সুরের সাথে সুর মেলাও...
লেখাটা আমার এত ভাল লাগছে যে, ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখলাম (নিজের জন্য)।
সাদাসিধে কথা
এখন তারুণ্যের সময়
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
ক্যাথলিক চার্চ ১৯৯২ সালে গ্যালেলিওকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা করেছে। গ্যালেলিওর অপরাধ প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে তিনি বলেছিলেন পৃথিবী সুর্যের চারপাশে ঘোরে। এমনি এমনি বলেননি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু ধর্মান্ধ মানুষেরা তাঁর কথা শুনতে রাজি হয়নি, তাঁকে বাকি জীবন ঘরের ভেতরে বন্দী করে রেখেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহটিকেও ঠিকভাবে সমাহিত করতে দেয়নি।
কাজটি যে ভুল হয়েছে সেটা বুঝতে তাদের ৩৬০ বছর লেগেছে, প্রায় একই সময় একই অপরাধে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তাঁকে এখনো ক্ষমা করা হয়নি।
পৃথিবীতে যুগে যুগে এই ধর্মান্ধ মানুষেরা পৃথিবীটাকে পেছনে টেনে রাখার চেষ্টা করেছে, ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায় ধর্মের নামে এই ধর্মান্ধ মানুষগুলো কোনো অপরাধ করতে পিছপা হয়নি। তারা শেষ হয়ে যায়নি এখনো আছে, ১৯৭১ সালে আমরা এই দেশে সেটা দেখেছি। বাংলাদেশ হলে এই দেশে ইসলাম ধর্ম থাকবে না সে কথা বলে এই দেশে কত লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল মনে আছে? ভারতবর্ষে শিবসেনা, আফগানিস্তানে তালেবান, যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যান, ইউরোপে নিউ নাৎসি−শুধু তাদের ধর্মটা ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য কাজকর্ম সবকিছু এক, ধর্মের কথা বলে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পৃথিবীটাকে পেছনে টেনে রাখা। (আমাদের দেশে এই ধর্মান্ধ মানুষগুলো তাদের কাজকর্মের জন্য মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে।
মজার কথা হলো, মুখে ইসলামের কথা বললেও এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নেতারা কিন্তু নিজেদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়ান না−তাদের আধুনিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান!)
ধর্মান্ধ এই শক্তিটা হচ্ছে অশুভ শক্তি, আমাদের দেশে এই অশুভ শক্তিটা কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি নিজেদের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়িত করে ফেলছে। সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন আমাদের প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত সংস্কৃতিমান আধুনিক মানুষ, তাঁর উপদেষ্টারাও প্রধান উপদেষ্টার মতো আধুনিক ও উচ্চশিক্ষিত। যেহেতু এই সরকারের পেছনে সেনাবাহিনী আছে কাজেই তাদের কথাও বলতে হয়। আমাদের সেনাপ্রধানও আধুনিক মানুষ, তাঁর বড় অফিসাররাও আধুনিক। শুধু সেনাবাহিনী নয়, আমাদের পুলিশপ্রধানও প্রগতিশীল ও আধুনিক।
যেদিকে তাকাই সেদিকেই প্রগতিশীল মানুষ, উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মানুষ, কিন্তু তাদের সবার নেতৃত্বে এই দেশে কাজগুলো কী হচ্ছে? ছোট একটা তালিকা দিই:
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা মমতাজ কিশোরগঞ্জে একটা গানের কনসার্ট করতে পারেননি। সেখানকার মৌলবাদী সম্প্রদায় আপত্তি করছিল−এটি নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে গানের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই তারা আপত্তি করে, কিন্তু তাই বলে এই দেশে গানের অনুষ্ঠান হবে না? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে না? এই রাষ্ট্রের সংবিধানে কি সেটাই লেখা আছে? যারা এই সংবিধান রক্ষায় দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় বসে আছেন, তাঁরা লজ্জার মাথা খেয়ে কেন ক্ষমতায় বসে আছেন?
