বিষাদময়
সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ হল ’লাদেন মৃত’। ওসামা বিন লাদেন মৃত, এই সংবাদটি ঘিরেই রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত। কেউ লাদেনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাজপথে নেমে এসে আনন্দে গা ভাসিয়েছেন আর কেউবা তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোক প্রকাশ করেছেন, অনেকেই সমালোচনা করেছেন, অনেকে আবার মৃত্যুর ঘটনাটিই যে মিথ্যা বা বানোয়াট বলে দাবি করেছেন মার্কিনিদের কাছে। তবে সকল লাদেন পক্ষের সমর্থকদের আশাহত করে গত শুক্রবার আল-কায়েদা লাদেনের মৃত্যু সংবাদটি যে সত্য তা স্বীকার করেছেন।
লাদেনের মৃত্যু সংবাদ সঠিক বলে স্বীকার করেই থেমে থাকেনি আল-কায়েদা বাহিনী, সাথে সাথে মার্কিনিদের হুমকিও দিয়েছে, লাদেনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে বলে।
যেকোন মুহুর্তে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর হামলা চালাবে। আর তাদের হামলা ঠেকাতেই মার্কিন নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে আরও কয়েকগুন।
একটি জিহাদিস্ট ইন্টারনেট ফোরামে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের সাহসী জিহাদীরা লাদেনের রক্ত বৃথা যেতে দেবেন না। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আল কায়েদার যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। লাদেনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য বয়ে আনবে অভিশাপ।
আর মার্কিনিদের হাসি শিগগিরই পরিণত হবে কান্নায় ।
গত রোববার লাদেনের মৃত্যুর ব্যাপারে স্বয়ং হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত তথ্যের মাধ্যমে পূর্বের বিবৃতির সাথে পরের বিবৃতির মিল না থাকায় সকল মহলে বিভ্রানি ছড়িয়ে পড়ে। বিভ্রান্তিগুলো ছিল এরকম- প্রথমবার বলা হয়, হামলার সময় ওসামা বিন লাদেনের হাতে ছিল ভয়ংকর একে-৪৭। কিন্তু পরবর্তীতে বলা হয় ঘটনার সময় লাদেন ছিল একেবারেই নিরস্ত্র। প্রথমদিন ক্রোসফায়ারের বর্ননার মত করে উল্লেখ করে বলা হয়, ঘটনার সময় লাদেন মার্কিন সিল (এসইএল) বাহিনীর উপর গুলি চালালে তাকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করে শান্ত করা হয়।
এ বিবৃতির পরের দিনই বলা হয়, না, লাদেন সিলের দিকে গুলি ছোড়েনি। একবার বলা হয়, লাদেনের সাথে যে মহিলাটি মারা যায় তিনি লাদেনেরই স্ত্রী, কিন্তু একই ঘটনার বর্ণনায় পরবর্তিতে বলা হয়, হামলার সময় লাদেনের সাথে থাকা মহিলাটি লাদেনের স্ত্রী নয়, তার এক সহযোগীর স্ত্রী।
লাদেন হত্যার বিষয়ে বিভ্রান্তমূলক বক্তব্যের কারনে সাধারন মানুষ ছাড়াও ক্ষোত জাতিসংঘই মার্কিন সরকারের কাছে বিস্তারিত ও সঠিক তথ্যটি জানতে চেয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ অভিযান এবং এ গুপ্তহত্যাকে অনুমতি দেয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মানা হয়েছে কিনা, অভিযানে লাদেনকে জীবিত ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কিনা। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের প্রচারনার কারণে ফেঁসে যেতে পারে মার্কিন প্রশাসন।
কিন্তু সেসব বিশ্লেষকদের কথা আদৌ মার্কিনিরা কানে তুলবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে সাধারন মানুষের।
লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের সমাপ্তি হল তা বলা যাবেনা, এদিকে লাদেনের মৃত্যুর পর আল-কায়েদার কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যাবে এমনটি ভাবারও কোন অবকাশ নেই। কারন দু পক্ষই দুজনকে পারষ্পরিক শত্র“ মনে করে। আর লাদেনের নাম করেই এর সমর্থক দেশ বা জাতিদের মার্কিনিরা যে এতোদিন মুসলিম বিশ্বে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে তার অবসান হবে তাও ভাবা যায়না।
নচিকেতার একটি গান মনে পড়ছে, ’লাদেন সন্ত্রাসী বুশ নিরামিষাশী, বুশ সন্ত্রাসী লাদেন নিরামিষাশী, একথা প্রচার করে যারা -তারা ইন্টালেকচুয়াল।
’ ইন্টালেকচুয়াল হওয়ার কোন কারন নেই, তার পরেও বলতে যা বাঁধা নেই সেটা বলাই সাধারন মানুষ হিসেবে আমাদের কাম্য। তাহলে প্রথমে যে বিষয়টা স্পষ্ট করতে হবে তা হল, সন্ত্রাসী কারা, আর কাদেরকেইবা আমরা সন্ত্রাসী বলতে পারি?
