আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একমাত্র খিলাফত শাসন ব্যবস্থাই পারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে।

good সেক্যুলার পূঁজিবাদী রাষ্ট্রে বিনা কারণে গ্রেফতার, বিচারবিহীন অনির্দিষ্ট কালের অন্তরীণ কিংবা নিরপরাধ মানুষের সাজাপ্রাপ্তি আমাদের সমাজে এখন অতি সাধারণ বিষয়। গণগ্রেফতারের ঘটনাও আর বিশেষভাবে আলোচিত হয় না। অপরাধীর তালিকায় নিষ্পাপ কোন নবজাতকের নাম দেখলেও সমাজের মানুষ তেমন চমকে ওঠে না। প্রতিদিনের সাধাসিধে রুটিনের মত এসব বিষয় যেন আমাদের সয়ে গেছে। অপর দিকে গুটি কয়েক মহাজনের অনৈতিক কারসাজিতে লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম রাড়ে।

চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়ায়, আর জনপ্রতিনিধিরা মানষের মিছিলে গুলির নির্দেশ দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এখানে প্রায় প্রতিদিনই স্নেহময়ী মায়েদের বুক খালি হয়, পুত্রশোকে পিতারা বুকে পাথর বাঁধে আর প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বিধবারা করে অশ্র“বিষর্জন। শ্লীলতা হারিয়ে আমাদের সমাজের সহস্র তরুণী আর দিনের আলোয় মুখ দেখাতে চায় না। এসিডদগ্ধ নারীর মুখে তার ঝলসানো স্বপ্নগুলো ঢাকা পড়ে থাকে। এসবের যেন কোন বিচার নেই।

বিচারের দাবি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে এক সময় শূন্যে মিলিয়ে যায়। আইনের শাসন আর বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সম্ভবত এ সামাজের সবচেয়ে দূর্লভতম বিষয়। তাই এ বিষয়টি নিয়ে আমাদেরকে আন্তরিক ভাবে ভাবতে হবে। আলোচনা সমলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করতে হবে। ২. সামাজিক প্রেক্ষাপট: বর্তমান বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে সঠিকভবে বোঝার জন্য আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে পূঁজিবাদের ভোগবাদি মূল্যবোধগুলো চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে এদশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠী ইসলামী মূল্যবোধগুলোও আঁকড়ে ধবে থাকতে চাচ্ছে। নিম্নে আমাদের সমাজিক প্রেক্ষপট বিশ্লেষণের জন্য তিনটি উপাদান আলোচিত হল: ২.১. ভোগবাদি মানসিকতার বিকাশ: আমরা একটি সেক্যুলার পূঁজিবাদী রাষ্ট্রে বসবাস করি। আর পূঁজিবাদের মৌলিক মানদন্ড হচ্ছে লাভ-ক্ষতি। এই মানদন্ডের ভিত্তিতে গৃহীত কর্মকান্ডগুলো যেকোন ধরণের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত।

এখানে মানুষ অধিক মুনাফা অর্জন এবং ন্যূনতম ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করে। সমাজে এর পরবর্তী ফলাফল কি হতে পারে তা বিবেচনা করা হয় না। বিভিন্ন পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন চিত্রগুলো দেখলেই এ বাস্তবাতা উপলবধি করা য়ায়। অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যের বিষয়টি চিন্তা না করে গড়পড়তা ভোগবাদি মানসিকতা তৈরী করা হচ্ছে। ফলে মানুষ বৈধ-অবৈধ উপায়ে, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন-লঙ্ঘন করে তাদের চহিদাপূরণ করার চেষ্টা করছে।

চাহিদাপূরণের উপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি কিংবা আইন-কানুন যেন মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনী প্রতিবন্ধকতা লঙ্ঘন করতে পারাটাই অনেকের প্রাপ্তির বিষয়। ফলশ্র“তিতে বিচার ব্যবস্থার উপর এমন চাপ পড়ছে যা সামলানোর ক্ষমতা এর নেই। তাই বর্তমানে যে বিচারগুলো নিঃষ্পত্তির অপেক্ষায় জমে আছে তা সম্পন্ন করতে আরো শত বছরেরও বেশী সময় লাগবে। আদৌ এগুলো নিষ্পত্তি করা সম্ভব কী না তাও সন্দেহমুক্ত নয়।