নারী উন্নয়ন নীতির কথা মনে আছে? এটা ঘোষণার পরপরই কী করা হলো? নীতিটাকে বাতিল করে দেওয়ার জন্য সেটাকে কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীর হাতে পর্যালোচনার জন্য তুলে দেওয়া হলো। তারা কী করলেন? নারী উন্নয়ন নীতিটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। এখন এই নীতিটার কী অবস্থা, কেউ কি আমাকে বলতে পারবেন?
এই দেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল একজন বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার প্রকাশ্য টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে জামায়াতে ইসলামীর একজন কর্মীর হাতে নির্যাতন, সারা দেশে এটা নিয়ে কত হইচই, কত উত্তেজনা, কিন্তু সেই মানুষটিকে কী আইনের আওতায় আনা হয়েছে? আনা হয়নি।
শুধু যে শারীরিক নির্যাতন তা-ই নয়, উত্তরবঙ্গে কিছুদিন আগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মেরেই ফেলা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে কী করা হয়েছে?
অল্প কিছু মাদ্রাসার ছাত্র এসে এয়ারপোর্টের চত্বরে হইচই করার সঙ্গে সঙ্গে লালন ভাস্কর্যটি অপসারণ করে দেওয়া হলো। সারা দেশে সেটা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা, কিন্তু লালন ভাস্কর্যটি আর ফিরে আসেনি। অন্য একটি মজার ব্যাপার কি কেউ লক্ষ করেছেন? আমাদের সেনাপ্রধানের দপ্তর থেকে তড়িঘড়ি করে একটা বিবৃতি দেওয়া হয়েছে যে লালন ভাস্কর্য অপসারণে তাঁর কোনো ভুমিকা নেই, তখন তিনি দেশে ছিলেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয় অথচ দেশের মঙ্গল হতে পারে এ রকম বিষয়ে আমাদের সেনাপ্রধান কিন্তু দেশের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন, অথচ এ বিষয়ে তিনি কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এত বড় ক্ষমতাশালী একজন সেনাপ্রধান কিন্তু মাদ্রাসাছাত্রদের হুমকির মুখে একটা ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার কাজটি ভালো হয়েছে, না মন্দ হয়েছে সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট কথা বলার সাহস তাঁর নেই!
গত দুই বছরে কত পুরোনো মামলার তদন্ত নতুন করে করা শুরু হয়েছে।
কিন্তু চট্টগ্রামের জাহাজ ঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মামলার কী হলো? এই মামলা পুনর্জীবিত করা হলে সেই সময়ের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর নামটা উঠে আসবে, সেটাই কি কারণ?
আমাদের প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিটিং করছিলেন, তখন আমরা একদিন সবিস্নয়ে আবিষ্ককার করলাম তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা পুলিশের ফেরারি আসামি মুজাহিদের সঙ্গে মিটিং করছেন। একজন ফেরারি আসামির সঙ্গে দেশের সরকারপ্রধান প্রকাশ্যে মিটিং করতে পারে না, সেটা কি তিনি জানেন না? তাঁকে নিষেধ করার সাহস কি তাঁর ছিল না? তিনি নিজেকে যত খুশি অপমান করতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের চেয়ারটিকে অপমান করার অধিকার কি এই দেশ তাঁকে দিয়েছে?
