সকাল থেকে একের পর এক টেলিফোন ‘খবরটি কি আপনি জানেন?’ প্রশ্নটির উৎপত্তি ঘটেছে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর ছোট্ট একটি খবর থেকে। শিরোনাম ‘লিমন সম্পর্কে বাসসের খবর এবং প্রত্যাহার’। এই ছোট্ট খবরটি যতখানি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, কৌতূহলের উদ্ভব ঘটিয়েছে তার চেয়ে আসল তথা প্রত্যাহূত খবরটি যদি ছাপাও হতো, পাঠকসমাজে এত তোলপাড় হতো না বলেই আমার ধারণা। বরং লিমনের পা খোয়ানো নিয়ে সরকার ও র্যাব যে বিড়ম্বনায় পড়েছে তার অবসান হতো।
কী সেই ‘বাতিল’ ও প্রত্যাহূত খবর? স্বভাবতই সাংবাদিকতার এথিকস তথা নৈতিকতা অনুসরণে অধিকাংশ পত্রিকা খবরটি ছাপেনি।
কিন্তু ইতিমধ্যে খবরটি আমি সন্ধ্যায় কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে, মানে পর্দার নিচের অংশে চলমান শিরোনামে দেখেছি। তদুপরি মফস্বলের সুদূর অঞ্চলে সন্ধ্যারাতে পাঠানো প্রায় সব পত্রিকার প্রথম সংস্করণে খবরটি ছাপা হয়ে গেছে বলে ঢাকার বাইরের কয়েকজন পাঠক আমায় জানিয়েছেন। অনলাইন ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে খবরটি দেশ ও বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই কারণে আমার মাথায় সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল কিলবিল করতে লাগল—জানতে হবে ঘটনাটি কী?
সরকার-নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা বাসস বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষায় খবরটি প্রচার করে। সন্ধ্যায় পরিবেশিত ও রাতে বাতিল হওয়া খবরটি ইতিমধ্যে কয়েকটি অনলাইনে পড়লাম।
পড়ে অবাক হয়ে ভাবলাম, এমন একটি চমৎকার খবর কে বা কারা ও কেন প্রচার হতে দিল না? খবরটি নিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করার আগে অনলাইন থেকে খবরটি উদ্ধৃত করছি। এই উদ্ধৃত করার ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, বন্দুক থেকে ছোড়া গুলি ফিরিয়ে আনা হয়নি।
আমি খোসাসমেত কুড়িয়ে পেয়ে এখন সবাইকে দেখাচ্ছি। তা ছাড়া ‘বাসস’ বলেছে বাতিল, আমি বলছি প্রত্যাহূত। তারা বলেনি, তাদের পরিবেশিত অজানা কারণে বাতিল খবরটি মিথ্যা ছিল।
অসত্য খবর পরিবেশনার জন্য সাংবাদিকতার রীতি অনুসরণে দুঃখও প্রকাশ করেনি। আমার সাংবাদিকতায় লব্ধ অভিজ্ঞতায় সংজ্ঞাটি হবে প্রত্যাহূত, ডিসকার্ডেড অথবা কিলড, মানে ‘ছুড়ে ফেলে বা খতম করে দেওয়া’ বলতে যা বোঝায়, বাসস তা করেনি।
হাজারো বা লক্ষ পাঠকের অজানা কুড়িয়ে পাওয়া বা সংগৃহীত খবরটি হুবহু উদ্ধৃত করছি। বাসসের খবরের ড্রপ-লাইন, মানে আগাম ইঙ্গিতসূচক আগাম বার্তা ছিল, ‘বাসস দেশ-৩১/ র্যাব লিমন শেখ হাসিনা (লিড)’ তারপর বিস্তারিত খবর: ‘লিমনকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করতে সরকারি নেতৃবৃন্দের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ: সূত্র ঢাকা, ১ জুন (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিমন “সন্ত্রাসী” এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত কোন তদন্তে প্রমাণিত না হওয়ায় তার বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য না করতে সরকারি নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র আজ এ কথা জানান।
‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সূত্র আজ বাসসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্স সফর শেষে দেশে ফিরে লিমনের ঘটনা তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত হওয়ার পর এই নির্দেশ দেন।
‘সূত্র জানান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে লিমনের সম্পৃক্ততা আছে, এমন কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত তদন্তে এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি।
‘সূত্র আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী কলেজ ছাত্র লিমনের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
‘সূত্র বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে নিরপরাধ মানুষের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব সময়ই শেখ হাসিনা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন এবং সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন ফোরামে তা ব্যক্ত করেছেন।
‘চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়।
পরবর্তীতে ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা করা হলে আমি তার প্রতিবাদ করি। ”
‘ওই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আরও বলেন, কিছু সন্ত্রাসী নিহত হওয়ায় এই ব্যবস্থা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে বলে মনে হওয়ায় সেদিন কেউ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। একমাত্র তিনিই তাঁর সহকর্মীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে এর প্রতিবাদ করেন।
‘তিনি বলেন, “আমার পিতার (বঙ্গবন্ধু) একটি উক্তি, তিনি বলতেন, একজন নেতা জনগণ দ্বারা চালিত হন না বরং জনগণকে পরিচালিত করেন। এ কারণে জনগণের কাছে বিষয়টি আপাত প্রশংসা পাচ্ছে জেনেও আমি এর প্রতিবাদ করি।
আমি যদি বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থন করতাম তাহলে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই আমি আমার পিতার হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারতাম। ”’
কী চমৎকার মননশীল বক্তব্য! আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যসংবলিত সংগৃহীত সংবাদটিতে তাঁর মানবতাবোধের পরিচয় পেয়েছি। তাঁর ও আওয়ামী লীগ সরকারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি জানিয়ে দিলেন, জনগণ কথায়-কথায় তাঁকে এমনিতে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সন্তান’ বলে না।
আমার অবাক লাগছে, লিমন-সম্পর্কিত যে ঘটনা নিয়ে বহির্বিশ্বে ও দেশে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে যেসব প্রচার চলছে, সেসব স্খলন করে দিয়েছে এমন একটি সংবাদ কেন প্রত্যাহার অথবা বাতিল করা হলো।
একই সঙ্গে ভাবছিলাম, অতীতে স্বৈরাচারী ও সামরিক একনায়কত্বের আমলে যেভাবে সংবাদ চাপা দেওয়া হতো, জেনারেল জিয়া ও এরশাদের শাসনকালে ‘প্রেস অ্যাডভাইস’ নামে উপদেশ প্রদানের ভণ্ডামি করা হতো, সেই প্রথা কেন ভিন্ন রূপে ফিরে আসবে। তাও একটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সরকারের আমলে?