২.২. বিচার ব্যবস্থা ও জনগণের বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব: পূঁজিবাদী মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর চলমান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এদেশের মুসলমানদের পক্ষে ইসলামী মূল্যবোধগুলো ত্যাগ করা পুরোপুরি অসম্ভব। বৃটিশদের রেখে যাওয়া আইন ও বিচার ব্যবস্থা এদেশের মানুষ সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে পারেনি। বরং এই বিচার ব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষের মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী। সাধারণ মানুষের কাঙ্খিত জীবন পদ্ধতির সাথে এই ব্যবস্থাটি সামঞ্জস্য বিধান করতে ব্যর্থ। তাই এই বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের কোন শ্রদ্ধাবোধ কিংবা দায়বদ্ধতা নেই।

এজন্য সাধারণ জনগণের কাছ থেকে এই বিচার ব্যবস্থা কোনরূপ সহায়তা পায় না। ২.৩ রাজনৈতিক দল কর্তৃক বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার: সাধরণ জনগণের এই বিচার ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকার সুযোগ নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। এরা অহরহ বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। ক্ষমতারোহন করেই প্রত্যেকটি দল বিচার ব্যবস্থাকে তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ারে পরিণত করে। আসলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসলেই পুরো দেশটাকেই তাদের নিজেদের মনে করে।

তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশে মূলত যেটা চলছে সেটা হলো দলীয় শাসন। বাংলাদেশে যে দল যখন ক্ষমতায় যায় সেই দল তার নিজের দলীয় স্বার্থে শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সংসদ ভবন থেকে আরম্ভ করে মšী¿দের কেবিনেট আর আদালত থেকে আরম্ভ করে ইউনিয়ন পর্যায়ের মেম্বার পর্যন্ত সবাই দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাস্ত। ৭১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার তার নিজের মত করে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন সরকার এদেশের ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

এরকম সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে বিচার প্রার্থী সাধারণ জনগণ এবং বিচার ব্যবস্থা পরস্পর মুখোমুখি, এবং যেখানে দলীয় স্বার্থে বিচার ব্যবস্থাকে সহজে ব্যবহার করা যায়, সেখানে বিচার ব্যবস্থার সফলতার সম্ভাবনা শুরুতেই অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে আসে। যে বিচার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্বহীন এবং সাধারণ মানুষ যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত সে বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এমন অবস্থায় আইনের শাসন ও বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তার মাত্রাও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে থাকে। তাছাড়া আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ভেতরগত আরো কতগুলো মৌলিক ত্র“টিও বিদ্যমান; যেগুলো এই ব্যবস্থার পরিপূর্ণ ব্যর্থতাকে একেবারে শতভাগ নিশ্চিত করেছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলbr /> ৩. বিচার ব্যবস্থার ত্র“টিসমূহ: এই বিচার ব্যবস্থা আইনের শাসন ও বিচার প্রাপ্তির বিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ, কারণ মৌলিকভাবে এটি ত্র“টিপূর্ণ।

নিম্নে এর প্রধান ত্র“টিসমূহ আলোচিত হলbr /> − আইনের সীমাবদ্ধতা − অস্বচ্ছ আইন-কানুন − বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব − কেন্দ্রীভূত বিচার ব্যবস্থা − বিচার প্রক্রিয়ার বাণিজ্যিকীকরণ − বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতা − দুর্নীতিগ্রস্থ বিচার ব্যবস্থা ৩.১. আইনের সীমাবদ্ধতা: বর্তমান সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনের একমাত্র উৎস হচ্ছে মানুষ। আর মানুষের বাস্তবতা হচ্ছে সে একই সাথে সব কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। সে ততটুকুই বুঝতে পারে যতটুকু সে উপলব্ধি করতে পারে। আবার তার উপলব্ধিও তার পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা ও সীমাবদ্ধ চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে কোন বিষয় বোঝার ক্ষেত্রে তার অবশ্যই ভূল হয়।

এজন্য মানুষের তৈরী আইন কানুনে থাকে সীমাবদ্ধতা। বছরের পর বছর সংশোধন করেও এগুলোকে আবারো সংশোধন করতে হয়। তবুও এসব আইন-কানুন সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারে না। তাছাড়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্ধভাবে হুবুহু বিদেশীদের আইন নকল করে বিচার কার্য চালানোর চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে এদেশের মানুষ ও সামাজিক প্রেক্ষপট বিবেচনায় আনা হয় না।

তাই অন্য কোন দেশের প্রেক্ষপটে যে আইন সফল বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা ব্যর্থ হয়। ৩.২. অস্বচ্ছ আইন-কানুন: যে আইন কানুন দিয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করা হয় সেই আইন কানুন সম্পর্কে জনগণ কিছুই জানেনা। জনগণ জানেনা কি অপরাধ করলে কি ধরণের বিচার হবে। কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার ধরণ সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ অজ্ঞ। ‘আইনের মাপ্যাঁচ’ এখন একটা অতি ব্যবহৃত প্রবাদে পরিণত হয়েছ।