আমি এই তালিকাটিকে আরও অনেক দীর্ঘ করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলতে পারি, মন্ত্রণালয়ের কথা বলতে পারি, দেশের আমলাদের কথা বলতে পারি, কিন্তু আর বলতে ইচ্ছা করে না। হতে পারে এই দেশটি একটি দুঃখী দেশ, কিন্তু এই দুঃখী দেশটির জন্যই আমাদের বুকের ভেতর গভীর মমতা। সেই দেশটিতে এ রকম একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেগুলো হা-বিতং করে পত্রপত্রিকায় লিখতে কেন জানি ইচ্ছা করে না, নিজের ভেতরেই কোথায় যেন একধরনের অপমানবোধ হয়।
তার পরও এ কথাগুলো একবার হলেও বলা দরকার।
যে মানুষগুলো দেশ চালান, যে সেনাবাহিনী তাদের পেছনে রয়েছে, যে পুলিশ বাহিনী তাদের সাহায্য করছে, যে আমলারা দেশ শাসন করছে তাদের চেহারা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ−সবকিছু প্রগতিশীল আধুনিক। কিন্তু রহস্যের ব্যাপার হচ্ছে প্রগতিশীল আধুনিক মানুষগুলো দেশ চালানোর দায়িত্ব নেওয়ার পরও কিন্তু ধর্মান্ধ মানুষগুলো তাদের উদ্দেশ্যগুলো একটার পর একটা অর্জন করছে। প্রতিবারই তারা যেটা চাইছে সেটা অর্জন করে ফেলছে আর আমরা শুধু তার প্রতিবাদ করছি। প্রতিবাদ করে আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা কিছু অর্জন করতে পারিনি, একটা কিছু ফিরিয়ে আনতে পারিনি। মনে হয় একটা অদৃশ্য শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ ভাগ করে দিয়েছে, ধর্মান্ধ শক্তি যেটা চাইবে সেটা তাদের করে ফেলতে দেওয়া হবে।
আর আমাদের কপালে রয়েছে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা, প্রতিবাদ করা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করা, মানববন্ধন করা। যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা অপেক্ষা করে থাকেন কখন আমরা প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাব, কারণ আমি সরকারের একটা মানুষকেও শত প্রতিবাদের পরেও এই বিষয়ে একটিবার মুখ ফুটে একটা কথা বলতে দেখিনি।
আমাদের সবার জন্য অনেক সহজ হতো যদি যাঁরা দেশ চালাবেন তাঁদের চেহারা, বেশভুষা, পোশাক, কথাবার্তা, আচার-আচরণ মোল্লা ওমর, নিজামী, মোজাহিদ, বাংলা ভাই বা আমিনীদের হতো। তাঁরা যদি সারাক্ষণ ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতো ‘ইসলাম গেল, ইসলাম গেল’ বলে আহাজারি করতেন তাহলেও আমরা বুঝতে পারতাম। কিন্তু আধুনিক চেহারার প্রগতিশীল মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন মধ্যযুগের ধর্মান্ধ মানুষের জন্যা−এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।
২.
এয়ারপোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি নিয়ে যে ব্যাপারটি ঘটেছে সেটা নিয়ে প্রায় সবদিক দিয়ে আলোচনা হয়েছে−নতুন করে বলার আর বিশেষ কিছু নেই। যাদের লক্ষ্য করে এই আলোচনা তাদের কানে তুলো ঠেসে দেওয়া হয়েছে, কালো কাপড় দিয়ে তাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে; কাজেই সেই আলোচনা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যে কারণ দেখিয়ে ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করছে, সেই একই কারণে মানুষ (কিংবা পশু-পাখির) ছবিও ইসলামবিরোধী হওয়ার কথা। আমরা কিন্তু প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় সেই ধর্মান্ধ মানুষগুলোর ছবিই ছাপা হতে দেখছি, তাঁরা ছবি তুলে পাসপোর্ট করছেন, ভোটার আইডি করছেন, অনেক সময় গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজের ছবিসহ বিশাল পোস্টার তৈরি করেছেন। তখন কিন্তু তাঁরা একটিবারও সেটা ইসলামবিরোধী বলে আপত্তি করেননি।
মানুষের ছবি কিংবা ভাস্কর্য স্থির, নড়েচড়ে না। টেলিভিশনে সেই মানুষের ছবি বা অবয়ব শুধু যে নড়েচড়ে তা নয়, কথাও বলে। যদি অপরাধ হয় তাহলে টেলিভিশনের ছবি তার থেকে এক শ গুণ বড় অপরাধ হওয়ার কথা, কিন্তু কোথায়? আমরা তো কখনো কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে টেলিভিশন বন্ধ করে দিতে শুনলাম না! বরং উল্টোটা দেখেছি যে আলাদাভাবে ইসলামি টেলিভিশন চালু হয়েছে। সব প্রাইভেট চ্যানেলে ইসলামি মানুষেরা ইসলামের কথাবার্তা বলেন−সেটা কী তাদের যুক্তিতে ইসলামবিরোধী কাজ নয়?
