আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রঙিলা

একুয়া রেজিয়া

ভেরা চাপলিনা নামের এক রাশিয়ান লেখিকা পেশায় ছিলেন চিড়িয়াখানার পরিচালিকা। তার জীবনের বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতা আর বিশাল অনুভূতি দিয়ে লিখেছিলেন তার জীবনের অনবদ্য এক বই নাম তার “আমাদের চিড়িয়াখানা”। ক্লাস ফাইভে থাকতে সেই বই পড়ে আমি শপথ নিয়েছিলাম আমি বড় হয়ে হব চিড়িয়াখানার পরিচালিকা। আমিও বই লিখব ভেরা চাপলিনার মত করে, কিন্তু ওই যে কথায় বলে না - “সময় বদলায়, বদলায় এই মন” ঠিক তাই হল আমার সাথে, ইচ্ছেগুলো ধামাচাপা পরে গেলো জীবনের ব্যস্ততায়, বাস্তবতায়। তবে কিছুদিন আগে এক ঘটনায় আমার মনে পরে যায় সেই ছোট্টবেলার চিড়িয়াখানার কথা।

আজ তাই লিখতে বসা - * পশুপাখি নিয়ে কৌতূহল আমার অনেক আগে থেকেই। আগে আমাদের পোষা পাখি, খরগোশ, বিড়াল, কুকুর, কচ্ছপ, একুরিয়াম ভরা মাছ সবই ছিল। আম্মু খুব শখ করে বছর কয়েক আগে একটা টিয়া পাখি এনেছিলেন। তারপর একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন টিয়া তাঁকে ধারালো ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে। পরের দিনই সেই পাখিকে বিদায় করা হয়েছে।

এক ময়না পাখিকে আমরা প্রায় ৫০ এর উপর শব্দ শিখিয়েছিলাম। সেই পাখি দরজা খোলার আগেই বলে দিতে পারত কে এসেছে। তারপর তার নাম ধরে তীব্র চিৎকার দিত। যাই হোক, কিছুদিন আগে বেলা শেষে বাড়ি এসে দেখি বারান্দায় একটা গোল খাঁচা ঝুলছে। তাতে বসে আছে ময়লা, অসুস্থ, কুৎসিত এক টিয়া পাখি।

অনেক দিন হয়ে গেছে আমরা বাসায় আর পশুপাখি পালিনা। ঢাকার প্রতিবেশীরা আবার এইসব পছন্দও করেনা। আর আমার একটা ধারণা এমন হয়ে এসেছে যে পশু বা পাখিকে পোষ মানানোর চেয়ে বনে উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। তাই বাসায় এহেন এক পাখি কে দেখে আমি মোটেও খুশি হলাম না। আমাদের বাসার স্যাটেলাইট মানে আমার ছোট ভাগ্নি বহ্নির কল্যাণে জানা গেলো, এই পাখিটি আমার বোন এনেছে।

আজকাল মানুষের চেয়ে নাকি পশুপাখি ভালবাসা, সম্মান ভাল অনুভব করে তাই সে এই অসুস্থ পাখিকে কিনে এনেছে, সে না কিনে আনলে নাকি পাখি ওয়ালা পাখিটিকে না খাইয়ে মেরেই ফেলত। আর এই পাখিটি অসুস্থ বলে এটাকে কেউই কিনতে চায়নি। আমি ব্যাপক বিরক্ত হয়ে পাখির খাঁচার কাছে যাওয়া মাত্রই আমার বোন ঘোষণা দিল এই পাখির নাম হবে –“মিঠু”। আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম - মিনা, রাজুর কার্টুন দেখে আর কিছুই তো মনে রাখনি, খালি টিয়া পাখির নামই মনে আছে! যেহেতু পাখিটা একটু মনমরা তাই তার একটা পাঙ্খা নাম দিতে হবে। উমম... কিছুক্ষণ ভেবে আমি বললাম - এর নাম হবে রঙিলা।