‘আইনের মাপ্যাঁচ’ বলতে অনিশ্চিত দুর্বোধ্য কোন কিছুকে বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে আইন আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী ছাড়া এ ব্যাবস্থা আর কেউ বোঝে না। জনগণের কাছে বর্তমান আইন এবং আইনি প্রক্রিয়া একটি অনিশ্চিত দুর্বোধ্য বিষয়। ফলে এখানে লঘু পাপে গুরু শাস্তি আবার গুরু পাপে লঘু শাস্তি নেত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু জনগণ আইন-কানুন সম্পর্কে একদমই অজ্ঞ, তাই তাদেরকে খুব সহজেই বিভ্রান্ত করে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা যায়।

৩.৩. বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব: বাংলাদেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগের উপর কতৃত্ব বজায় রাখার জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করছে না। এবং এটা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় প্রচলিত এই আওয়ামীলীগ ও বি.এন.পির কোন দলই এই বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করবে না। এর জলন্ত প্রমাণ হলো নির্বাচনী ইশতিহারে এই দুই দল জনগণের কাছে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার ওয়াদা করলেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই দলগুলো আর সেটা বাস্তবায়ন করেনা। এর প্রধান কারণ হলো বিচার বিভাগকে যদি নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে পড়ে এবং এর উপর শাসকগোষ্ঠীর আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন হয়ে পড়ে তাহলে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে দূর্নীতি করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে।

শাসকগোষ্ঠী জনগণের সম্পদ যথেচ্ছা লুটপাট করে অকল্পনীয় বিত্তবৈভবের মালিক হতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে যতদিন লুটপাটের এই শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে সত্যিকার অর্থে আলাদা হবে না। ৩.৪. কেন্দ্রীভূত বিচার ব্যবস্থা : কেন্দ্রীভূত বিচার ব্যবস্থা এই সমাজব্যবস্থায় বিচার না পাওয়ার আরো একটি বড় কারণ। এখানে যে কোন ধরণের বিচার কার্য চালানোর জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষজনকে শহরমুখী হতে হয়। কারণ শহরকে কেন্দ্র করেই বর্তমান বিচার ব্যবস্থার অবকাঠামো গড়ে উঠেছে।

এই অবস্থায় গ্রামের সাধারণ মানুষ বিচার কার্য চালাতে শহরে আসতে গিয়ে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক হয়রানির শিকার হয়। শহরে এসে আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট দূর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর দ্বারা নানাভাবে প্রতারিত হয়। এজন্য অনেকেই অযথা হয়রানির আতঙ্কে বিচার কার্য চালাতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে চরমভাবে কেন্দ্রীভূত এই বিচার ব্যবস্থা থেকে জনগণের প্রতি এর চরম দায়িত্বহীনতার চিত্রই ফুটে ওঠে। এই বিচার ব্যবস্থা দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কাছে যায় না বরং সাধারণ জনগণকে বিচার প্রাপ্তির জন্য একটি দীর্ঘ হয়রানির মধ্যে ঠেলে দেয়।

৩.৫. বিচার প্রক্রিয়ার বাণিজ্যিকীকরণ: বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বিচারকার্য এক ধরণের লাভজনক ব্যবসা। প্রচুর টাকা ব্যতিত একজন দক্ষ আইনজীবির সহায়তা লাভ করা যায় না। এখানে বিচার কার্য চালাতে হলে প্রচুর টাকা ব্যায় করতে হয়। ফলে কেস করার আগে মানুষ জানতে চায় কেস চালাতে কি পরিমাণ টাকা লাগবে। টাকার চিন্তা করে আতঙ্কিত দরিদ্র জনগণ বিচার পাওয়ার আশা ত্যাগ করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের সমাজের তথাকথিত ভূমিদস্যুদের আইন, আইনজীবি কিংবা বিচার ব্যবস্থার যেকোন রকমের সহায়তার অভাব হয় না। সাধারণ দরিদ্র মানুষের সম্পদ লুটপাট করতে আসা এশিয়ান এনার্জি, নাইকো ইত্যাদি কম্পানিগুলোকে প্রথিতযশা বিজ্ঞ আইনজীবিরা সর্বাত্মক সহযোগীতা দেয়। জনগণের স্বার্থ , আইনের শাসন অথবা বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এখানে বিষয় নয়, বরং এটি স্পষ্ট টাকার পাল্লা যদিকে ভারী, বিচার ব্যবস্থা কিংবা আইনজীবিরা সেদিকেই অবস্থান নেন। ৩.৬. বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতাbr /> বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতা এদেশের জনগণের বিচার প্রাপ্তির জন্য আরোকটি বড় বাধা । রায়ের বিরুদ্ধে আপীল, রায়ের উপর স্থগিতাদেশ কিংবা এক আদালত থেকে অন্য আদালতে হস্তান্তরের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করা হয়।