ভাস্কর্য ধ্বংস করার সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছিল আফগানিস্তানে ২০০১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে। ১৭৫ ফুট উঁচু প্রাচীন বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিগুলো আফগানিস্তানের তালেবানরা ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্কোরক দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
তখন পৃথিবীর মুসলিম দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন ওআইসির (অর্গানাইজেশন অব দি ইসলামিক কনফারেন্স) ৫৪ সদস্য দেশ অত্যন্ত তীব্র ভাষায় সেটা প্রতিবাদ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, সৌদি আরব ও ইউনাইটেড আরব আমিরাত এই বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করার প্রক্রিয়াকে বলেছিল বর্বরতা। আফগানিস্তানে ভাস্কর্য ধ্বংস করার কাজটি করেছিল তালেবানরা, আমাদের দেশে সেটি করেছে সরকার। এই দুঃখ, এই ক্ষোভ এবং এই ক্রোধ আমরা কোথায় রাখি?
৩.
আমি একজনকে জানি, যার ধারণা ভালো করে খেলেই সব সমস্যা মিটে যায়−আমার অবস্থা অনেকটা সে রকম, আমি মনে করি ভালো করে লেখাপড়া করলেই সব সমস্যা মিটে যায়। এই যে আমাদের দেশের হাজার রকম সমস্যা−ধর্মান্ধতা থেকে শুরু করে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন, পরিবেশ দুষণ থেকে শুরু করে বাচ্চাদের দুধে মেলামিন−আমি মনে করি সবকিছুই শিক্ষা দিয়ে সমাধান করে ফেলা সম্ভব।
আমাদের দেশের শিক্ষায় হাজারো রকম সমস্যা, ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করতে হয়, সৃজনশীলতা দেখালেই বিপদ, প্রাইভেট না পড়ালে ভালো মার্কস পাওয়া যায় না ইত্যাদি। তার মাঝে সরকার পাকা ষড়যন্ত্রীদের মতো তক্কে তক্কে থাকে প্রজেক্টের হাজার কোটি টাকা নষ্ট করে নানা রকম ফন্দিফিকির পাস করিয়ে ছেলেমেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়−চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ।
কিন্তু সবকিছুর পরেও মনে হয় আমরা বুঝি সত্যিকার শিক্ষাটা দিতে পারছি না। এই বিষয়টি আমার মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর করে বুঝিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (এই মানুষটির সময় মতো জন্ন না হলে আমাদের যে কী হতো!); তাঁর ভাষায় সংস্কৃতি বা কালচার হচ্ছে একটা পাত্রের মতো। যার ভেতরে এই পাত্রটা আছে তার ভেতরে শিক্ষাটাকে ধারণ করানো যায়।
যার ভেতরে সংস্কৃতির পাত্রটা নেই সে যতই শিক্ষা গ্রহণ করুক সেটা জমা হয়ে থাকতে পারে না, সেটা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয় এ রকম সত্যি কথা খুব কম বলা হয়েছে, আমাদের চারপাশে এর অনেক উদাহরণ। অনেক বড় চোখধাঁধানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নেই, তাই সেখান থেকে মেধাবী চৌকস শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়ে বড়জোর একজন স্বার্থপর মানুষ হয়, তাদের নীতি থাকে না, আদর্শ থাকে না, দেশের জন্য ভালোবাসা, দেশের মানুষের জন্য মমতা থাকে না। পরিণত বয়সে যখন নিজের ভেতরে শুন্যতা অনুভব করে কোথায় আশ্রয় নেবে বুঝতে পারে না, তখন অনেক সময় তারা ধর্মান্ধতার মধ্যে নিজের ঠিকানা খুঁজে পায়।
এই বিষয়টি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী খুব ভালো করে জানে।
