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এক হাজার ২০০ পিএইচডি ছাত্রছাত্রীকে মাসে ১২ হাজার টাকা করে বৃত্তি দিতে পারে এবং আমরা একজনকেও পারি না, তার কারণটি কি কেউ জানতে চান? কারণটি খুবই সহজ, ভারতবর্ষ শিক্ষার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছে। তারা শিক্ষার জন্য টাকা খরচ করতে পারছে।
আমরা এখনো শিক্ষার গুরুত্বটি ধরতে পারিনি—আমরা তাই শিক্ষার জন্য টাকা খরচ করতে শিখিনি। পৃথিবীর সব দেশ মিলে ঠিক করেছিল, পৃথিবীটাকে একটা সুন্দর জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সবাইকে শিক্ষা দিতে হবে, এই প্রতিটি দেশ অঙ্গীকার করেছিল, তারা তাদের বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষার পেছনে খরচ করবে। ডাকার চুক্তি নামে সেই চুক্তিতে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করে এসেছিল, কাজেই বাংলাদেশেরও জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষার জন্য খরচ করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ খরচ করে মাত্র ২ দশমিক ৪ ভাগ। ভারতবর্ষ খরচ করে শতকরা ৪ ভাগ।
তাই তাদের ছোট একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো সময় এক হাজার ২০০ পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকে—আমাদের একজনও থাকে না।
কেউ যেন মনে না করে, আমি এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করার জন্য বসেছি। আমাদের অর্জন কিন্তু কম নয়। অর্থনৈতিক ভিত্তি তুলনা করলে ভারতবর্ষ থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে, তাদের জিএনপি ১১৭০ ডলার, বাংলাদেশের মাত্র ৫৯০ ডলার। কিন্তু অমর্ত্য সেন তাঁর একটি লেখায় বাংলাদেশ আর ভারতবর্ষ তুলনা করে দেখিয়েছেন (Quality of life: India Vs. China, The New York Review of Books, May 12, 2011) বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি (৬৬.৯ বছর বনাম ৬৪.৪ বছর) পাঁচ বছর থেকে কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কম (৫.২ শতাংশ বনাম ৬.৬ শতাংশ) ডিপিটি ভ্যাকসিন দেওয়া শিশু বেশি (৯৪ শতাংশ বনাম ৬৬ শতাংশ)।
অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা কম (৪১.৩ শতাংশ বনাম ৪৩.৫ শতাংশ), জন্মহার কম (২.৩ বনাম ২.৭), স্কুলের সময় বেশি ৪.৮ বছর বনাম ৪.৪ বছর)। পুরুষের সাক্ষরতা ভারতবর্ষে বেশি হলেও নারী সাক্ষরতায় বাংলাদেশ এগিয়ে। অমর্ত্য সেন লক্ষ করেছেন যে কম বয়সী মেয়েরা বাংলাদেশে লেখাপড়ায় ছেলেদেরও ডিঙিয়ে গেছে। তাঁর ধারণা, বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে আমাদের এই মেয়েরা অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে। জিএনপি ভারতবর্ষের অর্ধেক হওয়ার পরও বাংলাদেশের এ রকম অভাবনীয় সাফল্যের জন্য অমর্ত্য সেন একদিকে যে রকম সরকারের ভূমিকার কথা বলেছেন, ঠিক সে রকম গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের সৃজনশীল ভূমিকার কথা বলেছেন।
(না, আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে এই দেশে কীভাবে অসম্মান করেছি, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো সেটা ভুলতে পারি না!)
অমর্ত্য সেন অনেকগুলো বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি না দেখালেও আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি যে দেশের অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক কিছু ঘটেছে, কিন্তু আমরা আরও কিছু চাই। খুব সহজভাবে বলা যায়, ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রতিবছর অন্তত কয়েক হাজার পিএইচডি বের হওয়া দরকার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা মোটামুটি একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, কিন্তু এই দেশের উচ্চশিক্ষা আধুনিক পৃথিবীর তুলনায় মোটামুটি প্রাগৈতিহাসিক যুগে পড়ে আছে। বাংলাদেশকে যদি আধুনিক দেশে তৈরি করতে হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষাকে আধুনিক করতে হবে আর সেটা করা সম্ভব, যদি আমরা প্রতিবছর অন্তত কয়েক হাজার পিএইচডি বের করতে পারি।
৪.
