আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রঙের মানুষ, রঙিলা আকাশে উড়াও অন্তরের হাউশ...(শেষ পর্ব)

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

** দৃশ্যপট-৭ ** আজকাল অন্তর মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত । সীমানা না বল্লেও অন্তর বুঝে সীমানার পক্ষে একা ছোট বাচ্চা সামলানো কষ্টকর । সীমানা যদিও কোন অনুযোগ করেনি; তবুও ওকে শুশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদ মিলে একটা পরিপূর্ণ সংসার দিতে পারেনি , সেই কষ্টটা প্রায়শই অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রায়শই। অন্তর ভেবেছিল বাবা-মা'র সাথে কথা বলবে, এতদিন হয়ে গেছে । সীমানা খুব সংসারী একটা মেয়ে; বাবা-মাকে সেটা বুঝাতে চায় অন্তর।

ফোন করে একবার কথা বললে কেমন হয়, নাকি বাসাতেই যাবে, অন্তর ভাবে । নিজের বাসার নাম্বারে অনেকদিন পর ডায়াল করল ও। ওপাশে মায়ের মুখে 'হ্যালো' টুকুতেই চোখ প্লাবিত হয়। - মা ! কেমন আছো তোমরা ? ওপাশে একটুখানি নিরবতা । অন্তরের মা চোখের জল মুছে নেন।

একসময় যারা মায়ের আঁচল ছাড়া চলতে পারত না, তারা হঠাত বড় হয়ে গেলে নিজেদের আর আবদ্ধ রাখতে চায়না । যে বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হতনা ছেলে-মেয়েরা, বয়স হয়ে যাবার পর সেই বাবা-মা'ই অনেক অসহায় হয়ে পড়েন তাদের কাছে। তবু সন্তান বলে কথা। - তুই এতদিন পর ফোন করলি ! তোর বাবা তো হাসপাতালে । গতকাল ভর্তি হল...আমার শরীরটাও ভাল না, আমাদের সময় হয়ে এল বোধহয়... ওপাশ থেকে ফোনটা কেউ কেড়ে নিল বোধহয়, অন্তর ওর বড় ভাইয়ের গলা শুনতে পেল।

- শোন, তোমাদের সাথে সম্পর্ক সেই দিনই শেষ হয়ে গেছিল যেদিন তুমি আমাদের অগ্রাহ্য করে নিজের মত করে সংসার শুরু করলে । তখন তো বাবা-মা-ভাইকে মনে পড়ে নাই ! এখন গলায় দরদ কেন এতো ! নিশ্চয়ই কোন সমস্যায় পড়েছো, তাই এখন সাহায্যের জন্য আমাদের খোঁজ-খবরের নাটক... অন্তরের ব্যাকুল, বাষ্পরূদ্ধ গলায় বলে , - ভাইয়া, এভাবে বলছ কেন ? আমার দোষ পরে হিসেব করে নিও নাহয়, বাবার কি হয়েছে ? কোন হাসপাতালে ভর্তি করেছো ? - তোমার এইসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও হবে; বাবার পাশে আমরা আছি...তুমি তোমার মত থাকো, আমরা আমাদের মত... ফোনটা খটাশ করে রেখে দেয়ার শব্দ শোনা যায়...তারপর টেলিফোনের যান্ত্রিক আওয়াজ। মাকে বলা হলো না ওদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে ! ** দৃশ্যপট-৮ ** সরাসরি মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে ভাবল অন্তর। অফিস থেকে ফেরার পথে তাই বাসায় গিয়ে হাজির । দরজা খুলেই ভ্রু কুঁচকে দিলেন অন্তরের বড় ভাই।

- তুমি ? - ভাইয়া, বাবা কেমন আছে ? মা'র শরীরটাও নাকি খারাপ ? - বলেছি তো আমাদের সাথে সেদিনই তোমার সব সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে। - ভাইয়া, আমার ভুল হয়েছিল ওভাবে চলে যাওয়াটা, তবে সীমানাকে নিয়ে সুখে আছি। তোমাদের মিস করি সবসময়ই। মা'কে ভাইয়ার পেছনে এসে দাঁড়াতে দেখল অন্তর । শরীর ভেঙ্গে গেছে অনেক ।

ভাইয়া মা'কে আড়াল করে বললেন, - তোমরা ভাল থাকো, আমাদের ভাল থাকতে দাও। বাবাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না । ** দৃশ্যপট-৯ ** - তোমাকে অনেক অস্থির দেখাচ্ছে । কোন সমস্যা ? মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিতে দিতে বিছানায় চোখ বন্ধ করে আধশোয়া অন্তরকে বলল সীমানা। কোন জবাব নেই ।