এদেশে এক একটি বিচারের জন্য কত বছর সময় লাগবে একথা যেমন একজন ভুক্তভোগী ব্যক্তি জানেনা, তেমনি একজন বিচারকও জানেনা। আদালতে এক একটি কেস র্দীঘ দশ-বিশ বছর ধরে ঝুলে থাকার পরেও নিষ্পন্ন হয় না। খবরের কাগজে নিউজ হয় বাংলাদেশের সব কেসগুলো যাদি নিঃস্পন্ন করতে হয়ে তাহলে প্রায় ২০০ বছর লেগে যাবে। আদৌ এই সময়ের মধ্যেও তা সম্পন্ন হয় কিনা তেেতও অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন ৩.৭. দুর্নীতিগ্রস্থ বিচার ব্যবস্থা: যেহেতু বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা নয়, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রীতা, ও অস্বচ্ছ আইন-কানুন বিদ্যমান, ফলে স্বভাবতই দুর্নীতি এখানে জেঁকে বসবে এ আর অসম্ভব কি। টি.আই.বি-র রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশে সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লোয়ার কোর্ট একটি।

মানুষকে বলতে শোনা যায় আদালতের মাটিও নাকি টাকা চেনে। যেখানে দুর্নীতি বিদ্যমান সেখানে বিচার প্রাপ্তির কোন নিশ্চয়তা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই চলছে বাংলাদেশের আদালতগুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ। আজকে এই দেশের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় এখানে টাকা দিয়ে বিচার কেনা যায়, টাকা দিয়ে বিচার বন্ধ করা যায়, এমনকি টাকা দিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে নিজেদের ইচ্ছেমত সাজিয়ে নেয়া যায়। বিভিন্ন সময় এই বিচার ব্যবস্থাকে বিভিন্নভাবে সারিয়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে বিদেশী প্রভুদের নানারকম পরামর্শ বাস্তবায়নে কালক্ষেপন করেও একে কার্যক্ষম করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব কিছু শুধু ব্যর্থই হয়নি বরং এই ব্যবস্থার জটিলতাকে আরো বাড়িয়েছে। ব্যর্থ বিচার ব্যবস্থা দিন দিন আরো ব্যর্থ হয়ে অবশেষে দেউলিয়া হয়ে গেছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র‌্যাব) গঠনের মাধ্যমে বিচার বহিভূর্তভাবে মানুষ হত্যা করে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার বিচার বিভাগের দেউলিয়াপনাকে নগ্নভাবে মানুষের সামনে প্রকাশ করেছে। আর এই দেউলিয়াপনা থেকে আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে কখনোই বের করে আনা সম্ভব নয়।

আমাদের প্রয়োজন এই ব্যর্থ ব্যবস্থাটিকে উপড়ে ফেলে এমন একটি বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যা মানুষের বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং যে ব্যবস্থা হবে মৌলিকভাবে ত্র“টিমুক্ত। একমাত্র ইসলামিক বিচার ব্যবস্থাই আমাদের সমাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা। তাই আমাদের ইসলামিক বিচার ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। আমরা এখন বিস্তারিতভাবে ইসলামিক বিচার ব্যবস্থা আলোচনা করব। ৪. খিলাফত রাষ্ট্রের সমাজিক প্রেক্ষাপট: মূল আলোচনায় যাবার আগে যে সামাজে ইসলামি বিচার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে তার মৌলিক চিত্রটা আমাদের সামনে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

নিম্নে ইসলামী সমাজের দুটি দিক আলোচিত হল: ৪.১. জনমত : খিলাফত রাষ্ট্রে ইসলামিক মূল্যবোধগুলোর উপর ভিত্তি করে শক্তিশালী একটি জনমতের উপর সমাজ প্রতিষ্ঠিত। এখানে মানুষ বিশ্বাস করে তার প্রত্যেকটি কাজের জন্য তাকে আল্লাহ্ (সুবঃ)’র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ (সুবাঃ) বলেন, “অতঃপর কেউ অনু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। ” (আল কুরআন- ৯৯ : ৭-৮) সুতরাং মানুষ অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

