আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলসে সাংবাদিকের অন্যরকম এভারেষ্ট জয়!

আমি আলসে প্রকৃতির মানুষ। শারিরীক পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করে না। নেপালে গেছি কয়েকবার; একবার মাসখানেকও ছিলাম। দূর থেকে সেবার এভারষ্টেকে দেখেছি। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পাহাড় বেয়ে, কখনো এভারেষ্টের চূড়ায় ওঠার সামর্থ্য কিংবা ইচ্ছে কোনটাই হয়নি।

তারপরেও আমার এভারেষ্ট জয়ের একটা অনুভুতি হয়। সেটা বাংলাদেশের দুই এভারেষ্ট জয়ী মুসা ভাই আর মুহিত ভাইয়ের মাধ্যমে। আর সেটা সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে। নেপালে যেবার মাসখানেক ছিলাম সেবার গাড়িতে করে নাগরকোট ও অন্নপূর্ণার যতোখানি যাওয়া যায় আমি গিয়েছি; পর্বত দেখেছি মুগ্ধ হয়ে। সেই থেকে এভারেষ্টের প্রতি আমার এবকটা অন্য রকম ভালোবাসা ছিলো।

তবে সত্যিকারের এভারেষ্ট জয়ের স্বাদ আমি পাই কপাল গুনে। এ বছর মুহিতের এভারেষ্ট জয়ের ফলোআপ করার এসাইনমেন্টটা আমাকেই কেন যেন দেন চীফ রিপোর্টার। অবশ্য প্রবাসে যে কোন বাংলাদেশির অর্জনের খবর কাভার করাটা আমার বিটের মধ্যেই পড়ে। গত বছরও মুসা ভাইয়ের সাক্ষাতকারও আমিও নিয়েছিলাম। অবশ্য সেটা ঢাকায় আসার পর।

যাই হোক। মূল ঘটনায় যাই। এ বছরের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এভারেষ্ট জয় করেছেন এম এ মুহিত। এভারেষ্ট থেকে তিনি নেমেছেন ২৫ মে। ওইদিন ঢাকা থেকে টেলিফোনে আমি তাঁর ইন্টারভিউ করি।

টানা দেড় ঘন্টা কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আমিই বোধহয় বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক যে নামার পর তাঁর সঙ্গে এতোক্ষন কথা বললাম এবং পুরো অভিযানের বর্ণনা নিলাম। মুহিত ভাইয়ের বোনের কাছ থেকে অবশ্য আগেই নম্বরটা নিয়েছিলাম। যাই হোক মুহিত ভাইয়ের সাক্ষাতকার নিয়ে পরদিন নিউজ করলাম এভারেষ্টে চূড়ায় মুহিতের বাংলাদেশের পতাকা ওড়নোর অনুভুতি। ২৫ মে সন্ধ্যা থেকে মুহিত ভাই যখন নেপাল থেকে ফোনে আমাকে এভারেষ্ট চূড়ায় ওঠার অনুভুতি বলছিলেন তখন আমিও যেন তাঁর সঙ্গে এভারেষ্টে চলে যাচ্ছিলাম।

শত মাইল দূর থেকেও মুহিত ভাইয়ের উত্তেজনা,আমি টের পা্ছিলাম। মুহিত ভাই যেন স্বপ্নলোক থেকে বলে চলছেন এক দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প। মুহিত ভাই বলছিলেন, এভারেষ্ট চূড়ায় যখন্ বাংলাদেশের পতাকাটা ওড়ালাম তখন মনে হচ্ছিল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। মনে হচ্ছিলো্ সারা বিশ্বকে আমি দেখিয়ে দিলাম বাংলাদেশও পারে। মুহিত ভাই যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁর যে অনুভুতি আমিও তাতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম।

মনে হচ্ছিলো এ যেন আমারও বিজয়। চোখ ভিজে যাচ্ছিলো। এভারেষ্ট থেকে নামার সময় পাঁচটা লাশ দেখার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মুহিত ভাই। বললেন ‌‌অন্ধকার রাতে সরু পথ দিয়েই নামছিলাম। ঝড়ো বাতাস।

এরপর লাশ। ভয়ে আমি শিউরে উঠছিলাম। কারণ এভারেষ্ট জয় করার চেয়ে নেমে আসা কঠিন। শরীরে তখন শক্তি থাকে না। অনেকেই ফেরার পথে মারা যায়।

মুহিত ভাই বলছিলেন চারদিন পর অ্যাডভান্স ক্যাম্পে এসে ভাত খেলাম। যেন ভাত খাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের কাজ। বারবার কথা বলছিলাম। বারবার ফোন কেটে যাচ্ছিলো। তারপরেও আমার সাক্ষাতকার নেওয়া চলছে।