আমি ছোট একটা হিসাব করে দেখেছি, একজন ছাত্রকে যদি পিএইচডি করতে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতি মাসে আনুমানিক ১৫ হাজার টাকা বৃত্তি দেওয়া দরকার (ভারতবর্ষের ১২ হাজার রুপির তুলনায় সেটা যথেষ্ট কম কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে এর থেকে বেশি হয়তো এ মুহূর্তে বিবেচনা করা সম্ভব নয়)। একজন শিক্ষার্থীর পিএইচডি করতে কমপক্ষে চার বছর লেগে যায়, কাজেই মোটামুটি ১০ লাখ টাকা খরচ করা হলে এই দেশে একজন পিএইচডি তৈরি করা সম্ভব। গবেষণার একটি খরচ আছে, আমি ধরে নিচ্ছি, শিক্ষার্থীর মাসিক বৃত্তি ছাড়াও গবেষণার এই খরচটিও এখান থেকে দেওয়া হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খরচ আরও অনেক বেশি। আমি ধরে নিচ্ছি, প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খানিকটা অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে, তারা সেটা ব্যবহার করতে পারবে।
কাজেই খুব সহজ একটা হিসাব, প্রতিবছর এক হাজার পিএইচডি বের করতে হলে সরকারকে ১০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। আমি খবরের কাগজে দেখেছি, এই বছরের বাজেট এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা—সেখান থেকে ১০০ কোটি টাকা আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া কি কঠিন কোনো ব্যাপার? আমরা যদি এক হাজার পিএইচডি বের করতে পারি, সেটা এই দেশের জন্য কত বড় একটা ব্যাপার হতে পারে, কেউ কি চিন্তা করে দেখেছে? প্রথমত, তারা আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলের সত্যিকারের শিক্ষক হতে পারবে। পিএইচডি করার সময় তারা যে গবেষণার পদ্ধতিটি শিখে নেবে, সেই জ্ঞানটুকু তারা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পিএইচডি করবে, তারা সেখানে যেহেতু সার্বক্ষণিক থাকবে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে—লেখাপড়ার মান বেড়ে যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তারা যে বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবে, সেগুলো হবে আমাদের সত্যিকারের সম্পদ!
কী কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করা যায়, সেটা চিন্তা করতেই আমার জিবে পানি এসে যায়।
সবার আগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে পারি, আমাদের ইতিহাসের এত গৌরবোজ্জ্বল একটি বিষয় কিন্তু আমরা কি সেটা নিয়ে সত্যিকারের গবেষণা করেছি? পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারে সেই জ্ঞান কি সঞ্চিত আছে? আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সবাই টের পাচ্ছি যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মের সঠিক তালিকা এখনো আমাদের হাতে নেই। আমরা যদি সত্যিকারভাবে গবেষণা করতে পারতাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই যদি হাজার খানেক পিএইচডি থাকত, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি কি এক শ ভাগ সহজ হয়ে যেত না? বঙ্গবন্ধুর মতো বর্ণাঢ্য জীবন কজনের আছে, আমরা কি তাঁকে নিয়েই গবেষণা করেছি? জনপ্রিয় বই খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু গবেষণা কি পাওয়া যায়? পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা আমাদের দেশের নেতাদের নাম কেন খুঁজে পাই না? একাত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, তাঁর ওপরে কি গবেষণা করা হয়েছে? স্বাধীনতার পর কেমন করে পঁচাত্তরে দেশ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল, সেটা নিয়ে এই দেশে কয়টি নির্মোহ গবেষণা হয়েছে?
এ বছর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী আনুষ্ঠানিকভাবে হলেও আমরা কি এই দেশে রবীন্দ্র-সাহিত্যের ওপর কয়েক ডজন পিএইচডি শুরু করতে পারি না? আমি সিলেটে থাকি, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি—তাঁর ওপর কি কয়েকটি পিএইচডি করা যায় না?
আমাদের দেশের অনেক সমস্যা আমাদের একেবারেই নিজস্ব, পৃথিবীর অন্য কেউ সেই সমস্যার সমাধান করে দেবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে পারে না? সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, অত্যন্ত রুটিন ব্যাপারের সমাধান খুঁজতে গিয়ে অনেক বিষয় বের হয়ে আসে, যেটা পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারে মাথা উঁচু করে জমা দেওয়া যায়। বাংলা ভাষাকে আমরা এখনো কম্পিউটারে পুরোপুরি উপস্থাপন করতে পারিনি—এটাকে সত্যিকার অর্থে কম্পিউটারে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়া শুরু করলে কত বিচিত্র গাণিতিক বিষয় বের হয়ে আসবে, কত নতুন অ্যালগরিদম জন্ম নেবে, আমরা কি সেটা চিন্তা করে দেখেছি? বিজ্ঞান, যার প্রযুক্তিতে আমাদের অবদান সবচেয়ে কম, কিন্তু দেশকে যদি সামনে নিতে হয়, আমাদের যেভাবে হোক এখানে অবদান রাখতে হবে—সেটা সম্ভব শুধু এই ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করে।
একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা এ দেশে কি পাটের জিনোম বের করিনি?
আর কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের দেশের বাজেট দেওয়া হবে। সেই বাজেটে এক হাজার পিএইচডি তৈরি করার জন্য কি ১০০ কোটি টাকা আলাদা করে রাখা সম্ভব?
আসামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি এক হাজার ২০০ পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকতে পারে, তাহলে কি আমাদের সারা দেশ মিলিয়েও এক হাজার পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকতে পারে না?
৩.৬.১১
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।