সীমানার মনটা কেমন করে ওঠে জানি অজানা আশংকায় । অন্তরের চোখের নীচে একদিনেই কালি পড়ে গেছে। পাশে বসে ওর কপালে হাত রাখে সীমানা । - একি তোমার তো দেখি জ্বর ! সীমানার হাতটা কপালে চেপে ধরে অন্তর এক মুহুর্ত । তারপর ঝপ করে সীমানাকে হতবিহ্বল করে ওর কোলে মাথাটা ফেলে ডুকরে কেঁদে ওঠে ।

** দৃশ্যপট-১০ ** সকাল বেলা সীমানার অনেক নিষেধ স্বত্ত্বেও অফিসে আসল অন্তর। রাস্তায় এতো বেশী জ্যাম ছিল যে, শেষটায় হেঁটেই অফিসে আসতে হল । আজ প্রচন্ড রোদ বাইরে, গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। এসেই শুনে আর্জেন্ট মিটিং । এক ঘন্টার মিটিং -এ ৩০ মিনিট অন্তরকেই বকবক করতে হলো।

মাথার শিরা-উপশিরা ফেটে আসতে চাইছে ওর । মিটিং শেষ করে ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল। মা'কে আবার ফোন করলে কেমন হয় ? সত্যি সত্যিই ডায়াল করল । ওপাশে নির্দিষ্ট বিরতিতে বিরক্তিকর যান্ত্রিক আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে শোনা গেল। কেউ ফোন তুলল না।

মনটা কেমন করে উঠল ওর। অন্তরের বাবাও ওর মত হসপিটালে যাওয়া একেবারেই পছন্দ করতনা। সেই বাবা হসপিটালে কেমন আছেন এখন ! কালরাতে সীমানাকে সব খুলে বলেছে ও । সীমানা বলেছে, ভাইয়া যত কিছুই বলুক, এবার ওরা দু'জন এক সাথে যাবে আবার মায়ের সাথে দেখা করতে। প্রাপ্তিকে সাথে নিয়ে যাবে।

এভাবে আর কতদিন! নাতনির মুখ তার নানু-দাদুরা দেখবেনা! সীমানা কি করছে এখন ? প্রাপ্তিকে নিয়ে খুব ব্যস্ত নিশ্চয়ই। সীমানার গলার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করছে খুব। ফোন করল অন্তর। সীমানা 'হ্যালো, হ্যালো' করছে, কিন্তু অন্তরের কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা। মেয়েটার গলার আওয়াজ পাচ্ছে ফোনে।

দুষ্টুটা কি হাসছে না কাঁদছে ! একটা টিভি এ্যাডের স্ক্রিপ্ট খুব পছন্দ হয়েছে সেদিন অন্তরের। ওখানে একটা ছোট বাচ্চা দরকার। নিজে থেকেই বলে ফেলেছে জামান ভাইকে প্রাপ্তির কথাটা । জামান ভাই অন্য ডিপার্টমেন্টের হলেও অন্তরের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক। উনি তো শুনে হইহই করে উঠলেন - ”'তোমার মেয়ে থাকতে আমি কিনা সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াই...' ।

সীমানাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। এতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে এত টানাটানির কোন মানে নাই। বড় হোক তারপর দেখা যাবে। সীমানার 'হ্যালো, হ্যালো' -তে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে অন্তর। গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কোন আওয়াজ বেরুচ্ছেনা যেন! ফোনটা আসতে করে নামিয়ে রাখল ও । অসম্ভব নিস্তেজ লাগছে নিজেকে। মাথা ঘামছে। টলতে টলতে চেয়ার থেকে উঠে টয়লেটে গেল অন্তর। লকটা বন্ধ করে বেসিনটা ধরে কোন মতে দাঁড়িয়ে হরহর করে বমি করে দিল।

** দৃশ্যপট-১১ ** অনেকক্ষন অন্তরকে ডেস্কে না পেয়ে ওর এক জুনিয়র কলিগ অন্য ডেস্কে খোঁজ করা শুরু করল। আউটগোয়িং খাতাতেও কিছু লেখা নাই । মোবাইলে ফোন করে দেখা গেল সেটা অন্তরের ডেস্কেই আর্তনাদ করছে। ঠিক এই সময় কেউ একজন টয়লেটের দরজা এতোক্ষন ধরে বন্ধ বলে ধাক্কা-ধাক্কি শুরু করল। পিয়ন চাবি এনে দিলে লক খুলে ভেতরে ঢুকে অন্তরের সংজ্ঞাহীন দেহটা পড়ে থাকতে দেখা গেল।