আর তাছাড়া ইসলামী সমাজে অন্যায়কারী তথা পাপীর সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পায়। তাই নিজেদের মর্যাদা রক্ষার্থেই মানুষ অন্যায় থেকে দূরে থাকতে চায়। যদি কেউ অসাবধানতাবশে কোন অন্যায় করে তবে সে পরকালে কঠিন জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুনিয়াতে হালকা শাস্তি মাথা পেতে নেয়। তাই বিচার ব্যবস্থা চাপমুক্ত থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়; এক মহিলা রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে বললো : “আমি জ্বেনা করেছি এবং জ্বেনার কারণে গর্ভবতী হয়ে গিয়েছি।

নবী করীম (সাঃ) তাকে বললেন: “তুমি চলে যাও, সন্তান প্রসব হলে এবং তার দুধপান করানোর সময় অতিক্রান্ত হলে এসো”। ৪.২. জনগণের বিশ্বাসই বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি: খিলাফত রাষ্ট্রে জনগণের বিশ্বাস ও বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি এক ও অভিন্ন। মানুষ বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরে আল্লাহ্ (সুবাঃ)’র সামনে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে; এজন্য তাঁর দেওয়া বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। পক্ষান্তরে বিচার ব্যবস্থাও অল্লাহর দেওয়া সেই বিধি বিধানগুলোই বাস্তবায়ন করে। এজন্য জনগণ ও বিচার ব্যবস্থা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

তাই মানুষ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিচার বিভাগকে সহায়তা করে এবং বিচার ব্যবস্থা অন্যায়কে প্রতিরোধ করে মানুষের জান্নাতের পথকে সহজ করে তোলে। উপরে উল্লেখিত মহিলার ঘটনার বিচারের পর রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন: “এ মহিলা এমন তওবা করেছে যে, তা যদি পৃথিবীবাসীর মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয় তবে সকলের (জান্নাতের) জন্য তা যথেষ্ট হবে। ” সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট খিলাফত রাষ্ট্রে সমাজকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন মানুষ সর্বাত্মকভাবে বিচার ব্যবস্থাকে সহযোগীতা করে। তাই খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা খুব সহজেই সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এমন সমাজে বিচার ব্যবস্থার পক্ষে আইনের শাসন বাস্তবায়ন ও বিচার প্রপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করাও কঠিন নয়।

আইনের শাসন ও বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য উপরোক্ত প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা ছাড়াও খিলাফত রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কতগুলো মূলনীতি রয়েছে। নিম্নে সেগুলো আলোচিত হল: ৫. ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি: পর্যায়ক্রমে কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে সুষ্পষ্ট কিছু মূলনীতি বাস্তবায়ন করে খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা আইনের শাসন ও বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে। খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার কতগুলো মূলনীতি নিম্নরূপ: − সুস্পষ্ট ও ত্র“টিমুক্ত আইন-কানুন − নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া − নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীন − বিচার ব্যবস্থার কাঠামো − বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ − দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা − দূর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা − সহজলভ্য বিচার প্রাপ্তি নিম্নে উপরোক্ত মূলনীতিগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হল: ৫.১. সুস্পষ্ট ও ত্র“টিমুক্ত আইন-কানুন: ইসলামিক আইন-কানুনের একমাত্র উৎস হচ্ছেন আল্লাহ্ (সুবাঃ)। তিনি ছাড়া অন্য কোন উৎস হতে আইন গ্রহণ করা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। আর আল্লাহ্ (সুবঃ) তার গ্রন্থ আল-কুরআন এবং বার্তাবাহক মোহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে তাঁর নিয়ম কানুনসমূহ মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন।

আল্লাহ্ (সুবঃ) বলেন: “আর অমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পাস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করুন” (আল মায়িদাহ: ৪৯) সৃষ্টিকর্তা সকল সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। তাই তিনি যে আইন প্রণয়ন কিংবা মূলনীতি দান করবেন মৌলিকভাবেই সেগুলো সব ধরণের ত্র“টি থেকে মুক্ত। আল্লাহ্ (সুবাঃ) মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলে মানুষকে তিনি সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে পারেন। তাই মানুষের জন্য সঠিক আইন-কানুন একমাত্র তাঁর পক্ষেই দেয়া সম্ভব। আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেন, “তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ।

এটাই আল্লাহ্র প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছে। ” এজন্য মানুষের জন্য আইন প্রণয়ণের সবচেয়ে নির্ভূল উৎস হচ্ছে আল-কুরআন যার মধ্যে কোন ত্র“টি-বিচ্যুতি কিংবা বৈপরীত্য নেই। আল্লাহ্ (সুবাঃ) বলেন : “এরা কি লক্ষ্য করে না কুরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ্ ব্যতিত অপর কারো পক্ষ থেকে হত তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরীত্য দেখতে পেত। ” (কুরআন-৪:৮২) কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে এমন একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সঠিকভাবে আইন বের করতে হয় যা সহজেই সবার কাছে বোধগম্য হয়। ইসলামের পরিভাষায় কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আইন বের করার এই প্রক্রিয়াটিকে বলে ইজতিহাদ।