আমার ভাগ্নি ও আপু আমার নামটা একদমই পছন্দ করল না। আমি তবুও খাঁচায় একটা টোকা দিয়ে বললাম - কিরে? রঙিলা নামটা তোর পছন্দ হয়েছে, পাখিটি ক্লান্তভাবে তার মাথাটা ডান থেকে বামে কাত করে ফেলল। আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম - নাম রঙিলাই হবে "ডান"। * প্রত্যেক প্রাণীরই কিছু কিছু নির্দিষ্ট সহজাত ক্ষমতা থাকে। এদের মাঝে পাখিদের ক্ষমতা অন্যরকম বেশি।

যেমন বাবুই পাখির বাসা দেখলে অবাক হতে হয়, ছেলেবেলায় নানু বাড়িতে বরই গাছে বুলবুলি কে ছড়া বললেই সে বেশি করে ঠোকর মেরে বরই ফেলে দিত। এক ম্যাগাজিন থেকে জেনেছিলাম অস্ট্রেলিয়াতে ম্যালি-ফাউল নামে মাটিতে বাস করা একধরণের পাখি আছে। যারা মাটিতে গর্ত খুড়ে বাসা বানায় এবং ডিম ফুটিয়ে তাতে “তা” (উত্তাপ) না দিয়েই বাচ্চা ফুটাতে পারে। কারণ কোন এক অজ্ঞাত উপায়ে তারা বাসার ভিতরে ও বাইরের তাপমাত্রা ৭৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের এক ডিগ্রিও এদিক ওদিক হতে দেয়না। আবার পেঙ্গুইন পাখিদের আত্মহত্যার প্রবণতা, যাযাবর পাখির দিক নির্ণয় ক্ষমতা, বাজ বা ঈগলের শিকার ক্ষমতা, শকুনের ঘ্রাণশক্তি, কাকের বুদ্ধিমত্তা সব কিছুই আসলে অনেক বেশি বিস্ময়কর।

রঙিলা কে আনার কিছুদিনের মাঝে বেশি কিছু ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তা হল - আমার বোনের যত্নে পাখিটি বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে কিন্তু চেহারায় বুনো ভাবটি যায়নি। কেউ কাছে এলেই সে তার দুর্বল শরীর কাছে এনে ঠোকর দিয়ে চায় (শুধু আমার বোন বাদে, মাঝে মাঝে সে বৃদ্ধ মানুষের মত করে তার ছোট্ট খাঁচায় পায়চারী করে, তার খাবারের বাটিতে ভাত দিলে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খেয়ে ফেলে এবং পরিচ্ছন্ন করে ফেলে, আমাকে দেখা মাত্রই সে খাঁচায় পেছনে যেয়ে ঘুরে যায় ও লেজ নাচায় (বেতমিজ পাখি), এবং তাকে রঙিলা বলে ডাকলে তার মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন দেখা যায়, অর্থাৎ সে বুঝতে পারে এইটি তার নাম। কাক মানুষের সব চেয়ে কাছাকাছি বসবাস করা প্রাণী, তাই কাকের মাঝে বুদ্ধিমত্তাও বেশ দেখা যায়। কিন্তু কাকের পর আমি সত্যি রঙিলা কে দেখে এবং আবিষ্কার করে অবাক হচ্ছিলাম।

* মাসখানের পরই দেখা গেল, আমার বোন রঙিলার খাবার এবং টয়লেট করার সময় নিয়ে একটা চার্ট ফলো করছে। তার পরিচিত এক পাখির ডাক্তারের কাছে ২ সপ্তাহে একবার গিয়ে রঙিলার সব অবস্থা ব্যাক্ষা করছে, এমন কি রঙিলার টয়লেট করার ছবি তুলে ডাক্তার কে জমা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকে আমি দেখতাম নামাজ শেষে সে তার অসুস্থ পাখিটির মাথায় দোয়া সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে পাখিটির সুস্থতা কামনা করছে। এরপর দেখা গেল ঔষধ ও ডাক্তারের দেয়া খাবার খেয়ে পাখিটি চোখের সামনে কিছুদিনেই বেশ গোলাকার এবং লম্বা লেজের অধিকারী হয়ে গেল। তার যে ব্যাপারগুলো আমি বেশি লক্ষ্য করেছিলাম তা হল - - আমার বাসায় আসা বন্ধুরা রঙিলার নাম ধরে ডাকলেই সে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকত।