শিক্ষা তাদের কাছে অত্যন্ত সংকীর্ণ একটা বিষয়। সংস্কৃতি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা, সে জন্য তারা সবার আগে এটাকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। আমাদের দেশে একসময় একটা সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হতো, গহিন পাড়াগাঁয়ে বাউল গান, জারিগান, যাত্রাপালা হতো। একটা গ্রামে এক-দুজন শিক্ষিত মানুষ থাকলেই তাঁরা ছুটিছাটাতে ‘ভ্যারাইটি শো’ করতেন, নাটক করতেন। এখন যতই দিন যাচ্ছে বিষয়গুলো ততই উঠে যাচ্ছে।
ধর্মান্ধ মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে সেগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছে। সরকার ধর্মান্ধ মানুষের পক্ষে, তারা মুখ ফুটে চাওয়ার আগেই বাধা-নিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে। (এই লেখাটি লেখার সময়ে আমি একটা টেলিফোন পেয়েছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একটা চলচ্চিত্র তৈরি করেছে, সেটার প্রচার বন্ধ করার জন্য পুলিশ বাহিনী থেকে চিঠি ইস্যু করা হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ) ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে যে কাজটি করে সেটি হচ্ছে, মেয়েদের ঘরের ভেতর বন্দী করে ফেলা। যদি একান্তই ঘরের মধ্যে বন্দী করতে না পারে অন্তত বোরকার মধ্যে বন্দী করে ফেলে।
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তখন আমাদের ক্লাসের প্রায় অর্ধেকই ছিল মেয়ে, তাদের একজনও কিন্তু বোরকা পরে আসত না। তাদের মধ্যে কেউ ধর্ম প্রাণ ছিল না−সেটা সত্যি নয়। যারা ছিল তারা শাড়ি পরত, মাথায় কাপড় দিত এবং আমরা তাদের মূল্যবোধকে সম্মান করতাম। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিবেচনা করলে আজ থেকে ৪০ বছর আগে আমার সহপাঠিনীরা কম ধর্মপ্রাণ ছিল−সেটা আমি একবারও বলব না।
কাজেই আমাদের সময় হয়েছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে একটা পাত্র হিসেবে বিবেচনা করার, যেন আমরা আমাদের পুরো শিক্ষাটাকে সেখানে রাখতে পারি।
ব্যাপারটি নিয়ে আগে কেউ সে রকম মাথা না ঘামালেও আজকাল অনেকেই চিন্তা করছেন, এর জন্যে কাজ শুরু হয়েছে। অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে, যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়; নীতিহীন স্বার্থপর প্রতিযোগীর জন্ন না দিয়ে সত্যিকারের মানুষের জন্ন দেওয়া হয়।
৪.
কিছুদিন আগে আমার কাছে হঠাৎ একটা এসএমএস এসেছে। সম্ভবত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র লিখেছে, ‘স্যার, আপনারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমরা তাদের বিচার করে এই মেগা সিরিয়াল শেষ করব। ’
এই এসএমএসটিতে একধরনের সারল্য আছে, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আছে, হয়তো খানিকটা অহংকারও আছে।
কিন্তু এই কথাটি একশ ভাগ সত্যি। আমি দেখেছি আমাদের নতুন প্রজন্ন অনেক সময়েই জানে না তাদের ভেতরে কী অমিত শক্তি লুকিয়ে আছে। আমাদের তরুণেরা যদি না থাকত তাহলে বায়ান্নার ভাষা আন্দোলন হতো না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও হতো না। আমার বিশ্বাস, আমাদের তরুণেরা যদি দায়িত্ব নেয় তাহলে দেশের এই দুঃসময়ে আবার তারা একটা বড় ভুমিকা পালন করতে পারবে।
আমাদের খুব দুর্ভাগ্য, সারা পৃথিবীতেই এখন একটা দুঃসময় যাচ্ছে।
তরুণ প্রজন্নকে এখন বোঝানো হচ্ছে তুমি সুদর্শন হও, তুমি সুন্দরী হও। তুমি সুন্দর কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারো, ফুর্তি করো, টাকা খরচ করো, জীবন উপভোগ করো−কারণ, এটাই হচ্ছে জীবন। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এটা সত্যিকারের জীবন নয়। তারুণ্যের যে বিশাল একটা শক্তি আছে তার একটা অংশ তাদের দেশকে দিতে হবে, সমাজকে দিতে হবে। ধর্মান্ধতার যে আগ্রাসন শুরু হয়েছে, সেটাকে থামানোর প্রথম দায়িত্ব ছিল সরকারের।