ইজতিহাদেরর মাধ্যমে প্রাপ্ত আইন স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। অস্পষ্ট কোন আইন গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত ওমর (রাঃ) তার এক প্রশাসক আবু মূসা আশআরী (রাঃ) কে এক ফরমানে কতগুলো মূলনীতি বলে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল নিম্নরূপ: “যে আইন দ্বারা বিচার হবে তাকে সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। ” সুতরাং প্রথমত ইসলাম ত্র“টিমুক্ত, সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ আইন নিশ্চিত করে। তাছাড়া খিলাফত রাষ্ট্রের আইন-কানুন সম্পর্কে শুধু বিচারকগণই সচেতন থাকবেন না জনগণও সচেতন থাকবে।

ফলে জনগণের উপর ভুল বিচারের সম্ভাবনা থাকবে না বললেই চলে। ৫.২. নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া: খিলাফত রাষ্ট্রে সর্বাত্মক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচার প্রকিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়। আল্লাহ (সুবঃ) বলেন: “হে ঈমানাদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহ্র ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতা অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ্ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরন করো না।

আর যদি তোমরা ঘুরিয় পেঁচিয়ে বল কিংবা পাশ কটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ্ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত। ” (আল-কুরআন: ৪:১৩৫) রাসূল (সাঃ) বলেছেন: ‘ইতিপূর্বে বণী ইসরাঈল নিপাত হওয়ার একমাত্র কারণ হলো যে, তাদের শরীফ লোক চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত। কিন্তু কোন দূর্বল লোক যখন চুরি করতো তার উপর তারা ‘হদ্দ’ (আল্লাহ্ রায়) জারি করতো। সেই মহান সত্ত্বার কসম যার ‘কবজায়’ মুহাম্মদের প্রাণ; মুহাম্মদ তনয়া ফাতেমা (রাঃ) চুরি করলেও আমি তাঁর হাত পর্যন্ত কেটে দিতাম। ” হযরত ওমর (রাঃ) মদপান করার অপরাধে নিজের সন্তানকে শাস্তি দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি নিহত হয়েছিলেন।

হযরত আলী (রাঃ) খলিফা থাকাকালীন একজন অমুসলিম নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করে হেরে গিয়েছিলেন। ৫.৩. নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীনbr /> খিলাফত রাষ্ট্রে একমাত্র আল্লাহ (সুবাঃ) সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আর শরীয়াহ্র মাধ্যমেই তাঁর সার্বভৌমত্ব্ রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত থাকে। সুতারং শরীয়াহ্ কোন কিছুর অধীনে থাকতে পারে না। শরীয়াহ্ কোন কিছুর অধীনে থাকা মানে হচ্ছে আল্লাহÍ (সুবাঃ) সার্বভৌমত্ব অন্য কোন কিছুর অধীনে চলে যাওয়া।

এজন্যই যে বিচার ব্যবস্থা শরীয়াহ্ বাস্তবায়ন করে তা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকা অসম্ভব। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি অনুসারে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা মৌলিকভাবেই নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। খলিফা শুধু কাজী-আল-কুজ্জা বা প্রধান বিচারপতি বিধি মোতাবেক নিয়োগ ও বরখাস্ত করতে পারেন। বরং কখনো কখনো খলিফাসহ পুরো নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের অধীনে চলে আসে। রাষ্ট্র এবং জনগণের মাঝে যদি কোন বিষয়ে বিরোধ উপস্থিত হয়, তবে সে বিরোধের নিস্পত্তির জন্য ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় মাহ্কামাত মাদালিম নামে আলাদা একটি আদালত রয়েছে।

আলাহ্ (সুবাঃ) বলেন, “যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ্ ও কেয়ামত দিবসের উপরে বিশ্বাসী হয়ে থাক। (আল-কুরআন; ৪:৫৯) রাসূল (সাঃ) রাষ্ট্র প্রধান থাকাকালীন রাশীদ ইবনে আব্দুল্লাহ্কে মাদালিমের কাজী নিযুক্ত করলেন এবং বল্লেন: “অমি যাদি কারো অর্থ নিয়ে থাকি, এই আমার অর্থ, তাকে এখান থেকে নিতে দাও। আমি যদি কারো পিঠে চাবুক মারি, এই আমার পিঠ, তাকে শোধ নিতে বল। ” মাহ্কামাত মাদালিমের বিচারক কাজী-উল-মাদালিম খলিফা থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠীর যেকোন ব্যক্তির যে কোন ধরণের অন্যায় আচারণের ব্যাপারে আইনী কার্য্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। কাজী-উল-মাদালিম যখন খলিফা অথবা শাসকবর্গের বিচারকার্য পরিচালনা করেন তখন কাজী উল-মাদালিমকে বরখাস্ত করার কোন বিধান খিলাফত রাষ্ট্রে নেই।