যারা খুনাখুনি, মারামারি, হত্যা, অন্যায় ইত্যাদিতে জড়িত তাদেরকেই আমরা সন্ত্রাসী বলে আক্ষায়িত করতে পারি। সন্ত্রাসী কোন গোষ্ঠির হতে পারেনা, হতে পারেনা কোন জাতির বা দেশের, কারন এরা কখনই প্রকৃত শান্তি আনতে পারেনা, মৃত্যু বা হত্যা দিয়ে যে কখনই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়না, তা আমরা সকলে জানলেও ভুলে যাই যখন আল-কায়েদা ধর্মের নামে আর মার্কিন বাহিনীর মত কোন বাহিনী যখন ক্ষমতা দেখিয়ে একটার পর একটা হত্যাকান্ড চালিয়ে যায়। তখন আমরা চিন্তা করিনা কে আসল সন্ত্রাসী, কারন আমরা কেউই নিরপেক্ষ নই।
এদেশের আশির ভাগ জনগনই মুসলমান তাই মুসলিম দেশগুলোর প্রতি এদেশের মানুষের একটা ধর্র্মীয় টান থাকতেই পারে, আবার এদিকে মার্কিনমুলূক থেকে বছর বছর কিংবা বিপদেআপদে সাহায্য পাই বলে তাদের প্রতিও সমর্থন থাকাটাই স্বাভাবিক, তাই বলে কোন পক্ষকে অন্ধভাবে ভাল বলার মত এদেশের অবস্থান নেই।
তারপরেও এদেশের সরকার পক্ষের লোকজন মার্কিনদের সমর্থন করছেন। তাদের বিজয় আনন্দে নিজেদের সামিল করেছেন।
৯/১১-এর হামলায় টুইন টাওয়ার খ্যাত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে তিন হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। বিশ্বযুদ্ধের পরে এক হামলায় একসাথে এতো মানুষের মৃত্যু বিশ্বের কোথাও হয়নি। নজিরবিহীন এ হামলার মধ্য দিয়ে লাদেনের আল-কায়েদা নামক দলটি নিজেদের শক্তিশালী বলে প্রমান করেছিল।
লিবিয়ায় গাদ্দাফি ও তার সমর্থকদের উপর মার্কিনবাহিনীর চলছে কয়েকমাস থেকেই নানা রকম ছোট বড় হামলা। এতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নিহত করেছে সেদেশের অনেক সাধারন মানুষকে। অত:পর গাদ্দাফির ছোট ছেলে সাইফ আল আরব আর গাদ্দাফির তিন নাতি যখন ন্যাটো হামলায় নিহত হল, মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও গোটা বিশ্বের চোখ যখন সেঘটনার দিকে, সকল গনমাধ্যম সেঘটনা কভার করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক,সেই মুহুর্তে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ঘটনা ছড়িয়ে দিয়ে সকল গনমাধ্যমের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে লিবিয়া থেকে। এতেই কি প্রমানিত হয়না যে, একদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলের মৃত্যুর তুলনায় মার্কিনদের আনন্দের খবর প্রচার করাটা বেশি জরুরি।
তবুও লাদেনের মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বের বাইরে যারা দু:খ প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে ব্রিটেনের কান্টাবারি গির্জার যাজক ড. রোয়ান উইলিয়ামস ও তিব্বতের ধর্মীয় গুরু দালাইলামা অন্যতম।
উইলিয়ামস বলেন, ’লাদেনকে মেরে ফেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিরস্ত্র লাদেনকে হত্যা করায় আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছি। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা সব সময়ই অস্বস্তিকর অনুভ‚তির জš§ দেয়। ’
এদিকে, লাদেনের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে দালাইলামা বলেন, ’১১ সেপ্টম্বরের সন্ত্রাসীহামলায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয় যা নিশ্চিতভাবে দুঃখজনক। এজন্য এই হামলার সঙ্গে জড়িত বিন লাদেনকে অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত ছিল।
মানুষ হিসেবে লাদেন সহমর্মিতা দাবি করেন। ’
আমেরিকানরা তাদের গনমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার নিজেদের প্রভাব বিস্তারের কাজেই। আর লাদেনকে মারার কারনে ওবামা যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল তা কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে। এদিক থেকে লাদেনের মৃত্যু ওবামার জন্য লাভজনকই হয়েছে বলে ধারনা করা যায়।
গনমাধ্যমে এখনও প্রচার করা হলনা কিভাবে লাদেনের মৃত্যু হয়, যদিও ওবামা বার বার বলছেন তিনি লাদেনের মৃত্যু দেখেছেন।
তাহলে কি সাধারন মানুষ বরাবরের মত এবারও বোকাই বনে গেল মার্কিনদের কাছে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।