আমরা আগে দেখেছি কোনো সরকারই সেই আগ্রাসন ঠেকাতে প্রস্তুত নয়, তারা সব সময়েই নতজানু। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আমরা এই মুহুর্তে দেখছি। ওদিকে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি পর্যন্ত করে ফেলেছিল, জোট সরকার তো সরাসরি ধর্মান্ধতায় পৃষ্ঠপোষকই ছিল। ভবিষ্যতে কোন সরকার আসবে, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না; কিন্তু যে সরকারই আসুক, আমরা অনুমান করতে পারি ভোটব্যাংক রক্ষা করার জন্য তারা সেটা ঠেকাতে এগিয়ে আসবে না। তাদের ঠেকাতে হবে এই তরুণ সমাজকে।
তাদের প্রথমেই বুঝতে হবে যে তাদের খানিকটা দায়িত্ব আছে। বিলবোর্ড, রেডিও, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, খবরের কাগজে সুদর্শন কিংবা সুন্দরী সেজে জীবনকে ভোগ করার যে ডাক দেওয়া হচ্ছে সেটি শুনলে চলবে না। তাদের জীবনের আরও অনেক গভীরে যেতে হবে। তাদের দেশের ইতিহাস জানতে হবে, কত আত্মত্যাগ করে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে সেটা অনুভব করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে হবে, একই সঙ্গে কারা এই দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেছে সেটাও জানতে হবে।
নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।
একটা সময় ছিল যখন প্রতিটি গ্রামে শীতকালে নাটক হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো; প্রতিটি স্কুলে বিচিত্রানুষ্ঠান হতো, ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে সেসব অনুষ্ঠানের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করত। আবার আমাদের সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন ছুটিছাটায় নিজ এলাকায় যাবে, তাদের সেই এলাকার দায়িত্ব নিতে হবে। নিজের স্কুলে গিয়ে নিজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আবার তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে গান গেয়ে রাতারাতি টেলিভিশনের স্টার হতে চাইলে হবে না, গান গাইতে হবে সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, উজ্জীবিত করার জন্য।
যুদ্ধাপরাধীরা যখন এই দেশের শেকড় ধরে টান দিয়েছে তখন আমাদের সেক্টর কমান্ডার থেকে শুরু করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অনেক শহীদ পরিবার, অনেক দেশ প্রেমিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তরুণ প্রজন্নকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে, নিজেদের নেতৃত্ব দিতে হবে। আমি অত্যন্ত বেদনাহত হই, যখন দেখি খেলাঘরের মতো শিশু-কিশোরদের সংগঠন দুই ভাগে বিভক্ত কিংবা প্রজন্ন ’৭১-এর মতো তারুণ্যের সংগঠন দুই ভাগে বিভক্ত। দেশের অনেক বড় প্রয়োজনে তাদের একত্র হতে হবে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য পুরোপুরি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার যে কী আনন্দ, তাদের তা একটিবারের জন্য হলেও অনুভব করার সুযোগ করে দিতে হবে।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, প্রতিটি বিপর্যয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনার একটা সুযোগ। আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আমাদের তরুণ সম্প্রদায় সেখান থেকে সম্ভাবনার সুযোগ বের করে আমারে উপহার দেবে−আমি সেই আশায় বুক বেঁধে আছি।
১৮.১১.০৮
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক।
অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।