বিচারক বাদি ছাড়াই উপযাচক হয়ে রাষ্ট্রের যে কোন দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। যেমন, খলিফা বা রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লীষ্ট কোন ব্যক্তি যদি আইন বহির্ভূত কোন কাজ করে, কাজী উল-মাদালিম উপযাচক হয়ে বাদী ছাড়াই আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। ৫.৪. বিচার ব্যবস্থার কাঠামোbr /> খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় সফল মূলনীতির সাথে বাস্তবায়নযোগ্য একটি বিচার কাঠামো রয়েছে। খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার কাঠামো নিম্নরূপ: ৫.৫. বিকেন্দ্রীভূত বিচার ব্যবস্থা: খিলাফত রাষ্ট্্েরর বিচার ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের প্রন্তিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের হাতের নাগালে নিয়ে যাওয়া হয়। জনগণকে বিচার প্রাপ্তির জন্য অযথা হয়রানিমূলকভাবে শত শত মাইল এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট স্বীকার করতে হয় না।

রাসূল (সাঃ) মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রাঃ) ইয়েমেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কিভাবে বিচার করবে?” মুয়াজ (রা) উত্তর দিলেন “আল্লাহ্র কুরআন অনুসারে। ” রাসূল (সাঃ) আবার জিজ্ঞেস করলেন, “যদি তুমি কুরআনে তা না পাও তবে কি করবে?” তিনি (রাঃ) বল্লেন, “রাসূলের সুন্নাহ অনুসারে। ” রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন: “যদি তুমি সুন্নাহতেও তা না পাও তবে কি করবে?” মুয়াজ তখন উত্তর দিলেন, “আমার সাধ্যের ভেতর নিজের ইজতিহাদ অনুযায়ী মানুষের ভেতর বিচার ফয়সলা করব। ” তখন রাসূল (সাঃ) মুয়াজের জন্য দোয়া করে বললেন, “প্রশংসা আল্লাহ্র যিনি আল্লাহ্র নবীর প্রতিনিধিকে সঠিক হেদায়েত দান করেছেন, যা আল্লাহ্র নবী পছন্দ করেন। ” উপরোক্ত উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি রাসূল (সাঃ) তাঁর বিচার ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত করে রাখেননি।

উপরন্তু প্রত্যেক গভর্ণর প্রয়োজন অনুযায়ী তার প্রদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা বিচারক নিয়োগ করতে পারেন। হযরত ওমর (রাঃ) মিসরের গভর্ণর আবু মুসা আশআরী (রাঃ)কে লেখা এক চিঠিতে কতগুলো ফরমান দিয়েছিলেন, তার একটি নিম্নরূপ; “লোক সংখ্যা অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণে বিচারালয় ও বিচারকের ব্যবস্থা থাকা যদ্দরুণ বিচার প্রার্থীগণকে অহেতুক হয়রানি হতে না হয়। ” শুধু তাই নয়, খিলাফত রাষ্ট্র প্রয়োজনে মসজিদে মসজিদে বিচারক নিয়োগ করবে যাদেরকে বলা হয় কাজি-উল-মসজিদ। অল-মাওয়ির্র্দি তাঁর আল-আহকাম আল-সুলতানিয়্যা গ্রন্থে লিখেছেন, “আবু আব্দুল্লাহ আল জুবায়র (রাঃ) বলেন: বসরার আমিরগণ শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদে বিচারক নিয়োগ করেছেন। তাঁরা তাঁকে মসজিদের বিচারক বলতেন।

” তাছাড়া জনস্বার্থ দেখাশুনাকারী বিচারকের রায় প্রদান করার জন্য কোন বিচারালয় প্রয়োজন হয় না। তিনি বাড়িতে, বাজারে ভ্রমণে, দিনে, রাতে যেকোন সময়ে যেকোন জায়গায় অপরাধ সনাক্ত করতে পারলে সাথে সাথে সেখানেই রায় প্রদান করে তা পুলিশের সাহায্যে বাস্তবায়ন করতে পারেন। রাসূল (সাঃ) একদিন মদিনার বাজারে হাঁটার সময় একটি খাবারের স্তুপের ভেতর আদ্রতা উপলব্ধি করলেন। অতঃপর তিনি সাথে সাথে ভেজা খাবারগুলো উপরে রাখতে নির্দেশ দিলেন, যাতে ক্রেতাগণ প্রতারিত না হন। অর্থাৎ খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে এমন পর্যায় পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় যেন প্রত্যেক নাগরিক তার লোকালয়ে অবস্থান করেই বিচার পান।