মুহিত ভাই বলছেন, জানেন হাসান রাত নয়টা থেকে একটানা পাহাড়ে উঠছি। ভোর পাঁচটা। এভারেষ্ট চূড়া থেকে আমি তখন মাত্র একশ মিটার দূরে। ঠিক তখনই চোখের সামনে এক আইরিশ অক্সিজেনের অভাবে মারা গেলেন। তিনি হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলেন।

কিন্তু শেরপা যাওয়ার আগেই তিনি মারা যান। খুব ভয় হচ্ছিলো। কিন্তু কেবল মনের জোরেই উঠে গেছি। কিন্তু চূড়ায় ওঠার পর আমার অক্সিজেন শেস হয়ে যায়। কিন্তু শেরপা তখুনি সেটা বদলে দেয়।

মুহিত ভাইয়ের গল্প যেন শেষই হয় না। ক্যাম্প-১, ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-৩, এবিসি- নানা গল্প বলছেন। তাঁর বর্ণণা আর উত্তেজনায় আমিও বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমিই যেন এভারেষ্ট জয় করলাম। গত কয়েকদিনে মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে ৪০-৫০ বার ফোনে কথা হয়েছে।

বারবারই তাঁর কাছ থেকে নানা গল্প শুনছি আর তাঁর সঙ্গে আমিও উঠছি এভারেষ্টে। এ তো গেলো দ্বিতীয় বাংলাদেশির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। বাংলাদেশের প্রথম এভারেষ্ট বিজয়ী ইতিহাসের নায়ক মুসা ইব্রাহিম যেদিন এভারেষ্ট জয় করে ঢাকায় ফিরলেন সেই সাক্ষাতকারও আমি নিয়েছি। মনে আছে, সেদিন সকাল থেকে আমরা সবাই এয়ারপোর্টে। শত শত লোক।

সব নিরাপত্তা যেন ভেঙ্গে পড়ছে এয়ারপোর্টের। বিকেল বেলা মুসা ভাইয়ের ফ্লাইট নামলো। একের পর এক ফুলের মালায় ভেসে যাচ্ছেন আমাদের বীর সন্তান। এয়ারপোর্ট থেকে কারওয়ানবাজারের প্রথম আলো অফিস। এই সময়টুকু আমি আর মুসা ভাই এক গাড়িতে।

শুনছিলাম তার এভারেষ্ট জয়ের গল্প। বলছিলেন মুসা ভাই। সেই দুঃসাহসিক অভিযান। অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ার পর মুসা ভাই যখন চোখে অন্ধকার দেখছেন তখন এক শেরপা তাকে বাঁচিয়ে তুলছেন। মোবাইলে একের পর এক ফোন আসছে মুসা ভাইয়ের।

এর মধ্যেই আমরা কথা বলছি। মুসা ভাই বলে চলছেন এভারেষ্ট বিজয়ের গল্প। পথে পথে লোকজন তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সাড়া দিতে দিতেই কথা বলছেন মুসনা ভাই। আমরা যখন কারওনাবাজারে পৌছাই তখন সেখানে রাজ্যের ভীড়।

সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় যে বাংলাদেশের দুই এভারেষ্ট বিজয়ীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি তাদের নিয়ে নিউজ করেছি। তাদের চোখে-মুখে-তাদের কথায় আমার এভারেষ্ট বিজয় হয়ে গেছে। দুজনেই বলেছেন, তারা অন্য রকম এক সুন্দর বাংলাদেশ চান। দুজনেই বলেছেন, তরুণ প্রজণ্মই পারে বাংলাদেশকে বদলে দিতে।

দুজেনই শুনিয়েছেন আশার কথা। নতুন দেশের কথা। আমি মুগদ্ধ হয়ে শুনেছি। শ্রদ্ধা করেছি তাদের। এভারেষ্ট জয় না করলেও মুসা ভাই আর মুহিত ভাইয়ের মতো আমারও বুকের ভেতর একটা বিশ্বাস আছে।

আমারও বারবার মনে হয়, এই দেশটা একদিন ভালো হবে। সারা পৃথিবীর বুকে মাথা উুঁচ করে দাঁড়াবে। আর এজন্য তরুণ প্রজন্মকেই মানে আমাদেরই যার যার জায়গা থেকে লড়তে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসা আর মুহিতরা যদি এভারেষ্ট জয় করতে পারে তাহলে আমরাও পারবো একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে। আমাদের সেই বাংলাদেশে সব মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারবে।

সেখানে রাজনীতির নামে ভন্ডামি-শঠতা থাকবে না। আমলাতন্ত্রের নামে মানুষকে কষ্ট দেওয়া থাকবে না। যানজট নামে কোন সমস্যা থাকবে না। লোডশেডিং থাকবে না। লিমনের মতো কাউকে পঙ্গু হতে হবে না।

কোন দুঃস্বপ্ন থাকবে না সেখানে। থাকবে কেবল চ্যালেঞ্জ। এভারেষ্ট জয় করার মতো দেশকে উত্তেরোত্তর এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। ভালোবাসি বাংলাদেশ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।