অফিসের কিছু লোক খুব দ্রুত অন্তরকে নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুটল । জামান ভাই সহ আরো কয়েকজন গেলেন অন্তরের বাসার দিকে; সীমানাকে খবরটা বলতে হবে, ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। জামান ভাই সহ অন্তরের অন্যান্য কলিগদের অসময়ে আসতে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল সীমানা। জামান ভাই লোকটা হাসি-মস্করা করতে পছন্দ করেন । কিন্তু উনি যখন কথাটা বললেন তখন সীমানা ভ্রু কুঁচকে ভাবল এটা আবার কেমন দুষ্টামি ! তারপর আর সবার দিকে এক এক করে তাকিয়ে অস্ফুট একটা আর্তনাদ করেছিল সীমানা।

ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েছিল; এটুকু বুঝতে পারছিল চোখ থেকে গরম পানি বের হয়ে আসছে। ** দৃশ্যপট-১২ ** ডাক্তাররা বলছেন অন্তরের স্ট্রোক করেছে। এই রকম বয়সের একটা যুবকের স্ট্রোক ! প্রচন্ড মানসিক ও শারীরিক চাপ আর সেই সাথে আবহাওয়ার বৈরীতাই এর কারণ নাকি। ডাক্তাররা বলছে অবস্থা বেশ সিরিয়াস। জ্ঞান ফেরানো যাচ্ছে না।

চটজলদি এক্স-রে, সিটি-স্ক্যান করা হলো। ব্রেইনে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। অন্তরের শরীর এখন জীবিত কিনবা মৃত- কোনটাই নয় , শুধু নিথর হয়ে পড়ে আছে হসপিটালের বেডে । পুরো দু'টো দিন পর ডাক্তাররা যখন অক্সিজেন মাস্ক, স্যালাইনের সূঁচগুলো এক এক করে খুলে নিল অন্তরের শরীর থেকে সেদিন সীমানা চিত্কার করেনি আর। ** দৃশ্যপট-১৩ ** সীমানার বাসাতে এখন অনেক মানুষ।

সীমানার বাবা-মা প্রথম তার সংসারে এল। অন্তরের মাও এসেছেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এমনকি অন্তরের ভাই অসুস্থ বাবাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এসেছেন। এই প্রথম বোধহয় দু'পরিবারের এত মুখোমুখি আসা। সীমানা-অন্তরের কিছু বন্ধু-বান্ধবও এসেছে।

ওরা কেউ শোয়ার ঘরে সীমানার পাশে বসে আছে, কেউ অন্যান্য দিকে ছুটো-ছুটি করছে। সীমানা প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে বসে আছে কখন থেকে। ভাষাহীন চোখ । ডাক্তাররা অন্তরের অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেয়ার পর থেকে ও কারো সাথে কোন কথা বলেনি। এই প্রথম এমন হলো অন্তর ঘরে আছে অথচ সীমানা সেটা অনুভব করতে পারছেনা।

অন্তরের প্রাণহীন শরীরটা পাশের ঘরে রাখা। একটু পর সবাই ওটাকে নিয়ে যাবে দাফনের জন্য। ** দৃশ্যপট-১৪ ** রাত আটটার খবরে অন্তরের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হলো। অন্তর যে টিভি চ্যানেলে কাজ করত সেটাতেই খবরটা বেশী প্রাধান্য পেল নিঃসন্দেহে। এরকম মেধাবী, একনিষ্ঠ একজন কর্মীর আকষ্মিক মৃত্যুতে পুরো চ্যানেল কর্তৃপক্ষ শোকাহত বলে খবর পাঠক জানালেন।

পুরো ২০ সেকেন্ডের ফুটেজে অন্তরের ডেস্ক থেকে শুরু করে ভাবলেশহীনভাবে বসে থাকা সীমানাকেও দেখানো হলো । সীমানার কোলে তখনও প্রাপ্তি । ঘরে এত লোক-জন দেখে ও ভরকে গেছে। আব্বুকে খুঁজছে ক'দিন ধরে, কিন্তু সেই পরিচিত চেহারাটা প্রাপ্তির সামনে আসছেনা। চোখের সামনে ক্যামেরা কাঁধে লোকজনদের দেখে প্রাপ্তি খুবই আগ্রহী ।

যন্ত্রটার দিকেই দু'চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ওর বোধহয় মনে হচ্ছে এই যন্ত্রের পেছনেই ওর আব্বুকে খুঁজে পাওয়া যাবে। খবর পাঠক অন্তরের জানাজা সংক্রান্ত খবর বলে চলেছে। খুব ক্লোজ শটে টিভি স্ক্রীনের পুরোটা জুড়ে প্রাপ্তিকে দেখা যাচ্ছে এখন। গোল গোল চোখে বিষ্ময়।

ক্যামেরাটা ধরার জন্য কিনা কে জানে, হাত বাড়িয়ে দিল শূণ্যে। টিভি স্ক্রীনে দৃশ্যটা ওখানেই স্থির হয়ে গেল। দৃশ্যপটের পরিবর্তন; খবর পাঠক পরের খবরে চলে গেলেন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।