৫.৬. দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ : ইসলামী বিধান মতে যতক্ষণ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধ প্রমাণিত না হয় তৎক্ষন পর্যন্ত কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করা, সন্দেহমূলকভাবে হলেও কাউকে গ্রেফতার করে অনির্দিষ্ট অথবা নির্দিষ্ট সমায়ের জন্য জেলে রাখা ইসলামী শরীয়াহ্ মতাবেক বৈধ নয়। কারো বিরুদ্ধে মামলার জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লাগবে। যেহেতু নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট অইন-কানুন রয়েছে সেহেতু এই বিচার ব্যবস্থায় বিচারের রায় হবে দ্রুত এবং নির্ভুল। তাই একবার বিচারের রায় প্রদান করার পর আসামীর পক্ষে আর এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নাই। কারণ বিচারের রায় পরিবর্তন করা মানে আল্লাহ্ (সুবঃ)’র শরিয়াহ পরিবর্তন করা যা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

রাসূল (সাঃ) বলেন “ যার সুপারিশ আল্লাহর কোন হদ্দ (রায়) বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সে যেন আল্লাহ্র মোকাবিলা করল। ” হযরত ওমরের একটি রায়ের বিরুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে নাজরানের কিছু লোক এসে বল্ল: “আমিরুল মুমিনীন, আপনার ডান হাতে বই অর আপনার কন্ঠে হচ্ছে ক্ষমা। ” হযরত আলী (রাঃ) বল্লেন: “তোমাদের প্রতি দুর্ভোগ! ওমর সত্য পথে ছিলেন। আমি ওমর কর্তৃক দেওয়া কোন রায়কে উল্টাব না। ” তাছাড়া খিলাফত রাষ্ট্রের কোন একটি নির্দিষ্ট বিচারের ক্ষেত্রে একের অধিক বিচারকের রায় প্রদানের ক্ষমতা নেই।

এক বিচারক অন্য বিচারকের রায় বতিল করতে পারেন না। অন্যান্য বিচারক শুধু মতামত দিতে পারেন। সুতরাং এক আদালত থেকে আরেক আদলতে হস্তান্তর কিংবা রায়ের উপর স্থগিতার্দেশ ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম প্রলম্বিত হবে না। ৫.৭. দূর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা: খিলাফত রাষ্ট্র তার বিচার ব্যবস্থাকে দূর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বিচারক ছাড়া আর কারো বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সুযোগই নেই।

আর বিচারকের অন্যায়ের ব্যপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চরণ করেছে। কারণ আল্লাহ্র(সুবাঃ) শরিয়াহ্’র বিরাট একটি অংশ বিচারকের মাধ্যমে সরাসরি সমাজে বাস্তবায়িত হয়। এ দায়িত্বে কোনরূপ অবহেলা মানে হচ্ছে আল্লাহ্ (সুবাঃ)’র শরিয়াহ বাস্তবায়নে অবহেল। এজন্য বিচারকগণ শরিয়াহ্’র প্রত্যেকটি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ থেকে কর্তব্য পালন করেন। আল্লাহ্ (সুবঃ) “যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই জালেম।

” (আল-কুরআন: ৫:৪৫) রাসুল (সাঃ) বলেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেকেই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ” আর বিচারককে খুব কঠিনভাবে জিজ্ঞোস করা হবে। এ প্রেক্ষিতে তিনি (সাঃ) আরো বলেন, “বিচার দিবসে ন্যায়বান বিচারককে ডাকা হবে এবং তাকে কঠিনভাবে জবাবদিহী করতে হবে, সে যে ধরণের বিচার করেছে সেই ব্যাপারে, যতক্ষণ না সে ইচ্ছা পোষন করে সে তার জীবনে কোন মানুষের বিচার করেনি, এমন কি একটি খেজুরের ব্যাপারে হলেও। ” এজন্যই ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় দুর্ণীতির সম্ভাব্য সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ৫.৮. বিচার প্রাপ্তির সহজলভ্যতা: একটু চিন্তা করলেই আমাদের সমাজের ব্যায়বহুল হয়রানিমূলক দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার একটি মূল কারণ বেরিয়ে আসে।

তাহলো, যে অন্যায় করে সে তার শাস্তি এড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ খরচ করেও উকিল নিয়োগ করে। প্রবাদ আছে ডাক্তারের কাছে আর উকিলের কাছে নাকি কোন কিছু লুকাতে নেই। উকিল অপরাধীর বিবরন শুনে সত্য-মিথ্যা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।