- মাঝে একবার একটা চড়ুই পাখি বেশ কয়েকবার তার খাঁচায় বসে ভাব করতে চেয়েছে। কিন্তু রঙিলার উদাসীনতা ছিল চোখে পড়ার মত। - ২ বার সে অটো খাঁচা খুলে বের হয়ে গেছে। একদিন সে বারান্দায় পায়চারী করছিল আর অন্যদিন সে খাঁচা খুলে বের হয়েও আবার খাঁচায় ঢুকে গেছে। আমরা এসে দেখি কোন এক অদ্ভুত উপায়ে সে ঠোঁট দিয়ে খাঁচার প্যাঁচানো তারটাকে খুলে ফেলেছিল।

-একবার সাদা কাগজের উপরে তাকে বসিয়ে আমি তার ঠোঁটে পেন্সিল ধরিয়ে দিয়েছিলাম, সে ঠিক মানুষের মত করে পেন্সিল ঠোঁট দিয়ে ধরে প্রথম পেছনের দিক দিয়ে কাগজে দাগ ফেলার চেষ্টা করলো, তারপর কিভাবে যেন বুঝে গিয়ে পেন্সিলের শীষ দিয়ে কাগজে দাগ দিয়ে ফেলল। মিনিট দুয়েক দাগাদাগি করে এক সময় এক কামড়ে সে পেন্সিলের শীষ ভেঙ্গে ফেলল। - আমরা অনেক চেষ্টা করেও রঙিলাকে কোন শব্দ শেখাতে পারিনি তবে মাঝে মাঝে দু রকমের স্বরে ডাকতো। একটা ছিল কর্কশ, আর আরেকটা ছিল একটা মৃদু ঘরঘরে শব্দ যা সে শুধু আমার বোনের কাছে থাকলেই করত। -একদিন সকালে বহ্নি তাকে খাবার দিয়ে গেলে সে খুব সূক্ষ্মভাবে বহ্নিকে ঠোকর মারার ভয় দেখিয়ে খাঁচা থেকে বেড়িয়ে যায় এবং বারান্দার গ্রিল দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ে।

একটা পাখিকে উড়তে না দেখে বরং লাফ দিয়ে দেখে আমরা অবাক হই, এবং ধারণা করেছিলাম হয়ত সে উড়তে ভুলে গেছে বা তার ডানার কোন সমস্যা আছে। নিচে তাকে খুঁজতে যাওয়ার পরে দেখা গেল সে মাঠে ছোট ছোট লাফ দিয়ে উড়ছে। আমার বোন “রঙিলা” বলে ডাকা মাত্রই সে আমার বোনের হাতের নিচে চলে আসে। - আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আপু তাকে গোসল করিয়ে দেবার পর বুকে চেপে ধরলে সে ঠিক একটা মানুষের মত মাথা কাত করে শুয়ে পড়তো। - একদিন তার খাঁচার উপরের দড়িতে বুয়া আমার স্কার্ফ শুকাতে দিয়েছিল।

স্কার্ফের ঝুল টুকু খাঁচা প্রায় ছুঁইছুঁই করছে। একটু পর এসে দেখি সে স্কার্ফের ঝুল টেনে তার প্রায় অর্ধেকটা খাঁচার মাঝে টেনে ফেলেছে আর রাগী চেহারা করে ঠোঁট দিয়ে ধরে রেখেছে। - মাঝে একদিন ভূমিকম্প হবার আগে আমি দেখেছি সে অনেক ক্ষণ স্থির হয়ে বসে আছে - নড়ছে না। খাঁচায় ধাক্কা দিলেও নড়ছে না আমাকে লেজ দেখাচ্ছে না,পানি বা খাবার খাচ্ছে না। প্রায় বেশ কয়েক মিনিট পর মৃদু ভূমিকম্প হল, যা কিনা আমি টেরও পাইনি, টেলিভিশনের থেকে জেনেছি।