এবার বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত ছোট্ট কৌতূহলোদ্দীপক বাসসের ‘বাতিল’ করা নিয়ে ছোট্ট একটি খবর দিয়ে অগণিত পাঠকের কৌতূহল সৃষ্টির কৌশলটির জন্য বার্তা সম্পাদকের প্রশংসা করছি। মনে পড়ছে, দীর্ঘ ৬০ বছরের সাংবাদিকতা-জীবনের ৩০ বছরই যখন কাটিয়েছি নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে, তখন তা থেকে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসার এমনি সব চমৎকার কৌশল অবলম্বন করেছি। সেই সব কৌশল প্রয়োগের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। এক. আটান্নতে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শহীদ দিবস পালন, শোক মিছিল ও ছাত্রদের খালি পায়ে পদযাত্রার ওপর লাঠি চার্জের খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হলো।
আমি তখন পাকিস্তান অবজারভার-এর বার্তা সম্পাদক। এই নিষেধাজ্ঞার ফাঁক বের করলাম। পরদিন অবজারভার-এর প্রধান খবরের শিরোনাম: টুয়েন্টিফার্স্ট ফেব্রুয়ারি অবজারভড, নো মর্নিং প্রসেশন, টেন ইনজিউরড। বাংলা অর্থ হলো—একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত। কোনো শোক মিছিল হয়নি।
১০ জন আহত। পরদিন অফিসে ছুটে এলেন তৎকালীন উপসামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল ওমরাও খানের তথ্য কর্মকর্তা কর্নেল আবদুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি এর আগে লাহোরের পাকিস্তান টাইমস-এর সাংবাদিক ছিলেন, সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। আমার দিকে মুচকি হেসে বললেন, ‘মুসা ভাই, প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু বি টু ক্লেভার ইন ফিউচার। ’ মানে ‘ভাইজান, এইবার সামলিয়েছি, ভবিষ্যতে এমন চালাকি করবেন না।
’ দুই. ইয়াহিয়ার আমলের একটি চালাকি তথা বাতিল নয়, চাপা দেওয়া খবর প্রকাশের কৌশলটি উল্লেখ করছি। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পর, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় সমালোচনা হচ্ছে। হাজার থেকে লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে মৃতের সংখ্যা। সামরিক শাসক জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবের সামরিক তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালেক, পরবর্তীকালের ইয়াহিয়ার তথ্যসচিব, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন, কোনো পত্রিকা ‘অসমর্থিত’ মৃতের ‘বাড়াবাড়ি’ সংখ্যা ছাপতে পারবে না।
আমি তখন ঢাকায় বিবিসির স্ট্রিংগার, খণ্ডকালীন সংবাদদাতা। আমি বিবিসিতে এক দিন পর পর পাঠাতাম লক্ষাধিক মৃতের সংখ্যার খবর। পরদিন আমার পাঠানো খবর আমি ছাপতাম অবজারভার-এ, ‘অ্যাকর্ডিং টু বিবিসি’ মানে বিবিসিতে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছে, নিঝুম দ্বীপে অথবা মনপুরায় কালকে এত হাজার মৃতদেহ সমুদ্রের পানিতে ভাসতে দেখা গেছে।
ওপরে উল্লিখিত পন্থায় খবর প্রকাশের সময়কাল ছিল যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তথ্য প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার একটি আইন প্রণয়নের কৃতিত্বের অধিকারী, মুক্ত সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রশংসা অর্জনকারী সরকারের আমলে কেন একটি ‘বস্তুনিষ্ঠ’ সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না—এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে চাইব, জানি না।
লিমনের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মমত্ব, বিচারবহির্ভূত হত্যায় যে তাঁর অনুমোদন বা সমর্থন নেই, এই সত্যটি তাঁর ও বর্তমান সরকারের দেশে-বিদেশে ক্ষীয়মাণ মর্যাদাকে বর্ধিষ্ণু করতে পারত। বর্তমান সরকারের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইতিবাচক প্রচারের বিষয়বস্তু হতে পারত। খবরটি বাতিল করার কারণে উল্টোটি ঘটছে, লিমনের খবর নতুন মাত্রা পেয়েছে। ছাপা না হওয়া খবর এখন নতুন খবরের উপাদান হয়েছে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।