অথচ তারপর তাকে আমি দেখলাম স্বাভাবিক হতে ও খাবার খেতে। রঙিলা কে মাঝে মাঝে খাঁচার বাইরে বারান্দায় ছেড়ে দেওয়া আপুর অভ্যাস ছিল। সে কখনোই পালাতো না। আমি অবাক হতাম একটা বুনো পাখির মাঝে পোষ মানার সব গুণাবলি দেখে। এর মাঝে আপু এক জোড়া লাভ বার্ড এনে ফেলল।

লাভ বার্ডগুলো অনেক ডাকাডাকি করত কিছু আমি বরাবরই রঙিলা কে দেখেছি তখন উদাস ও নির্বিকার হয়ে নিজের খাঁচায় পায়চারী করতে। “হুমায়ূনি উৎপাত” লেখার সময় আমি ঠিক করেছিলাম রঙিলাকে নিয়েও লিখব, বেশ কিছু ছবিও আপু মোবাইলে তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু লেখার সময় হয়নি। গত শনিবার সকালে আপু গেছে বাইরে, আমি ১০ টার দিকে দেখি রঙিলা একা একা বারান্দার গ্রিলে বসে আছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি সেইবার সে খাঁচা খুলেনি বরং ঠোঁট দিয়ে খাঁচার ৩টি তার কেটে ফেলে তারপর বের হয়েছে।

আমি বার কয়েক ওকে ধরতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। দুপুরের দিকে আপু এলো, তখন সে রঙিলা কে ধরে খাঁচায় দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু এই প্রথম রঙিলা আপুর হাতে এসেও অপেক্ষা না করে আবার বের হয়ে জানালার গ্রিল দিয়ে উড়ে গেলো। আপু নিচে গিয়েও তাকে খুঁজে পায়নি। অথচ সে সকাল থেকে চাইলে অনেক আগেই উড়ে যেতে পারতো, যেন সে আপুর সাথে দেখা করার জন্যেই, বিদায় নেওয়ার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল।

আপু বলেছিল - "কত আগেই তো রঙিলা চলে যেতে পারতো কিন্তু যায়নি। আর আজ সে যাবার জন্যে এতই মরিয়া ছিল যে খাঁচা কেটে ফেলেছে। থাক... মুক্ত থাকুক, ভাল থাকুক রঙিলা। " রঙিলার শূন্য খাঁচা ছিল আমাদের বারান্দায় তারপর সেটাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু লাভ বার্ডগুলো আছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হল আপু রঙিলার সব ছবি মুছে ফেলেছে, তার নাকি রঙিলার ছবি দেখলে মন খারাপ হয়। আপু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আর তার হাতে রঙিলা বসা, এমন একটা চমৎকার ছবিও তুলেছিলাম, যা আর নেই। আমার বন্ধুরা এসে রঙিলা কে খুঁজে বেড়ায়। বারান্দার পাশের কামরাঙা গাছে মাঝে মাঝেই পাখিদের ডাক শুনলে বহ্নি উঁকি দিয়ে দেখে রঙিলা ফিরে এসেছে কিনা। অদ্ভুত হলেও সত্যি গত ৪ মাসে এই কুৎসিত,পাজি পাখিটি নানা কাণ্ড করে এক সময় আমাদের সবার মনেই তার জন্যে জায়গা করে ফেলেছিল।

*** এই লেখাটা আমার বড় বোনকে উৎসর্গ করলাম। যাকে আমি দেখেছি একটা পাখিকে নিজের সন্তানের মত ভালবাসতে। [/si একটা ছোট্ট অনুরোধ- ১। কাঁটাবন/রাস্তা থেকে ময়না/টিয়া/ঘুঘু/মুনিয়া না কিনবেন না। কারণ এই পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

ময়না, টিয়া critically endangered। একান্তই পাখি পুষতে চাইলে কবুতর পোষা উচিত বা এমন পাখি (বাজারিগার্স) যারা খাঁচায় বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ২। চিড়িয়াখানায় গিয়ে কখনোই পশু-পাখিদের উত্যক্ত করবেন না কিংবা তাদেরকে কোন খাওয়া দেবেন না। পাখিদের কে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে সব সময় সহযোগীতা করবেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।